ব্যাগটা পড়ে আছে, তার ড্রয়িং খাতা পড়ে রইল, টিফিন বক্সের খাবার পড়েই থাকল, বন্ধুরা অপেক্ষা করে ছিল, সৌরনীল স্কুলে পৌঁছতে পারল না। বাবার হাত ধরেই রাস্তা পার হচ্ছিল, দানবের গতিতে ট্রাক এসে পিষে দিয়ে গেল একরত্তি ছেলেটাকে। আর ক’দিন পরেই যার জন্মদিন, কেক কাটা হত, হ্যাপি বার্থডে গান হত, এখন ঘরজোড়া শূন্যতা আর হাহাকার। আর পাড়াপড়শি আত্মীয়স্বজন মায় সংবাদমাধ্যমের প্রশ্ন দায়ী কারা? দায়ী কে? দায়ী কে জানলেই সৌরনীল ফিরবে না, দায়ী কে জানলেই তার মায়ের চোখের জল থামবে না, তবুও তো এই হেলায় যাওয়া প্রাণের জন্য দায়ী কে সেটা জানার অধিকার তো সক্কলের আছে। দুর্ঘটনা ঘটল বেহালা চৌরাস্তায়, আর সেই ঘাতক ট্রাককে পাওয়া গেল কোথায়? সাঁতরাগাছি পেরিয়ে কোনা এক্সপ্রেসে। বেহালা চৌরাস্তা থেকে ওই কোনা পর্যন্ত যেতে গেলে কিছু না হলেও গোটা দশেক সিগন্যাল পার করতে হয়। কোথাও খবর গেল না, পুলিশের কেউ খবর পাঠাতে পারল না, এরমধ্যে ড্রাইভার পাল্টে গেছে কি না, গাড়ির কলকব্জাতে পরিবর্তন করা হয়েছে কি না জানাও যাবে না। করা হয়ে থাকলে সেই কারণেই বেকসুর খালাস হয়ে যাবে একজন দোষী ড্রাইভার। অথচ পুলিশ আছে, উর্দি আছে, লাঠি আছে, ক্ষিপ্ত জনতাকে সরাতে গিয়ে আজই তারা কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটিয়েছে, লাঠি চালিয়েছে, কিছু ছাত্রের অভিভাবক এমনকী ছাত্ররাও আহত হয়েছে, কিন্তু বেহালা চৌরাস্তায় এক শিশুকে পিষে মেরে চলে যাওয়া ঘাতক ট্রাকটি সময় পেয়েছে কমবেশি দু’ ঘণ্টা। স্থানীয় মানুষজনের অভিযোগ আরও গুরুতর, তাঁরা বলছেন পুলিশ ট্রাকটিকে ধরার পরেও ছেড়ে দেয়। সকাল সাতটায় ডায়মন্ড হারবার রোডের উপর অত তীব্র গতিতে ট্রাক চলছিল কেন? ওখানে যে পুলিশরা ছিল তারা ট্রাকটিকে থামাতে পারল না কেন? সিগন্যাল কাজ করছিল কি না? এরকম হাজার একটা প্রশ্ন নিয়ে শুরু হবে নাড়াঘাঁটা, তদন্ত যাকে বলে এবং আমি নিশ্চিত সেই ফাইলের কাজ শেষ হওয়ার আগেই অদূরেই আবার এরকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। সেটাই বিষয় আজকে, সৌরনীলের মৃত্যু, সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ।
রাস্তাজোড়া সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফের হোর্ডিং আমরা দেখি, ৮ জুলাই ২০১৬তে নজরুল মঞ্চতে মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই অভিযানের সূচনা করেন, তিনি নিজেই এই অভিযানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর, তাঁরই ছবি থাকে সেসব হোর্ডিংয়ে। রাজ্য সরকার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেননি তা নয়, কিন্তু খামতি যে আছে তা এই বাড়তে থাকা পথ দুর্ঘটনাই বলে দেয়। খামতির মধ্যে সব থেকে বড় জায়গাটা হল ঘুঘুর বাসা মোটর ভেহিকলস, যেখান থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স আর গাড়ির ফিট সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। সামান্য টাকা খরচ করলে কোনও পরীক্ষা ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়, আরও কম খরচে সাত বার রিসোল করা টায়ারওলা, ব্রেক না থাকা গাড়িও ফিট সার্টিফিকেট পেয়ে যায়। প্রতিটা কাজ যা সাধারণভাবে হয়ে যাওয়ার কথা, তার জন্য টাকা লাগে এই মোটর ভেহিকলস-এ। কে জানেন না? পরিবহণ মন্ত্রী থেকে শুরু করে আমলা দামলা প্রত্যেকে এই ওপেন সিক্রেটটা জানেন।
আরও পড়ুন: Aajke | নুসরত আপনি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন
এবারে বলুন যদি এই সমস্যারই সমাধান না হয় তাহলে মুখ্যমন্ত্রী বললেই সেফ ড্রাইভ হবে, লাইফ সেভ করা যাবে? বাস, ট্রাক, তিন চাকার গাড়ি, অটো আর চারচাকার গাড়ির অবস্থা দেখে সত্যি করে ফিট সার্টিফিকেট নিয়ে রাস্তায় গাড়ি নামলে গাড়ির সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে, এটাও সবাই জানেন। এরপরের সমস্যা ট্রাফিক পুলিশ নিয়ে। পর্যাপ্ত লোক নেই, যাঁরা আছেন তাঁরা ডিউটি করতে করতে ক্লান্ত এবং আগের চেয়ে সামান্য কমেছে তবুও এই ট্রাফিক পুলিশের এক বড় অংশের কাজ হল গাড়ি থামিয়ে টাকা তোলা। ইএম বাইপাসে, বিভিন্ন রাস্তায় এঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন, পয়সা তোলেন, সাধারণ মানুষ রোজ তা দেখেন, আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে এটা মন্ত্রী আমলা, পুলিশকর্তারা জানেন না? কীভাবে চলন্ত ছোট হাতিকে থামিয়ে টাকা তোলা হয়, লরিকে থামানো হয় আমরা রোজ দেখি, এঁদের চোখে পড়ে না। হাজারটা সৌরনীল চলে যাবে, লক্ষ লক্ষ বর্গফুট সেফ ড্রাইভে সেভ লাইফের হোর্ডিং টাঙানো হবে, কিন্তু ওই গোড়ায় গলদটা না ধরলে, না শুধরোলে, আসল কাজটা হবে না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, পথ দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর জন্য টাকা নিয়ে লাইসেন্স, টাকা নিয়ে গাড়ির ফিট সার্টিফিকেট দেওয়া না ট্রাফিক পুলিশের গাফিলতি কোনটাকে বেশি দায়ী বলে মনে হয়? মানুষজন কী বলছেন শুনুন।
মানুষের জীবনযাত্রায় এক বিপ্লব এনেছিল চাকা, গাড়ি, বাষ্পচালিত ইঞ্জিন, চার চাকার গাড়ি ইত্যাদি। তারপর মানুষ গতির পেছনে ছুটেছে, মরীচিকার মতো তার আকর্ষণ, গ্রাঁ প্রিঁ থেকে নানান প্রতিযোগিতা এবং নিত্যনতুন রেসিং কার। কিন্তু সেই রেসিং কারের ছোট্ট মডেল নিয়ে যার খেলা করার কথা, সে যদি সেই গতির বলি হয়, যদি সেই গাড়ির চাকার তলায় মানুষ মরে, যদি সেই গতি কেড়ে নেয় প্রাণ, তাহলে তা অকারণ, অমূলক। আর এখানে বিষয়টা আরও মর্মান্তিক, কারণ শহরে ঘটতে থাকা এইসব দুর্ঘটনার পিছনে আছে লোভ আর গাফিলতি, যা ক্ষমা করা যায় না, ক্ষমা করা উচিতও নয়।