মুখে ঝামা ঘষে দেওয়ার মানে নিশ্চয়ই জানেন, তো ওই বয়কট পন্থীদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে ‘পাঠান’। একটা বিরাট সময় জুড়ে মনে হচ্ছিল বলিউডের দখল নিয়েছে আরএসএস–বিজেপি। মনে হচ্ছিল দেশে যেমন একজনও সংখ্যালঘু, আরও পরিষ্কার করে বলা ভালো, মুসলমান মন্ত্রী নেই, ক্যাবিনেট ছেড়েই দিন, আধা সিকি মন্ত্রিত্বও নেই তাদের যাঁরা দেশের ১৮ শতাংশ মানুষ। ওদিকে ঘোষিত ইসলামিক রাষ্ট্র, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে একজন বৌদ্ধ, একজন হিন্দু শেখ হাসিনার ক্যাবিনেট মন্ত্রী। একজন হিন্দু ওই মন্ত্রিসভার পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রমন্ত্রী। নামগুলো বলে দিই, হাসিনা মন্ত্রিসভার চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল বিষয়ক মন্ত্রী হলেন উশে সিং, যিনি একজন বৌদ্ধ। ওই মন্ত্রিসভার খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার একজন হিন্দু কৃষক পরিবারের সন্তান। হাসিনা মন্ত্রিসভার গ্রামীণ উন্নয়ন ও সমবায় দফতরের পূর্ণ দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী হলেন স্বপন ভট্টাচার্য। কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র, এই ভারতবর্ষ, যে দেশের সংবিধানে লেখা আছে, এ দেশ ধর্ম নিরপেক্ষ, সে দেশের জাতীয় মন্ত্রিসভায় একজনও সংখ্যালঘু নেই।
তো আমাদের মনে হচ্ছিল কানাডার নাগরিক অক্ষয় কুমার, বিজেপি সাংসদের স্বামী অনুপম খের প্রমুখই বোধহয় বলিউডের দখল নিল। ভারতবর্ষের তিনটে জিনিস জাতীয় পরিচিতি এনে দেয়, মানে এই তিন বিষয়ে ভারতবর্ষ আলোচনায় থাকে, চর্চায় থাকে। প্রথমটা হল ক্রিকেট, দ্বিতীয়টা হল সিনেমা, তৃতীয়টা হল রাজনীতির বেনিয়াসহকলা। হর এক সামিল হ্যায় ইস খেল মে। রাজনীতিতে আপাতত প্রবল মেরুকরণ, তীব্র জাতীয়তাবাদ আর উগ্র হিন্দুত্বের ঝান্ডা তুলে আরএসএস–বিজেপি বিরোধীদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। ক্রিকেট ফেডারেশনের মাথায় বসে আছে ছোটা মোটা ভাইয়ের পুত্র, জয় শাহ, পাড়ায় ক্রিকেট খেলেছেন, এমন অপবাদও তাঁর নামে নেই। রইল বাকি সিনেমা। আমরা বছর কয়েক ধরে দেখছিলাম গুমনামি, কাশ্মীর ফাইলস, কেশরী, মিশন মঙ্গল, রাম সেতু, তাসখন্দ ফাইলসের মতো ভালগার প্রপাগান্ডা চলছে রমরম করে। আমির খানের অসম্ভব ভালো ছবি লাল সিং চাড্ডা ফ্লপ করার পরে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছিল হিন্দুত্ববাদীদের দখলে দক্ষিণী ছবি না গেলেও বলিউডের দখলদারি এখন আরএসএস–বিজেপির। সিনেমায় মুসলিম চরিত্র, একটা সময়ে ছিল ঐতিহাসিক, মানে আকবর, জাহাঙ্গির, অমুক সুলতান, তমুক নবাব। যাঁরা সিনেমায় এসেছেন, তাঁরাও নিজেদের নাম গোপন করে, ইউসুফ হয়েছেন দিলীপ কুমার।
