শিব্রাম চক্কোত্তির সেই গল্পটা তো আপনাদের জানাই আছে। এক হেঁপো আর এক কেশো একই কামরায় রেলযাত্রা করছিল, হেঁপো হাওয়া কম হলে হাঁপায়, হাওয়া লাগলে কেশো কাশতে থাকে। সেই পুরনো দিনে রেল কামরার বাল্ব হয় জ্বলত না, না হলে থাকতই না। অতএব ঘুটঘুটে অন্ধকারে একজন জানলা খুলে দেয়, অন্য জন ঝড়াম করে জানলা বন্ধ করে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিৎকার, বেশ খানিকক্ষণ ধরে ওই ঝড়াম ঝড়াম চলার পরে দুজনেই একসঙ্গে চেন টানল, ট্রেন থামল। টিকিট চেকার আর পুলিশ এল, সব শুনে জানলায় টর্চের আলো ফেলে দেখে সে জানলার কাঁচ হয় ছিলই না, বা ওই ঝড়াম জড়ামের মধ্যে কখন ভেঙে পড়ে গেছে, কিন্তু জানলা খোলা আর বন্ধ করা নিয়ে কাজিয়া চলছে তো চলছে। আমাদের দেশে ইদানীং সংরক্ষণ নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, তা খানিকটা ওই রকমই। চাকরি কোথায় তার ঠিক নেই, চাকরির কত পার্সেন্টেজ কে পাবে, তাই নিয়ে কলতলার বৈঠকে কী তুমুল বিতর্ক। আপাতত বিতর্ক কী নিয়ে? নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০১৯-এ ভোটের ঠিক আগে লোকসভায় সংরক্ষণ নিয়ে এক বিল আনে, ইকোনমিক্যালি উইকার সেকশনের জন্য ১০% চাকরি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের বিল। ৮ জানুয়ারি ২০১৯ এই বিল আনা হয়, ৯ জানুয়ারি লোকসভায় পাস করানো হয়, ১০ তারিখে রাজসভায় পাস হয়ে যায়, ১৪ জানুয়ারি এই বিল রাষ্ট্রপতির কাছে যায়, রামনাথ কোবিন্দ পিছিয়ে পড়া অনুসূচিত জাতির মানুষ, তিনি কোনও প্রশ্ন না করে এই বিলে সই করে দেন। মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, উচ্চবর্ণের হিন্দু ভাইয়েরা, আমরা তোমাদের জন্যও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দিলাম। সংরক্ষণ রইল এসসি, এসটি, ওবিসিদের জন্য, এবার উচ্চবর্ণের জন্যও সংরক্ষণ হল। চাকরি কোথায়? সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোথায়? সে সব তো কমছে, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে প্রাইভেট মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, টাকা দিলেই ভর্তি হওয়া যায়, আমাদের দেশের টাকা আছে কাদের? বরং উল্টো করে প্রশ্নটা রাখি, টাকা নেই কাদের? গরিব কারা? দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি গরিব মানুষ এসসি, এসটি, ওবিসি সম্প্রদায়ের। মানে ওই যে হাজারে হাজারে মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ইত্যাদি খুলছে, আইএএস, আইপিএস ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য যে কোচিং সেন্টার তৈরি হয়েছে, জয়েন্ট, নেট, স্লেট পরীক্ষার জন্য যে অসম্ভব দামি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, তার ১০০ শতাংশ সংরক্ষিত বড়লোকেদের জন্য, ১০০ শতাংশ। তারা কারা? দেশের ২০ শতাংশ মানুষ। এদের ঘরের ছেলেমেয়েরাই উচ্চশিক্ষা পাবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে, জাজ, ব্যারিস্টার, ডিএম, এসপি হবে। দু’ একজন ব্যতিক্রমও