কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: তখন রাজ্যে বাম জমানার মধ্য গগন। জন্ম হয়নি তৃণমূলের। বিজেপিই বা তখন কোথায়? রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। বিধানসভায় কংগ্রেসের। হল্লা ব্রিগেডের একটি মুখ সাধন পাণ্ডে। বিধানসভা কক্ষে সাধন পাণ্ডে থাকা মানেই হইহল্লা, চিৎকার, চেঁচামেচি।
রাজ্য রাজনীতিতে যেমন বর্ণময় চরিত্র ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তেমনি সাধন পাণ্ডেও কম বর্ণময় ছিলেন না। বিধানসভায় সুব্রত-সাধনকে সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতেন বাম জমানার অধ্যক্ষ হাসিম আবদুল হালিম। বিরোধী দলের সদস্য হয়েও সুব্রত-সাধন জুটিকে বেশ পছন্দ করতেন হালিম সাহেব। এমনও দিন গিয়েছে যে হইহল্লা করার জন্য সাধন পাণ্ডেকে অধ্যক্ষ হয়ত সারাদিনের জন্য সাসপেন্ড করেছেন। অথচ বিরতির সময় দেখা গেল, সাসপেন্ড হওয়া সত্ত্বেও সাধন স্পিকারের চেম্বারে তাঁর সঙ্গে খোশগল্পে ব্যস্ত। তখন কে বুঝবে যে, কিছুক্ষণ আগেই বিধানসভার ভিতরে অধ্যক্ষের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন সাধন। সুব্রতর মতো সাধনকেও বিশেষ পছন্দ করতেন প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
কংগ্রেসের রাজনীতিতে গোষ্ঠীকোন্দল সবসময়েই ছিল, আছে, থাকবে। এক এক নেতার এক এক গোষ্ঠী, সেই নেতাদের অনুগামীদের মধ্যেও নানা গোষ্ঠী। বলতে গেলে এটাই কংগ্রেসের কালচার। নেতারা প্রকাশ্যেই বলতেন বা এখনও বলেন, “কংগ্রেস করব, আর গ্রুপ করব না, এটা কংগ্রেসের কেউ ভাবতেই পারে না।” কংগ্রেসের এই গোষ্ঠী রাজনীতির কত কদর্য রূপ যে দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে দেখেছি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু দলটায় একটা প্রাণ ছিল। এক প্রবীণ সাংবাদিক বহু বছর আগে বলেছিলেন, রাজ্যে কংগ্রেসটা না থাকলে আমাদের জীবন মরুভুমি হয়ে যেত।
এখন আর রাজ্য কংগ্রেসে সে প্রাণ নেই, সেই বর্ণময় চরিত্ররাও আর নেই। কংগ্রেস ভেঙে গড়ে ওঠা তৃণমূলে সেই গোষ্ঠী রাজনীতি এখন জাঁকিয়ে বসেছে। বলা চলে, কংগ্রেসের ঐতিহ্যই বহন করে চলেছে তৃণমূল।
কী কংগ্রেস, কী তৃণমূল, সদ্য প্রয়াত সাধন পাণ্ডেও গোষ্ঠী রাজনীতির বাইরে ছিলেন না। কংগ্রেসে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে তীব্র বিরোধ ছিল উত্তর কলকাতার প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা প্রয়াত অজিত পাঁজা, মধ্য কলকাতার সোমেন মিত্র, দক্ষিণ কলকাতার সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। পরবর্তীকালে এই নেতারা তৃণমূলে যোগ দিলেও পারস্পরিক বিরোধ কিন্তু থেকেই গিয়েছিল। অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত সাধন পাণ্ডের সঙ্গে দলের অনেক বিধায়ক ও কাউন্সিলরের বিরোধের পরিণতিতে মারদাঙ্গাও হয়েছে বহুবার। এমনকী নেতানেত্রীদের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ ছিল।
আবার এই সাধন পাণ্ডেই যখন বিধানসভায় কোনও বিষয়ে ভাষণ দিতেন, তখন তাঁর পাণ্ডিত্য ধরা পড়ত প্রতি মুহূর্তে। বিধানসভায় একাধিক দিন তাঁর মূল্যবান ভাষণ শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। বরাবরই সোজাসাপটা কথা বলতে ভালবাসতেন সাধন। তাতে কে কী মনে করবে, তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না তিনি। ২০০৭ সালে যখন গোটা বাংলা সিঙ্গুর আন্দোলন নিয়ে উত্তাল, তখন বিধানসভার ভিতরে এবং বাইরে সাধনের অভিমত ছিল, এভাবে টাটাদের ন্যানো কারখানা বন্ধ করাটা তৃণমূলের পক্ষে ঠিক হচ্ছে না। এর জন্য দলের অন্দরে তাঁকে তিরস্কৃতও হতে হয়েছে। দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কিংবা কোনও সরকারি নীতি নিয়ে বেফাঁস মন্তব্যও করতে শোনা গিয়েছে তাঁকে বহুবার। ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে তা নিয়েও।
আরও পড়ুন: Anish Khan Murder: আনিস-কাণ্ডে হাওড়ার এসপিকে ভবানী ভবনে তলব
২০১১ সাল থেকে মন্ত্রিত্ব করেছেন দাপটের সঙ্গে। ক্রেতা সুরক্ষা বলে যে একটা দফতর আছে, সেই দফতরের কাজ যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তা অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দিয়েছেন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। দেখা হলে বা কথা হলে প্রায়ই বলতেন, “তোমরা সাংবাদিকরা আমার দফতরটা নিয়ে কিছু লেখ। আমার সম্পর্কে লিখতে হবে না। কিন্তু দফতরটা যে কী কাজ করছে, তা তো সাধারণ মানুষের জানা উচিত।” শোনা যায়, ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের এত যে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন, তার পিছনে মাথা ছিল খোদ মন্ত্রীর।
অসুস্থ ছিলেন বহু বছর ধরেই। কিন্তু কাউকে তা বুঝতে দেননি। ইদানিং বেশ কয়েক দফায় অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে থাকতে হয়েছে সাধন পাণ্ডেকে। গত বছর বিধানসভা ভোটে জিতে টানা নয়বার জয়ের রেকর্ড করেন তিনি। দফতর পেয়েও ফের অসুস্থ হন। সাধনের দফতর দেখতে বলা হয় সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে। এতদিনের প্রবীণ নেতাকে গুরুত্বহীন করতে চাননি দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষদিন পর্যন্ত সাধন ছিলেন দফতরবিহীন মন্ত্রী।
গত বছর চলে গিয়েছেন রাজ্য রাজনীতির এক বর্ণময় চরিত্র সুব্রত মুখোপাধ্যায়। মাস কয়েকের মধ্যেই চলে গেলেন আরও রঙিন চরিত্র।