আজ ২৮ সেপ্টেম্বর সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে এদিন তাঁর বয়স হত ৯৩ বছর। গত ৬ ফেব্রুয়ারি বিদায় নিয়েছেন ভারতের নাইটিঙ্গল লতা। হিন্দি, মরাঠি, বাংলা সহ মোট ৩৫টি ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি। পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর এবং মাতা সুধামতীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় লতার জন্ম ইন্দোরে। সেখান থেকে তাঁদের পরিবার চলে আসে পুনেতে। জন্মানোর পর লতার নাম রাখা হয় হেমা। পরে বাবা দীননাথের নাটক আত্মবন্ধনের একটি চরিত্র লতিকা থেকে তাঁর নাম হয় লতা।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারান লতা। তাঁরা পাঁচ ভাই-বোন। লতা, আশা, মীনা, ঊষা এবং ভাই হৃদয়নাথ। পুরো সংসারটা তাঁর ঘাড়ে এসে পড়ে। ওই বয়সেই লতার পেশাদার জীবনের শুরু। প্রথমে মঞ্চে এবং সিনেমায় অভিনেত্রী হিসেবে। পরে গায়িকা হিসেবে। হিন্দি সিনেমার প্লে ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে লতা ২৫ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। এটা একটা সর্বকালীন রেকর্ড। ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ভারতরত্ন হয়েছেন লতা। পেয়েছেন ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারও। পাশাপাশি দেশের বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে রাজ্যসভার সদস্যও হয়েছেন। কিছু টুকরো ঘটনার মাধ্যমে কিংবদন্তি লতাজির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।
সেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতে মুম্বইতে গান গাইতে গিয়েছিলেন এক বঙ্গসন্তান। বাংলায় তাঁকে লোকে চিনত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামে। মুম্বইতে গিয়ে তিনি হলেন হেমন্ত কুমার। হেমন্ত শুধু গায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সুরকারও। হেমন্তের সুর করা বহু গান গেয়েছেন লতা। এই সময় হিন্দিতে আনন্দমঠ ছবির সুর করার দায়িত্ব পেলেন হেমন্ত। লতাকে দিয়ে তিনি গাওয়ালেন একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত, শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা। সেই প্রথম লতা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন। তাঁর গায়কীর গুণে শ্রোতারা এক অবাঙালির কন্ঠে রবি ঠাকুরের গান শুনে মুগ্ধ হলেন।
সেই যে লতার সঙ্গে হেমন্তের দাদা-বোনের সম্পর্ক গড়ে উঠল তা বজায় ছিল হেমন্তের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন হেমন্ত। তার দুদিন পরেই ছিল লতার জন্মদিন। সেই বছরটা লতা তাঁর জন্মদিনে কোনও উৎসব করেননি হেমন্তের প্রয়াণের কারণে। হেমন্তের ছেলে জয়ন্তের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল অভিনেত্রী মৌসুমি চ্যাটার্জির। বিয়ের কিছুদিন পরে একদিন হেমন্তের মুম্বইয়ের বাড়িতে চলে গেলেন লতা। মৌসুমিকে ডেকে তাঁর পায়ে নিজের হাতে পরিয়ে দিলেন রুপোর নূপুর। মরাঠি সমাজে প্রথা হল, নতুন বউ এলে শাশুড়ি তাঁর পায়ে নূপুর পরিয়ে দেন। সেই রীতিই পালন করলেন লতা। সেই ঘটনার কিছু দিন পরে হেমন্তের প্রযোজনায় বাংলা ছবি অনিন্দিতায় মৌসুমির লিপে গাইলেন লতা, ওরে মন পাখী/ কেন ডাকাডাকি/ তুই থাকনা রে গোপনে। হেমন্তের সুরে সেই গান এখনও মানুষ মনে রেখেছে।