থাকবে, তাদের নিয়ে খবর হবে, লেগে থাকো ভায়া তোমারও হবে, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন। এসব নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই, কেবল ভোট, কেবল নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে একটা বিল পাস হয়ে গেল ছ’ দিনে। বিল পেশ করেছিলেন সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন দপ্তরের মন্ত্রী থাওর চাঁদ গেহলট, এখন কর্নাটকের রাজ্যপাল। স্বাধীন ভারতবর্ষে সংরক্ষণ এক রাজনৈতিক ইস্যু, নির্বাচনের ইসু, ক্ষমতায় থাকার সূত্র, কিন্তু যখন দেশ স্বাধীন হচ্ছে? যখন সংবিধান তৈরি হচ্ছে, তখন তো সেটা ভোটের ইস্যু ছিল না। সেদিন সংরক্ষণ নিয়ে কেমন আলোচনা হয়েছিল? কারা করেছিলেন সেই আলোচনা, নাকি আলোচনাই হয়নি ২০১৯-এর মতো চট মাঙ্গনি পট ব্যাহ-এর মতো হয়েছিল, ৮ তারিখে বিল পেশ, ৯ জানুয়ারি লোকসভায়, ১০ জানুয়ারি রাজ্যসভায়, তারপর ১৪ তারিখে রাষ্ট্রপতির সই। এমনই কি হয়েছিল সেদিন? অ্যাডভাইজারি কমিটি অন মাইনরিটিজ তৈরি হয়েছিল বহু আগেই, তার চেয়ারম্যান ছিলেন বল্লভভাই পাটেল, সাবকমিটি তৈরি হয়েছিল, তাতে ছিলেন জওহরলাল নেহরু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, বি আর আম্বেদকর, আর কে এম মুন্সি। ২৭ আগস্ট, বল্লভভাই প্যাটেল সংবিধান সভায় এই রিপোর্ট পেশ করেছিলেন। বহু বিতর্ক হয়েছে, ১৯৪৯-এর ১৪ অক্টোবরেও সেই বিতর্কের কার্যবিবরণী আছে, অসংখ্য মানুষ পক্ষে আর বিপক্ষে তাঁদের বক্তব্য রেখেছেন, তর্ক হয়েছে শিক্ষা, চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ সমানতার অধিকার হনন করবে কি না, এসসি বা এসটি, পিছিয়ে পড়া মানুষের সংরক্ষণ কেন জরুরি তা নিয়ে চুলচেরা বিতর্ক হয়েছে, সাধারণ মানুষ থেকে সমাজের সব অংশের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে রায় নেওয়ার পরে জানানো হয়েছে সংবিধানের মূল ধারণা, সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ অধ্যায়ের মৌলিক অধিকার এক সমানতার ধারণা দেয়, যা বলে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, বাসস্থান, ভাষা বা অর্থের ভিত্তিতে যে কোনও রকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে। অনেকেরই ধারণা এসসি এসটি বা ওবিসি সংরক্ষণ জাতির আধারে হয়। একেবারেই না। বিভিন্ন আর্থিক মাপকাঠি, শিক্ষাগত মাপকাঠির ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষজনকে চিহ্নিত করা হয়, ধরা যাক দুসাধ, এই গোষ্ঠীর মানুষজনদের ৯৩ শতাংশ আর্থিক বা শিক্ষার মাপকাঠিতে ঐতিহাসিকভাবেই পিছিয়ে আছে, তাই দুসাধদের এসসি ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে, এভাবেই এসসি এসটি ওবিসি চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবেই যাদের শিক্ষার অধিকার ছিল না, যাদের প্রভুদের দাস হিসেবেই জীবন কাটিয়ে দেওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক তাদের জন্য শিক্ষা এবং চাকরিতে সংরক্ষণের কথা বলেছে আমাদের সংবিধান। এটাও