আজ্ঞে না কোনও শক্ত শক্ত কথা নয়, খুব সহজেই পৃথিবীর রাজনীতির গতিপথ নিয়ে কিছু কথা আজকের চতুর্থ স্তম্ভে। দেখেছেন তো, গতিপথ শব্দটা শক্ত হয়ে গেল, বুঝিয়ে বলি। দুনিয়াজোড়া দেশগুলোর রাজনীতির কিছু কমন ফ্যাক্টর তো আছেই, কিছু আনকমন ফ্যাক্টরও আছে। কমন ফ্যাক্টর মানে ওই সাধারণ নির্বাচন, গণতন্ত্র, সাংবিধানিক শাসন ইত্যাদি। সেসবের সঙ্গে আছে বিকাশ, উন্নয়ন ইত্যাদি শব্দ। এবার সেই উন্নয়ন কাদের জন্য? মানে সেদেশের সরকারের নীতির ফলে কারা লাভবান? গরিবরা নাকি বড়লোকেরা। আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন যে ধ্যাত তা আবার হয় নাকি? কোন সরকার শুধু বড়লোকেদের জন্যই কাজ করে? করে, করে, সামনে রাখা হয় এক উন্নয়ন বা বিকাশের মডেল, বলা হয় গরিব আমজনতার কথা, কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে বড়লোক আরও বড়লোক হতেই থাকে, বৈষম্য বাড়তেই থাকে, এমনটা যে শুধু আমাদের দেশেই হচ্ছে তাও নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই হচ্ছে। সেখানে মডেল হল হাতে গোনা কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তৈরি করো, তাদের কাছে উজাড় করে দাও, বেচে দাও দেশের যাবতীয় সম্পদ, তারা ফুলে ফেঁপে উঠলে যেটুকু চুঁইয়ে পড়বে, তাতেই গরিবদের উন্নয়ন হবে। উদাহরণ? বিরাট ফ্যাক্টরি খোলা হল, ছোট বড় গাড়ি তৈরি হবে, বিরাট বিনিয়োগ, কেনা হল এক্কেবারে নয়া অটোম্যাটিক যন্ত্রপাতি, হাইলি স্কিল্ড জনা ১০০ মানুষই যথেষ্ট সেই ৩০০০ কোটি টাকার ফ্যাক্টরি চালাতে, মাসে মাইনে ২ কি ৩ কি ৪ লক্ষ টাকা। এরপর কিছু মুটে মজুর, বেয়ারা। মাইনে? ৮ কি ১০ কি ১২ হাজার টাকা। হল তো উন্নয়ন। ৩০০০ কোটি টাকার ২৫০০ কোটি বিভিন্ন ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ, সস্তায় নামমাত্র দামে জমি, বিদ্যুৎ, জল। কারণ, ওই যে উন্নয়ন হবে। গাড়ি তৈরি হওয়ার আগেই লাভের কড়ি ঘরে। হ্যাঁ, এটাও হয় সেই দেশের সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। একটা মডেল হল বেশিরভাগ মানুষের হাতে সম্পদ তুলে দেওয়া, তাদের মজুরি বৃদ্ধি, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা। হ্যাঁ, এক গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারও এই কাজ করতে পারে, বিশাল সংখ্যক গরিব আমজনতাকে তাদের দারিদ্রের সীমারেখা থেকে বের করে আনতে পারে। কমন ফ্যাক্টর এগুলোই। তাহলে একটা মডেল হল, দেশে নির্বাচন আছে, নির্বাচিত সরকার আছে, একটা সংবিধান আছে, মুক্ত স্বাধীন সংবাদমাধ্যম আছে, বাক স্বাধীনতা আছে, একজন সাধারণ মানুষের বড় হয়ে ওঠার স্বাধীনতা আছে, ধর্মের ভিত্তিতে, বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য নেই। বিজ্ঞান, গবেষণার অগ্রগতিতে কোনও বাধা নেই। বহুস্বর বরকরার। অন্য মডেলটা হল, নির্বাচনের মাধ্যমে এসেই সংবিধানকে বাইপাস করে এক নতুন ব্যবস্থার কথা বলা। ধনী আর ক্ষমতাবানদের এক কোটারি তৈরি করা। অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকা। জঙ্গি জাতীয়তাবাদকে ভর করে এক উন্মাদনা তৈরি করা। গরিব, সাধারণ মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ক্রমশ হাতের নাগালের বাইরে যেতে থাকা। দেশের রাষ্ট্রনেতা ক্রমশ হয়ে উঠতে থাকেন এক কাল্ট, একজন