সত্য খুঁজতে এসেছেন রবিশঙ্কর প্রসাদ অ্যান্ড কোম্পানি। বিজেপির একদল নেতা নির্বাচনের পরে এ রাজ্যে হিংসার সরেজমিন তদন্ত করতে বাংলায় এসেছেন দফায় দফায়, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি, তাঁরা হিংসার পিছনের সত্য খুঁজে বার করবেন। নির্বাচনে হিংসা হয়েছে, শাসকদল হিংসায় ইন্ধন জুগিয়েছে, বিরোধী দলের কর্মীরাও সেই হিংসায় অংশ নিয়েছেন। আমাদের হিসেব মতো বিভিন্ন দলের ৫২ জন মারা গিয়েছেন, যাদের মধ্যে এক বড় অংশ, প্রায় ৩২ জন তৃণমূল কংগ্রেসেরই। কিন্তু যেই মরুক তার দায় তো রাজ্য সরকারকেই নিতে হবে, এর আগে ৭০ জন মরেছিল এবার তো ৫২, এরকম ইনসেন্সিটিভ যুক্তির কোনও অর্থ নেই। এসব সত্যি। কিন্তু এটাও সত্যি যে আমাদের রাজ্যের কিছু অঞ্চলে নির্বাচনী হিংসার একটা ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাস মেনেই এবারেও মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ইত্যাদি জায়গায় হিংসা হয়েছে, এই হিংসা বন্ধ হওয়া উচিত। এরকম ঘটনা ঘটলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা মানবাধিকার সংগঠন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি পাঠায়, সরকার জুডিসিয়াল এনকোয়ারি করায়। এসব তো মৃত মানুষদের প্রাণ ফিরিয়ে দেয় না, কিন্তু এই হিংসার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা যায়, এই হিংসার কারণ খুঁজে বার করা যায়, ভবিষ্যতে যাতে হিংসা না হয় তার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যায়, এক জনমত তৈরি করা যায়, এগুলো সবই সত্যি। সেই জন্যই কি বিজেপি তার নেতাদের পাঠিয়েছে, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি বানিয়ে পাঠিয়েছে বাংলায়? সেটাই বিষয় আজকে, সত্য খোঁজার নামে বিজেপির সীমাহীন ভণ্ডামি।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী হিংসার তদন্ত হওয়া উচিত? নিশ্চয়ই উচিত, সমস্ত হত্যার তদন্ত হওয়া উচিত, সমস্ত উসকানিমূলক কথাবার্তার তদন্ত হওয়া উচিত। বিশেষ করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর উক্তি, “এমন অবস্থা তৈরি করুন যাতে ৩৫৫ ধারা লাগু করা যায়” এই উক্তির তো তদন্ত হওয়াই উচিত। একজন বিরোধী দলনেতা বলছেন যে রাজ্যে এমন অশান্তি দাঙ্গা হাঙ্গামা লাগানো হোক যাতে করে রাজ্যে ৩৫৫ ধারা লাগু করা যায়। এমন মারাত্মক উসকানিমূলক কথাবার্তার তদন্ত তো করাই উচিত, তদন্তের আগে ওঁকে গ্রেফতারও করা উচিত। কিন্তু এর মানে আবার এরকমও নয় যে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যে নির্বাচনী খুনোখুনি হয়েছে, রাজ্য সরকারের তার দায় নেই, আছে বইকী। তার জন্য রবিশঙ্কর প্রসাদ এসেছেন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি নিয়ে, তিন-চারদিন বাংলার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখেছেন, রিপোর্ট তৈরি করেছেন, বেশ করেছেন। আমাদের প্রশ্ন, আপনার দল, বিজেপির কি চোখে ন্যাবা হয়েছে? মণিপুরে ৮৪-৮৫ দিন ধরে দাঙ্গা চলছে, দেড়শোর বেশি মানুষ খুন হয়েছে, ৪০০-র বেশি মানুষ গুরুতর আহত। নারীদের গণধর্ষণ করা হয়েছে, নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়েছে, ৬০ হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আর্মারি লুঠ হয়েছে, পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে মানুষকে খুন করা হয়েছে, ২৫০-র বেশি উপাসনালয় ভাঙা হয়েছে, এসব কিছুই চোখে পড়ছে না?
আরও পড়ুন: Aajke | কংগ্রেস বাম ঐক্য থাকবে?
বিজেপির কোন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম মণিপুরে গিয়েছে? ক’দিনের জন্য গিয়েছে? কী রিপোর্ট দিয়েছে? চালুনি বলে সুচ রে তোর পিছনে কেন ফুটো? এতবড় ভণ্ডামি করা যায়? একটা রাজ্য জ্বলছে, প্রধানমন্ত্রী কোনও কথা বলছেন না, সংসদে বিবৃতি দেওয়ার সাহস নেই। সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চুপ করে বসে দাঙ্গায় ইন্ধন জোগাচ্ছেন, দুই নারীকে নগ্ন করে প্যারেড করানোর ঘটনায় কেন কিছু করা হয়নি, এই প্রশ্নের উত্তরে নিজেই জানিয়েছেন এ ধরনের শ’খানেক ঘটনা ঘটেছে। সেই মুখ্যমন্ত্রীর দল, বিজেপি এই রাজ্যে হিংসার ফ্যাক্ট ফাইডিং করতে এসেছে? এতটা নির্লজ্জ হওয়াও যায়? এরকম জাতি দাঙ্গা, এরকম ধর্মের ভিত্তিতে দাঙ্গা, মানুষের বিভাজন এবং খুনোখুনির ইতিহাস আছে একমাত্র বিজেপির, নরেন্দ্র মোদির। ওঁর মডেল হল গুজরাত, ওঁর মডেল হল বিলকিস বানো, সেই মডেল সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ যারা কাঁধে তুলে নিয়েছে তারা এসেছে বাংলায় সত্য খুঁজতে? আমরা প্রশ্ন করেছিলাম আমাদের দর্শকদের, ৮৪-৮৫ দিন ধরে মণিপুর জ্বলছে, মানুষ খুন হচ্ছেন, নারীরা গণধর্ষিতা হচ্ছেন, মানুষ ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে, সেই রাজ্য নিয়ে একটা কথা না বলে বিজেপি এই রাজ্যের হিংসার হিসেব নিতে এসেছে, এটা কি এক ধরনের নোংরা রাজনীতি নয়? শুনুন মানুষ কী বলছেন।
সারা দেশেই হিংসা, খুন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সে সব ঘটনাতে অনেক সময়েই প্রশাসনিক, পুলিশি গাফিলতি থাকে, সরকারি দলের নেতাদের প্ররোচনাও থাকে। হাথরসে ঘটনা ঘটে, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, বাংলা বা বিহারে হয়, খোদ দিল্লিতেও নির্ভয়া কাণ্ড বা আরুষি হত্যার ঘটনা আমরা দেখেছি, কিন্তু সেগুলো হয় রাজনৈতিক নাহলে সামাজিক অপরাধ। গুজরাতে যা হয়েছে, কাশ্মীরে যা হয়েছে, অসমে যা হয়েছে বা মণিপুরে যা হচ্ছে তা ধর্মের ভিত্তিতে, জাতির ভিত্তিতে দাঙ্গা, স্টেট স্পনসর্ড রায়ট। সেই রাষ্ট্রের নির্দেশে মানুষ খুন, দাঙ্গা, ধর্ষণ চলছে মণিপুরে, সেখান থেকে চোখ ঘোরানোর জন্য বিজেপির এরকম ঘৃণ্য চক্রান্ত বিজেপিকেই জনবিচ্ছিন্ন করবে।