আর এক ভারত বিখ্যাত বঙ্গসন্তান মান্না দে-র সঙ্গেও লতার সম্পর্ক ছিল দাদা-বোনের। রাজ কাপুরের ছবি শ্রী ৪২০টি ছবিতে দুজনের গাওয়া প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া গানটি সুপার ডুপার হিট হয়েছিল, ছবিও সুপার হিট। এই দেখে একজন দক্ষিণী প্রযোজক রাজ কাপুরকে পরিচালক করে একটি ছবি বানাতে এলেন বোম্বেতে। নায়িকা নার্গিস। ছবির নাম চোরি চোরি। মিউজিক শঙ্কর জয়কিষাণ। ছবির গান রেকর্ডিং হচ্ছে মেহবুব স্টূডিওতে। বেশ কয়েকবার রিহার্সাল করার পর যখন গানটা রেকর্ড করার সময় হল তখন হঠাৎই সেই প্রযোজক স্টূডিওতে হাজির। তাঁর হুকুম, রাজ কাপুরের লিপে গান গাইবেন মুকেশ। বাদ দিতে হবে মান্না দে-কে। রাজ অনেক করে বোঝালেন। দুই সুরকার শঙ্কর এবং জয়কিষাণ বোঝালেন। ঘটনার সময় উপস্থিত নার্গিসও বোঝালেন সেই প্রযোজককে। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। মান্না দে তো তখন প্রমাদ গুনছেন। গান রেকর্ড করতে গিয়ে যদি স্টুডিও থেকে বাদ পড়তে হয় তাহলে তো ক্যারিয়রই শেষ। তিনি তখন তাঁর মা-কে স্মরণ করছেন। এই সময় রুখে দাঁড়ালেন লতা। বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, “মান্নাদা এই গান না গাইলে আমি তো গাইবই না। মুকেশ, রফি কেউই গাইবে না।“ এবার বেশ দমে গেলেন প্রযোজক। খানিকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি সম্মতি দিলেন। লতা-মান্নার গাওয়া সেই গান এ রাত ভিগি ভিগি আজও মানুষের হৃদয়ে অমর।
লতা যে কোনও মানুষের গলা মাত্র একবার শুনে নকল করতে পারতেন। রাজ কাপুরের ছবি সত্যম শিবম সুন্দরমের রেকর্ডিং হচ্ছে। এবার সুরকার লক্ষীকান্ত-প্যারেলাল। রেকর্ডিংয়ের সময় উপস্থিত রাজ কাপুর স্বয়ং। একটা গান দুজনের লিপে গাইতে হবে। প্রথমে কিশোরী পদ্মিনী কোলাপুরীর লিপে। আর পরে ছবির নায়িকা জিনত আমনের লিপে। প্রথমে জিনতের লিপে গান রেকর্ড করা হল। কিন্তু যখন পদ্মিনীর লিপে রেকর্ড করা হচ্ছে তা পছন্দ হচ্ছে না রাজ সাহেবের। বললেন, একটু বাচ্চার লিপে গাইতে পারলে ভাল হত। লতাকে বলা হল, লিপ দেবে পদ্মিনী কোলাপুরী। লতা তাঁকে ডেকে বললেন, আমার সঙ্গে একটু কথা বলতো। পদ্মিনী দু-একটি কথা বলার পরই তাঁর গলা নকল করে লতা গাইলেন, যশোমতী মাইয়া কে বোলে নন্দলালা। রাজ কাপুর জড়িয়ে ধরলেন লতাকে।
লক্ষীকান্ত-প্যারেলালের সুরে অনেক গান গেয়েছেন লতা। কিন্তু তিনি কিছুতেই ক্যাবারে গান গাইতে চাইতেন না। বলতেন, ওটা আমার চেয়ে আশা অনেক ভাল গায়। ক্যাবারে ওকে দিয়ে গাওয়াও। সেবার ইন্তেকাম ছবির জন্য প্যারেলাল জুটি খুব করে ধরলেন লতাকে। প্যারেলালকে একটু বেশি স্নেহ করতেন লতা। কিছু দিন আগেই ওই জুটির সুরে মনোজ কুমারের শোর ছবিতে লতা আর মুকেশ গেয়েছেন এক প্যায়ারকা নাগমা হ্যায়। তাই প্যারেলালকে কিছুতেই না বলতে পারলেন না। গাইতে হল ইন্তেকাম ছবির সেই অনবদ্য ক্যাবারে নাম্বার – আ জানে জা । যে গানটিতে লিপ দিলেন ক্যাবারে কুইন হেলেন।
লতা মঙ্গেশকর তিনজন সুরকারকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। শচীন দেব বর্মন, মদনমোহন এবং সলিল চৌধুরি। মদনমোহনের সুরে লতাজির বিখ্যাত গান মৌসম ছবিতে দিল ঢুঁন্ডতা হ্যায়। এই গানটি তাঁর সঙ্গে গেয়েছিলেন ভূপিন্দর সিং, যিনি এই বছরেই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। ভূপিন্দর ছিলেন গিটারিস্ট। তিনি রাহুল দেব বর্মনের গ্রুপে বাজাতেন। কিন্তু যখন লতা শুনলেন তাঁর সঙ্গে ডুয়েট গাইবেন ভূপিন্দর, তখন তিনি আলাদা করে রিহার্সাল করলেন গানটার জন্য। গানের একটা লাইন ছিল ফুরসতকে রাত আউর দিন। এই লাইনটার অর্থ আলাদা করে বুঝিয়ে দিলেন লতা। দুজনের বোঝাপড়ায় গানটি একটি অমর সঙ্গীতে পরিণত হয়েছিল।