স্বঘোষিত আইকন। তাঁর বিরোধিতাকেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করা। মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণাকে উসকে দেওয়া, প্রাচীন ঐতিহ্যের নামে, ধর্মের নামে দেশের মানুষকে ভাগ করা। এই দ্বিতীয় মডেলটাকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দক্ষিণপন্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর প্রথম মডেলকে হয় বাম না হলে মধ্যপন্থা বলা হয়। বাম আর মধ্যপন্থার ফারাকটা পুঁজি, বিনিয়োগ, মুনাফা, আম আদমির হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা, তাদের উন্নয়ন ইত্যাদিকে নিয়ে। তবুও যে কোনও সময়ে দক্ষিণপন্থা থেকে মধ্যপন্থা ভাল, লেসার ইভিল যাকে বলা হয়। মধ্যপন্থায় সংবিধান অক্ষত থাকে, বাক স্বাধীনতা থাকে, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ তো থাকে, তাই দক্ষিণ পন্থার থেকে মধ্যপন্থা ভাল, ট্রাম্পের থেকে ওবামা বা বাইডেন ভাল। তাহলে রাজনৈতিক চরিত্র অনুযায়ী পৃথিবীতে যেসব দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়, অন্তত সেটুকু গণতন্ত্র আছে, সেই সব দেশগুলো বাম, মধ্য আর দক্ষিণপন্থায় চলে। এবং অবাক করা তথ্য হল, একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে একই ধরনের রাজনৈতিক বদল, রাজনৈতিক চরিত্র দেখা যায়। অলৌকিক কিছু নয়, বিভিন্ন কারণেই এটা হয়। মাথায় রাখুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হচ্ছে, বা শেষ হয়ে যাওয়ার ক’বছরের মধ্যেই সারা বিশ্বে বেশ কিছু ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ কলোনি স্বাধীন হয়ে গেল, আমাদের দেশও। আবার ওই একই সময়ে লাল হয়ে গেল পূর্ব ইউরোপ, কিছুদিন পরে মাওয়ের নেতৃত্বে চীনের বিপ্লব। আবার মধ্য ষাটে প্যারিস থেকে রেঙ্গুন থেকে কলম্বো থেকে কলকাতা থেকে মাদ্রিদ, ভেনিজুয়েলার ক্যারাকাসে ছাত্র আন্দোলন, একই স্লোগান, পাওয়ার পাওয়ার, স্টুডেন্ট পাওয়ার। ওই একই সময়ে পৃথিবীজুড়েই বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবী বাম, উগ্র বাম, জঙ্গি বাম যা বলবেন বলুন, তাদের খবর প্রথম পাতা জুড়ে, আমাদের দেশও বাদ নয়। আবার ৭৪/৭৫ এ আমাদের উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রা, সমস্ত বিরোধী দলের নেতাকে জেলে পুরে ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরশাসন, বাংলাদেশে সব দল তুলে দিয়ে বাকসালের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, ওদিকে শ্রীলঙ্কার রাস্তায় তামিলদের ওপর গুলি চলছে। হ্যাঁ, বিভিন্ন কারণেই পৃথিবীর রাজনৈতিক ঘটনা বেশ কিছু জায়গায় এক খাতে বইতে থাকে। যেমন ধরুন, ওবামার পরে ট্রাম্পের উঠে আসা, অনর্গল মিথ্যে এবং বাজে বকতে থাকা এক জোকার হঠাৎই রাষ্ট্রের প্রধান, এবং তারপর থেকেই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অসংখ্য সাধারণ মানুষের কাজ চলে যাওয়া, বর্ণবিদ্বেষ বেড়ে ওঠা হতে থাকল। এদিকে ভারতবর্ষে মধ্যপন্থার অপদার্থতার সুযোগ নিয়ে উঠে আসলেন মোদি, বিজেপি-আর এস এস। একইভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হল, সংবিধানকে বাইপাস করে যা ইচ্ছে তাই চলতে থাকল, ধর্মের নামে মানুষকে পিটিয়ে খুন করা হল। ওই একই সময়ে ব্রাজিলে