সকাল থেকেই অঘোষিত কার্ফু ফ্ল্যাট জুড়ে। বাড়ির কর্তা বাজার করতে যাচ্ছি বলে সেই যে বেরিয়েছেন, আর পাত্তা নেই। কন্যাটি দরজা এঁটে ল্যাপটপ খুলে পড়তে বসেছে। ঘরময় গটগট করে পায়ের শব্দ ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। ঘটনাটা হল, বাড়ির গিন্নি আজ কাজে নেমেছেন। বাসনমাজার লোক, রান্নার লোক সকলে ছুটি নিয়েছেন। পঞ্চায়েত ভোটে কেউ গিয়েছেন গোসাবা, কেউ বাসন্তী। মুর্শিদাবাদ থেকে হাসনাবাদ কিংবা রানাঘাট থেকে মেদিনীপুর। শুক্রবার বিকেল থেকে কলকাতা গৃহ সহায়িকা শূন্য। শুধু এদিন নয়, অন্তত ২-৩ দিনের মতো নিশ্চিন্দি। ফলে রাজ্যজুড়ে বোমা-গুলি-বন্দুক চললেও ঘরের ভিতর যেন যুদ্ধ চলছে।
গতকাল রাত থেকেই আর রাস্তার ধারে ইমারতি মালমশলা পড়ছে না। ট্রাক ঢোকেনি রাজ্যে। নেই ভ্যান চালকরাও। যে বহুতল দিনভর রাজমিস্ত্রিদের কাজে গমগম করত, তা আজ নির্জীবভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও সাড়াশব্দ নেই। রাজ্যে যে পঞ্চায়েত ভোট চলছে। কল্লোলিনী কলকাতা যেন যুদ্ধশেষের শহরে পরিণত হয়েছে।
এদিন সকাল থেকে রাস্তায় বেরিয়ে নাকাল হয়েছেন যাত্রীরা। বহু বাস তুলে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সকাল ৯টা নাগাদ দেখা গেল সাঁতরাগাছি রেল স্টেশন সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ড ধু-ধু করছে। বাসও নেই, লোকজনও নেই। স্টেশনের বাইরে যে দোকানগুলি রোজ গমগম করে, তার উনুনে আগুন জ্বলেনি। ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ, হাওড়া সর্বত্র একই ছবি। ডানলপ মোড়ে সকাল সাড়ে ৮টায় দেখা গেল কিছু গাড়ি আপনমনে চলছে। সিগন্যালের আলো লাল হচ্ছে, সবুজ হচ্ছে। কিন্তু কোনও যানজট নেই। দু-একজন সিভিক কর্মী গুলতানি করছেন ট্রাফিক কিয়স্কে।
যার ফলে অটো, টোটো, ট্যাক্সি ও অ্যাপ ক্যাবের বাজারদর ছিল চড়া। রিকশওয়ালাদেরও পোয়া বারো। যে যেখানে যেমন খুশি দর হেঁকেছে। প্রয়োজন বুঝে ১০ টাকা ভাড়ার জায়গায় ৪০-৫০ এও রফা করতে হয়েছে। একটু সন্ধ্যা নামলে সেটা কোথায় পৌঁছাবে ইয়ত্তা নেই।
সওয়া ৯টার মেট্রোয় বেলগাছিয়া থেকে অন্যদিন প্রায় ওঠাই যায় না। এদিন সরসরিয়ে ওঠা গেল। এ যেন এক অন্য কলকাতার চালচিত্র। সব থেকে এদিন সমস্যায় পড়লেন মুমূর্ষু রোগী নিয়ে হাসপাতাল পথযাত্রীরা। ফোনের পর ফোন করেও অ্যাম্বুল্যান্সের দেখা নেই। অনেকেই ভোটের কারণে দেশে চলে গিয়েছেন। যাঁরা রয়েছেন, বিরাট দর হাঁকছেন। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আউটডোরের টিকিট কাটার লাইন ফাঁকা। অন্যদিন সকাল ৮টার মধ্যেই এঁকেবেঁকে সর্পিল আকৃতি নেয় এই লাইন। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে অসংখ্য বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স। এদিন কোত্থাও কিছু নেই। উধাও শববাহী গাড়িও। যাঁরা বিপদে পড়েছেন, তাঁরাই টের পেয়েছেন ভোট উৎসবের স্বাদ। আত্মীয়-পরিজনের মৃত্যুর খবর পেয়েও নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে গন্তব্যে পৌঁছাতে।
বাগুইআটি বাজারে সকালে লোক ধরে না। কাল সন্ধ্যায় ছিল থিকথিকে ভিড়। যেন কোভিডের পর প্রথম বাজার খোলার দৃশ্য। আর আজ সকালে সবজিওয়ালারা হাওয়া। বেমালুম ফাঁকা বাজারে মাছ-সবজি মিলিয়ে গুটিকয়েক লোক বসে আছেন। কেনারও লোকও নেই, বেচার তো নেই-ই। সবাই গিয়েছে ভোটে। কারণ, ডায়মন্ড হারবারের নগেন্দ্রবাজার হোক কিংবা খড়িবাড়ি কোথা থেকেও মাছ ব্যবসায়ীরা আসেননি। হাওড়া মাছ বাজারেরও হাল সমতুল।
অগত্যা ত্রাহি মধুসূদন দশা তিলোত্তমার। বাগুইআটির একটি আবাসনের ফ্ল্যাটে ব্যাঙ্ককর্মী অমিত রায়ের স্ত্রী তাই দুপুরে মোবাইল অ্যাপে খাবারের অর্ডার দেওয়ার ‘নির্দেশ’ দিলেন স্বামীকে। প্রৌঢ় স্বামীর অর্ডার দিতে চোখ কপালে। বিরাট পরিমাণ ডেলিভারির টাকা লাগছে। পারমিতা যে হোটেলের নাম বলে দিয়েছিলেন, তারও পরবর্তী হোটেল খোলার সময় দেখাচ্ছে টুমরো অ্যাট ইলেভেন থার্টি এএম।