গতকাল থেকে এক রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারের আবহ শুরু হয়ে গিয়েছিল মিডিয়াতে। কোথায় সায়নী? সায়নী কি উবে গেলেন? সায়নী কি ভয় পেয়ে দিল্লি চলে গেছেন? ওনার দলের নেতারাই নাকি সায়নীর হদিশ পাচ্ছেন না। সায়নী ঘোষ এবার জেলে যাবেন। ভয় পেয়ে লুকিয়েছেন সায়নী। কুন্তলের সঙ্গে আর্থিক যোগাযোগ পেয়ে গেছে ইডি, সিবিআই কর্তারা। হেডলাইনের পর হেডলাইন। এবং সত্যিই সায়নী ঘোষ, তৃণমূলের যুবনেত্রীর ফোন বন্ধ। সব মিলিয়ে এক জমাট নাটকের পরে সায়নী ঘোষের জন্য ইডি দফতরের সামনে অসংখ্য ক্যামেরা, চ্যানেল, মোবাইল, ইউটিউবার ইত্যাদি। রাজ্যে কমবেশি একটা সাধারণ নির্বাচন আর সাত দিন পরে, কিন্তু মিডিয়া মে ছা গয়ি অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ। একজন নিপুণ অভিনেত্রী হিসেবে আহা এমনই তো সম্ভবত চেয়েছিলেন সায়নী, অসাধারণ কিছু কাজ করেছেন সিনেমাতে, অপরাজিততে বিমলা রায়, আলেয়াতে এক মুসলমান মেয়ের চরিত্র, দারুণ সব কাজ। তখন কি এসেছিল মিডিয়া? না আসেনি। এখন আসছে কেন? কারণ নৌটঙ্কি হচ্ছে। আমি নিশ্চিত সায়নীও তখন এই মিডিয়া অ্যাটেনশনই চেয়েছিলেন, যদি পেতেন, তাহলে কি এই রাজনীতিতে আসতেন? জানি না, যদির কথা নদীর ধারে রেখে অন্তত এটা তো বলাই যায়, সেসব কাজের সত্যিই অ্যাপ্রিসিয়েশন জরুরি ছিল। আজ সিজিও কমপ্লেক্সের বাইরে মিডিয়ার ভিড়ে সায়নীকে সেইরকম অভিনেত্রীই মনে হল, যেন স্ক্রিপ্ট লেখাই ছিল, ডিরেক্টর অ্যাকশন বলার পরেই তিনি নেমে পড়লেন ফ্লোরে। সাড়ে ১১টায় হাজিরা দেবার কথা, ১১টায় ব্রেকিং নিউজও গেছে, আসছেন না সায়নী, না আসলে কী কী হতে পারে বুঝিয়েছেন সাংবাদিক, তারপর ঠিক ১১ টা ২০তে সায়নী ঘোষের গাড়ি ঢুকল সিজিও কমপ্লেক্সে। সেটাই বিষয় আজকে, সায়নীর জিজ্ঞাসাবাদ এবং দিনভর নাটক।
আমরা আগেই বলেছি, ইডি, সিবিআই, ভিজিলেন্স এজেন্সিগুলো মোদি-শাহের নির্দেশে এক পার্সেপশন তৈরি করার কাজে নেমেছে। এক সাধারণ ধারণা তৈরি করা যে, বিরোধী প্রত্যেক দলের নেতারা চোর, দুর্নীতিবাজ, এরা আসলে করাপটেড। এই কথাগুলো হল আংশিক সত্য, আর আংশিক সত্যকে নিয়েই তো নৌটঙ্কি ভালো জমে। ধরুন এটা তো ঠিকই যে পার্থ বা কুন্তলের ঘর থেকে, তাদের স্ত্রী বা বান্ধবীর ঘর থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাওয়া গেছে, যে নেতা ক’দিন আগে মাছ বিক্রি করত, তার অ্যাকাউন্টে আজ যদি ৬০-৮০-১০০ কোটি টাকা থাকে, তাহলে তো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তাদেরকে ধরা, জেরা করা উচিত, কিন্তু কারও অ্যাকাউন্টে হঠাৎ টাকা বেশি জমা হলেই তাকে নিয়ে গল্প নাটক করতে হলে তো আগে অমিত শাহের পুত্রকে জেলে পুরতে হয়। ক’ বছরের মধ্যে আড়াই কি তিন হাজার গুণ সম্পত্তি বেড়েছে ওই জয় শাহের, না কোনও ইডি তো যায়নি, কোনও সিবিআই তো যায়নি।
আরও পড়ুন: Aajke | ২০২৪-এ বিজেপি বাংলায় ৩৬টা আসন পাবে?