বাংলা সিনেমার বিশিষ্ট সুরকার অজয় দাসের একটা স্বপ্ন ছিল তাঁর ছবিতে লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গান গাওয়ানোর। তাঁর সুরে মান্না দে, কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে গাইলেও লতা কখনও গাননি। কিন্তু তিনি বহু সুর করে একটার পর একটা ক্যাসেট পাঠিয়েছেন লতার বাড়ি পেডার রোডের প্রভুকুঞ্জে। কিন্তু কোনও উত্তর আসেনি। ১৯৮৫ সালে অনুরাগের ছোঁয়া ছবির গানের জন্য তিনি মুম্বই গেলেন। একটা গানের সুর করেছেন। সেটা পুরুষ এবং মহিলা দুই কন্ঠেই গাওয়া হবে। পুরুষ কন্ঠে গাইবেন কিশোর কুমার। সেই ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। তাঁর রেকর্ডিংয়ের জন্যই মুম্বই যাওয়া। কিন্তু মনে মনে আছে লতাকে দিয়ে গানটা গাওয়ানোর কথাও। যদি লতা রাজি না হন তাহলে আশাকে দিয়ে গাওয়াবেন। ব্যাপারটা বললেন সুরকার মানস মুখোপাধ্যায়কে। মানসের সঙ্গে লতার খুবই ভাল সম্পর্ক। মানসের ছেলে শান আজকের জনপ্রিয় শিল্পী। মানসের স্ত্রী সোনালি লতাকে বেশ কিছু দিন বাংলা শিখিয়েছেন। দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ভাল। এক দিন সকালে আ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই মানস অজয় দাসকে সঙ্গে করে চলে গেলেন লতার বাড়ি। রোজ সকালে লতা এক ঘণ্টা পুজো করতেন। মানস এসেছে শুনে পুজোর শাড়িতে বেরিয়ে এসে বললেন, একটু বোস। আমি পুজোটা সেরা আসছি।
তার পর পুজো সেরে এসে বললেন, বল কী ব্যাপার। মানস সব বললেন। লতার গলায় বিস্ময়, সে কী। আমি তো কোনও ক্যাসেট পাইনি। আপনার কাছে গানটার ক্যাসেট আছে? অজয় তখনই ব্যাগ থেকে ক্যাসেট বের করে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া রেকর্ডারে গানটা শোনালেন। তিনি বলেন, পুরুষ কন্ঠে গাইছেন কিশোর কুমার। লতার সঙ্গে ছিলেন তাঁর সচিব মিথিলেশ ভাই। গানটি শুনে কোনও কথা বললেন না। মিনিট পাঁচেক পর লতা বললেন, আমি কালকেই গানটা রেকর্ড করব। মিথিলেশ কালকের সব প্রোগ্রাম ক্যানসেল করে দিন। বাকিটা তো ইতিহাস। গানটি ছিল, আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝলে না।
মুম্বইয়ের এক বিশিষ্ট প্রযোজক সংস্থা ছিল রাজশ্রী পিকচার্স। লতা তাদের বহু ছবিতে গান গেয়েছেন। কিন্তু কোনও একটা ব্যাপারে দু পক্ষের মধ্যে মনোমালিন্য হওয়ায় লতা রাজশ্রী পিকচার্সের হয়ে আর গান করেননি। শেষ পর্যন্ত ১৭ বছর পর রাজশ্রীর ব্যানারে ম্যায়নে পেয়ার কিয়া ছবিতে গান গাইলেন লতা। সৌজন্য ছবির সুরকার উত্তম সিং। এই উত্তম সিংয়ের সুরে বিখ্যাত ছবি হল দিল তো পাগল হ্যায়। যশ চোপড়ার ছবি। লতা গাইবেন। যশের সঙ্গে লতাজির একটা দুর্দান্ত সম্পর্ক ছিল। রেকর্ডিংয়ের পর প্রচুর খাওয়া-দাওয়া হত। আর সারা দুনিয়ায় লতাই মনে হয় এক মাত্র শিল্পী যিনি গান গাওয়ার আগে বরফ দেওয়া কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতেন।
এরকম কত স্মৃতিই যে আছে লতাজিকে নিয়ে, তা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি চলে গিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর মধুর কণ্ঠ আজও আমাদের রয়ে গিয়েছেন। তাঁর গান কোনওদিন ভুলবে না আমজনতা।