এলেন বলসেনারো, তাঁর বন্ধুরা পৃথিবীর ফুসফুস অ্যামাজনের জঙ্গল কেটে সাফ করতে থাকল, চাকরি আর সামাজিক সুরক্ষা উবে গ্যালো কর্পূরের মতো, এবং বাজে বকায়, মিথ্য বলায় তাঁর জুড়িদার বিশ্বে নরেন্দ্র মোদি ছাড়া আর কেউ নেই। ঠিক এই সময়ে ইউকে-তে আরেক দক্ষিণপন্থার উদয় বরিস জনসন এলেন সামনে। রোজ গিমিক, আজ মেট্রোতে করে যাচ্ছেন তো কাল সাংবাদিকদের নিজের হাতে চা পরিবেশন করছেন, ওদিকে চাকরি নেই, অর্থনীতি তলানিতে। একই সময়ে ঘটে চলেছে এই সব ঘটনা। ট্রাম্প আবার জিতবেন অনায়াসেই, বহুলোক ভেবেছিলেন, মোদিজি তো বলেই দিয়েছিলেন অবকি বার ট্রাম্প সরকার, অথচ ট্রাম্প শুধু হারলেন না, ভয়ঙ্করভাবেই হারলেন। ওদিকে জনসনের ঘণ্টা বেজে গেল, এখন ইউকে-তে রাজনৈতিক ডামাডোল চলছে বললেও কম বলা হয়। ৪০-৪৫ দিনে সরকার পড়ে যাচ্ছে, সুনকের সরকার কদিন টেকে, সেটা দেখার ব্যাপার। এরই মধ্যে ব্রাজিলের মানুষ বলসোনারোকে সরিয়ে দিয়ে এক শ্রমিক নেতাকে, সে দেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা লুইজ ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা, লুলাকে বেছে নিলেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। এর আগেও দুটো টার্ম তিনি রাষ্ট্রপতি থেকেছেন, ব্রাজিলের শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে খরচ হয়েছে বিরাট টাকা, সেই কাজের কথা মাথায় রেখেই সাও পাওলোর রাস্তায় লাল ঝান্ডা দুলছে। জেতার পরে লুলা বলেছেন, কেবল ওয়ার্কার্স পার্টিই নয়, কেবল তাঁর সমর্থক কমিউনিস্ট পার্টি নয়, তাঁর সরকারে এমনকী দক্ষিণপন্থী দলের মানুষজনকেও নেওয়া হবে, নতুন ব্রাজিল গড়ে তোলা হবে। আগমার্কা বিপ্লবীরা এই বক্তব্যের মধ্যে অনেক ভুল দেখতে পাবেন, পাচ্ছেনও, কিন্তু দুনিয়াজোড়া দক্ষিণপন্থা যে পিছু হটছে, সেটা জলের মতো পরিষ্কার। এবং এই দক্ষিণ পন্থার সবথেকে বড় কমন ফ্যাক্টর হল জঙ্গি জাতীয়তাবাদ আর তাকে ঘিরেই নাগরিকত্ব আইন, প্রবাসীদের জন্য আইনে এক উগ্র জাতীয়তাবাদ ঢুকিয়ে দেওয়া। একই জিনিস হয়েছে ট্রাম্পের সময়ে, মেক্সিকো থেকে নাকি ইঁদুরের মতো অবৈধ অনুপ্রবেশ চলছে, তাই মেক্সিকো-আমেরিকা বরাবর পাঁচিল তোলা হবে, তাকে বলা হল ট্রাম্প ওয়াল। বরিস জনসন আর বলসেনারোও এই একই অবৈধ অনুপ্রবেশের নাম করে এক ধরনের জিঙ্গোইজমকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। ফল? রাস্তায় কালো লোক দেখলে মারো, দাড়ি, পাগড়ি দেখলে মারো। তাকিয়ে দেখুন ভারতবর্ষের দিকে। নাগরিকত্ব নিয়ে আগুন খেলা খেলছে এই আরএসএস–বিজেপি। কিন্তু দুনিয়াজোড়া রাজনৈতিক পরিবর্তন এক অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে, দক্ষিণপন্থার সাময়িক বাড়বাড়ন্ত শেষ, এবার পিছু হঠছে দক্ষিণপন্থা, সরে যাচ্ছেন বরিস জনসন, বোজো। হেরে যাচ্ছেন ট্রাম্প, হেরে যাচ্ছেন বলসোনারো। এসব দেশের মানুষের কিছুদিন আগেও মনে হয়েছে, এ অমানিশা বোধহয় আর কাটবে না, তাকিয়ে দেখুন ব্রাজিলের দিকে, সাও পাওলোর রাস্তায়, হলুদ সবুজ জাতীয় পতাকা আর লাল পতাকা হাতে নিয়ে রাজপথে মানুষ। দেওয়ালে আগুনের বর্ণমালা খুব স্পষ্ট, দক্ষিণপন্থা হারছে, হারবে, ট্রাম্প, জনসন, বলসোনারো গেছে, মোদিজিও যাবেন, বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে, হবেই।