৮০র দশক থেকে আমির, সলমন আর শাহরুখ, তিন খান ভাই মিলে ছবিটাকে ঘাড় ধরে পালটে দিলেও গল্পে তাঁরা হিন্দু করণ অর্জুন, মঙ্গল পান্ডে, রনছোড়দাস চাঁচড় কিংবা ফুনসুক ওয়াংড়ু, কবির সিং। তার আগে মুসলিম ক্যারেক্টারগুলো ছিল হয় ভিলেন, না হলে নায়কের বন্ধু, জঞ্জিরে প্রাণের চরিত্র। মেন স্ট্রিম মুভিতে শাহরুখ প্রথম সাহস দেখালেন, সরাসরি মুসলিম প্রোটাগনিস্ট, নায়ক এল পর্দায়, যে ভারতীয়, যে লড়ছে, হাড়কাঁপানো ডায়ালগ দিচ্ছে। হতেই পারে মেনস্ট্রিম মুভি কিন্তু যখন তিনি বলছেন মাই নেম ইজ খান, তখন হিন্দু ফ্যানেদের মনে কোনও প্রশ্ন নেই, মুসলিম ফ্যানেরা সেদিন গর্বিত ভারতীয়। রইস-এ এক মাফিয়া, ডন, কিন্তু ওই যে কোই ধন্দা ছোটা নহি হোতা, আউর ধন্দে সে বড়া কোই ধর্ম নহি হোতা, এক হিরো, এক আইকনের মুখ দিয়ে এই উচ্চারণ কুঁকড়ে থাকা মুসলমান মানুষজনকে ভরসা দিয়েছে। এটা সত্যি কিন্তু তাঁর হিন্দু ফ্যানেরা কি এই ডায়ালগ আওড়ায়নি? হঠাৎ করে বয়কট চলে এল বলিউডে, বয়কট সেই সব কিছু যেখানে তাদের মনে হয়েছে তা হিন্দু ধর্মের উপরে আঘাত। তাদের আপত্তি আলাউদ্দিন খিলজি নিয়ে, এক মিথ, এক উপকথা নিয়ে তাদের ঐতিহাসিক ছ্যাবলামো, পাগলামো। আরে ভাই ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে ছবি, অদ্ভুতুড়ে, মাথামুণ্ডু নেই সে ছবির, তবুও তো ব্রহ্মার অস্ত্র নিয়ে ছবি, সে ছবির নায়ক কেন গরু খান? এটাই প্রশ্ন? এই কারণেই বয়কট। যদিও বয়কট খুব একট কাজ করেনি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: একটি স্বপ্নে দেখা ডকুমেন্টারি এবং তার বর্ণনা, পর্ব ১
এবার সেই বয়কটের স্লোগান আরও জোরে, স্বাধ্বী ঋতাম্ভরা থেকে মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী, বিজেপির ছোট বড়, মেজো সেজো কর্মকর্তার প্রশ্ন, দীপিকা পাডুকোন কেন গেরুয়া রংয়ের বিকিনি পরে গান গাইছে, তাও আবার বেশরম রং। হলফ করে বলতে পারি, ওই তারাই চেটেপুটে খেয়েছে এই ছবির ভিডিও, কিন্তু রাস্তায় মিছিল বয়কট পাঠান। মানে এই বেশর্মীর জবাব হল বয়কট। গত একমাস ধরে বিভিন্ন চৌরাস্তায় তাঁরা বক্তৃতা করেছেন, শাহরুখ দীপিকার কুশপুতুল জ্বালিয়েছেন, না প্রযোজক, না শাহরুখ, না দীপিকা, কেউ একটা কথাও বলেননি। উলটে শাহরুখ যেখানে গেছেন, সেখানে হাসতে হাসতে বলেছেন, অপনি কুরসি কি পেটি বাঁধ লিজিয়ে, মৌসম বিগড়নেবালা হ্যায়। উনি জানতেন, মৌসম বিগাড়নেবালা হ্যায়। বয়কটপন্থীরা অবাক হয়ে দেখলেন অ্যাডভান্স বুকিং থেকে আজ অবধি শাহরুখ খানের পাঠান রেকর্ড ভাঙছে তো ভাঙছেই। প্রথম দিনের ইনকাম, দুদিনের কালেকশন, চারদিনে চারশো কোটি, সবই রেকর্ড। আমার এক বন্ধু জানাল, ভোপালে বয়কটের মিছিল শেষে সব্বাই টিকিট কেটে হলে ঢুকে পাঠান দেখেছেন। হ্যাঁ একলা হাতে শাহরুখ খেলাটা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এ ছবি সেকুলার? এ ছবি খুব উচ্চমানের ছবি? এ ছবি দেশের মুসলমান, দেশের মানুষদের কাছে অসাধারণ কোনও মেসেজ নিয়ে হাজির হয়েছে? এই প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর না, বোল্ড লেটারে এন ও, নো। কিন্তু এই ছবি মূলধারার ছবি, মূলধারার ছবির দর্শকদের কাছে ওই সব বয়কটের স্লোগান, পায়তাড়াবাজি, তিকড়মবাজি যে অন্তঃসার শূন্য, ফাঁকা আওয়াজ তা প্রমাণ করে দিয়েছে। আরএসএস–বিজেপি বলবে আর মানুষ সেই শুনে সিনেমা দেখবে বা দেখবে না, এটা যে হবে না, সেটা জানিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ বার খেয়ে বিপ্লবী হয়ে যাওয়া সাভারকর আন্দামানে গিয়েই বুঝেছিলেন এটা