হিমন্ত বিশ্বশর্মা, সারদা কেলেঙ্কারির অন্যতম অভিযুক্ত, কেবল দলটা, জার্সিটা পালটে নিয়েছেন, ব্যস, খোলা ষাঁড়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যেমন ঘুরছেন নারদা কেলেঙ্কারির অন্যতম অভিযুক্ত আমাদের কাঁথির খোকাবাবু। যাদের ধরার তাদের ধরুন, জেরা হোক। এসব তো তদন্ত, আমরা ছোটবেলা থেকে জানতাম তদন্ত তো গোপনে হয়, অপরাধীকে জানতেই দেওয়া হয় না যে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, সমস্ত সাক্ষী প্রমাণ ইত্যাদি যোগাড় করে ঘপাৎ করে ধরে ফেলা, এমনটাই তো হত। এখন ছবিটা আলাদা, এ যেন রবিন হুড তদন্তে নেমেছে। মিডিয়াকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে কাকে ডাকা হবে, কাকে ধরা হবে, কাকে কোন প্রশ্ন করা হবে, কার কাছ থেকে কী পাওয়া গেল, সব, সবটা জানে এপাড়ার ভজা ওপাড়ার হাবুল। খেয়াল করে দেখুন, ইডি কী করতে চলেছে, সিবিআই কাকে ডাকবে, সবটাই আপনি আগাম জানতে পারছেন মিডিয়ার থেকে, টেলিভিশনে যারা চোখে চোখ রেখে ক্ষমতার কাছে শিরদাঁড়া বেচে দিয়ে, সান্ধ্য আসরে টিআরপি বাড়ানোর জন্য নাটক করে, তাদের কাছ থেকেই ইডি এরপরে কেবল নয়, তারপরে কাকে কাকে ডাকবে সেটাও আপনি জানতে পারছেন। তাহলে প্রশ্ন তো উঠবেই যে এটা কি তদন্ত নাকি নাটক? যখন এই ইডি বা সিবিআই-এর ট্র্যাক রেকর্ড চেক করবেন, তখন এই নৌটঙ্কিটা আরও পরিষ্কার হবে। তাই আমরাও আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, এই যে সকাল থেকে সায়নী ঘোষকে ডাকা, মিডিয়ার ঠেলাঠেলি, ইডি অফিসারদের আনাগোনা, এর সবটাই কি বিশুদ্ধ নাটক নয়? আসলে কি আদৌ কোনও তদন্ত চলছে? আসুন দেখে নিই মানুষ কী মনে করেন।
দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চ থেকে হুমকি দিচ্ছেন বিরোধীদের জেলে পোরার। দেশ জুড়ে সিবিআই, ইডি বিভিন্ন ভিজেলেন্স এজেন্সি এবং রাজ্যপালেরা সেই কাজে নেমে পড়েছেন। এরসঙ্গেই ঢাকঢোল বাজিয়ে সেকথা, সেই ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে নেমেছে সংবাদমাধ্যম। দেশের ৮০ কোটি মানুষ বেঁচে আছে সরকারি বদান্যতার ওপর, ১০ কিলো আনাজের ওপর, দেশের ১ শতাংশ মানুষের কাছে আছে দেশের ৩৫ শতাংশ সম্পদ। দেশের বেকারত্ব চরম সীমায়, মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছে। আমাদের মিডিয়া সকাল থেকে আমাদের সায়নী ঘোষের ইডি হাজিরার আঁখো দেখা হাল জানিয়েই চলেছে। এমন অদ্ভুত আঁধার ছিল না আমার চারপাশে, আমার জন্মভূমিতে এত অন্ধকার তো ছিল না কোনওদিন।