ঘটনা যে উচ্চবর্ণের মধ্যেও দারিদ্র আছে, কিন্তু তাদের সুযোগের অভাব কোনওদিনও ছিল না, সুযোগের অভাব ছিল এই সব এসসি এসটি ওবিসিদের যাদের কুয়োর জল পর্যন্ত খেতে দেওয়া হত না, পাঠশালায় ঢুকতে দেওয়া হত না, বেগার মজুরি দিতে হত, বিনি পয়সার শ্রম, তারপরেও জুটত অত্যাচার, অবর্ণনীয় অত্যাচার। তাদের কথা ভেবেছিলেন সংবিধান প্রণেতারা, ভোট নয়, নির্বাচন তাদের বিবেচনায় ছিল না। তাই প্রায় তিন বছর ধরে বিভিন্ন সার্ভে, বিভিন্ন কমিটিতে মানুষের সাক্ষ্য নিয়ে, সংবিধান সভায় দিনের পর দিন বিতর্কের পরে সংবিধান প্রণেতারা জাতি নয়, সামাজিক, শিক্ষাগত পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য সংবিধান এ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। হ্যাঁ বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে নেহরু, আম্বেদকর, রাজেন্দ্র প্রসাদ, কে এম মুন্সি প্রমুখ এই সংরক্ষণের পক্ষে ছিলেন। এমনকী যে সেদিনও এই আর্থিক অবস্থা, মানে কেবল বড়লোক বা গরিব লোকের ভিত্তিতে সংরক্ষণের কথা আসেনি? এসেছিল, বিতর্কও হয়েছিল, কিন্তু তা অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। আজ এতদিন পরে ২০১৯-এ একটা বিল আনল মোদি সরকার, কোনও সার্ভে? কোনও কমিটি? কোনও আলোচনা? কোনও বিতর্ক? কীসের বেসিসে বলা হবে যে একটি মানুষ দরিদ্র, তা নির্ধারণ করার ভিত্তি কী হবে? ওনাদের যা মনে হল তাই লিখে দিলেন, জমি ৫ একরের কম হতে হবে? রাজস্থানে ৫ একর জমির দাম কত? বহু জায়গায় ৫ লক্ষ টাকাও নয়, বর্ধমানের গ্রামে কিছু জায়গায় ৫ একর মানে ১৫ বিঘে জমির দাম দুই কি আড়াই কোটি টাকার কম নয়। তাহলে ভিত্তিটা কী? কোনও ভিত্তি নেই, কারণ কোনও সার্ভে করা হয়নি। তাহলে? তাহলে এটা আসলে এক বিশুদ্ধ তামাশা, এক নির্বাচনী প্রচার মাত্র। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়ে জানালেন সব ঠিক হ্যায়, ৫ জনের বেঞ্চের তিনজন হ্যাঁ বললেন, দুজন না বললেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিলের পক্ষে রায় গেল বটে, কিন্তু বহু প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল। আর্থিক বিচারে চাকরি কি আমাদের মৌলিক অধিকার, সমানতার অধিকারের বিরুদ্ধে নয়? এই সুপ্রিম কোর্টের ৮ জন বিচারকের বেঞ্চ ১৯৯২-তে বলেছেন সংরক্ষণ যেন ৫০ শতাংশ পার না করে যায়, এখন এসসি, এসটি, ওবিসি নিয়ে ৪৯.৫ শতাংশ সংরক্ষণ আছে, যোগ হল ১০ শতাংশ, মোট দাঁড়াল ৫৯.৫ শতাংশ। তাহলে? আবার মামলা? তাতে মোদি–শাহের কিচ্ছুটি এসে যায় না, কারণ ওঁরাও জানেন চাকরিই নেই, সব থেকে বড় চাকরির জায়গা রেলে শূন্যপদ ভর্তি না করার অলিখিত সিদ্ধান্তের কথা আমরা জানি, আর সেনাবাহিনীতে তো সবটাই ক্যাজুয়াল, চাকরি নয়, চুক্তির ভিত্তিতে মাইনে। কিন্তু তাঁরা জানেন এই সংরক্ষণের কথা বলে খচে যাওয়া উচ্চবর্ণের কিছু মানুষকে তাঁরা পেলেও পেতে পারেন, তাই বিল এসেছে, বিল পাস হয়েছে, এখন সুপ্রিম কোর্টের সিলমোহরও পেল, কলতলার ঝগড়া চলুক, মাঝখান থেকে নির্বাচনী অস্ত্র পেয়ে গেল বিজেপি।