সহজ পথ নয়, ইংরেজ প্রভুদের কাছে মুচলেকা দেওয়া শুরু করেছিলেন। তারপর মুক্তি পেয়ে দেশের মানুষকে বুঝিয়েছিলেন ইংরেজ নয়, দেশের শত্রু মুসলমান, সংখ্যালঘু মানুষ, দেশের ইতিহাসে দখলদার ইংরেজরা নয়, যারা বিদেশ থেকে এসে ভারতবর্ষের ধন সম্পত্তি লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে, তারা নয়, তাঁদের ইতিহাসে দেশের দখলদার হল মোঘলরা, যারা এসেছিল বিদেশ থেকে, কিন্তু এদেশেই খুঁজে পেয়েছিল তাদের স্থায়ী ঠিকানা, এদেশেই গড়েছিল মিনার, প্রাসাদ, সৌধ এমনকী সমাধি স্থল। শক হুন দল, পাঠান মোগল, একদেহে হল লীন। আরএসএস–হিন্দু মহাসভা, সাভারকর, গোলওয়ালকর, হেডগেওয়ারের দল সেই মোগল-তুর্ক-মধ্য এশিয়ার রাজা নবাবদেরই আসল দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, আজও তাই বিশ্বাস করে, করে বলেই মোঘল গার্ডেনের নাম পালটে রাখে অমৃত উদ্যান।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: আবার স্বপ্নে দেখা ডকুমেন্টারি এবং তার বর্ণনা, পর্ব ২
সেই জমানাতে পাঠানের এই ভিনি ভিডি ভিসি, এল দেখল জয় করল এক ঘটনা, যে জয় এল শাহরুখ খানের হাত ধরে, যে শাহরুখ মোদিজি বলে হেঁদিয়ে পড়েননি তো বটেই, বরং মোদি বিরোধিতায় তীক্ষ্ণতম নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। ছেলে আরিয়ান খান, কেবল বাবার এই মাই নেম ইজ খান অ্যাটিচুডের জন্য চূড়ান্ত হেনস্তার শিকার হল, না এই সেদিনও আইনজীবী বেছেছেন, নিয়োগ করেছেন, অপেক্ষা করেছেন বিচারের জন্য, আরিয়ান কে বেকসুর খালাস করে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন, হ্যাঁ তখন এই পাঠানের শুটিং চলছিল। না, আম কেটে চুষে খান ভেজে খান না সেদ্ধ করে খান এসব প্রশ্ন নিয়ে মোদিজিকে এন্টারটেইন করেননি। তারপরেও আবার এই বাংলায় এসেছেন চলচ্চিত্র উৎসবে। সেদিনেই বলেছিলেন কুরসি কি পেটি বাঁধ লিজিয়ে, মৌসম বিগড়নেবালা হ্যায়। হ্যাঁ, মেনস্ট্রিম অভিনেতা, হ্যাঁ, পপুলার অভিনেতা, হ্যাঁ, মুসলমান, কিন্তু পপুলার পারসেপশন, সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধারণা দেবার চেষ্টা তো করলেন। দেখালেন ওই বয়কটপন্থীদের বিরুদ্ধে কীভাবে ভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়। সোজা উপায় ছিল না? ছিল বইকী, রাম কি লক্ষণ, কি অর্জুন, কি কৃষ্ণ সেজে লাইনে দাঁড়িয়ে যাওয়া, ছিল উপায় সাভারকরের চেহারায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের খুশ করে নিজের কেরিয়ারে নতুন রেকর্ড তৈরি করা। না, করেননি, মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন, আন্ডার কভার এজেন্ট নয়, ফ্রন্টলাইন সোলজার হিসেবে, এবং আনন্দের কথা জিতেছেন। আর হ্যাঁ, একটা কথা বলা ভারি জরুরি, এই বাংলার শিরদাঁড়াহীন, ইডি সিবিআই-এর ভয়ে মরে থাকা সাত মার পালোয়ানদের একটানা ১০০ দিন পাঠান দেখা উচিত বলে আমি মনে করি। দেখা উচিত নিজেকে গ্রুম করা কাকে বলে, সিক্স প্যাক কাকে বলে, হিরো কাকে বলে। শাহরুখের ৫৭, বাংলার প্রতিভাবান নায়কগণ, বয়েস তো কম হল না, এবার ব্যোমকেশ, কিরীটী, ফেলুদার হাত ছেড়ে নিজের পায়ে একটু হাঁটতে শিখুন। জয় হোক পাঠানের।