বিরাট পর্ব শেষ, মধ্যে কিছুটা সময়, পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাস শেষ করে বিরাট রাজার আতিথ্যে আছেন, সেখানেই অভিমন্যুর বিয়ে, বিভিন্ন দেশের রাজারাজড়ারা এসেছেন। পাণ্ডবরা ফিরে পেতে চাইছেন তাঁদের রাজত্ব, হস্তিনাপুর। পেছনে আছেন কৃষ্ণ, তিনিই ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, পাণ্ডবদের বলছেন, সামনে যুদ্ধ, সমর্থন জোগাড় করো, অস্ত্র জোগাড় করো। অজ্ঞাতবাসের সময়ে অর্জুন যে অস্ত্র জোগাড় করেছিলেন, যা লুকনো ছিল শমীবৃক্ষে, তা তো এখন হাতেই, কিন্তু আরও অস্ত্র চাই। আচ্ছা কৌরবরা কি এই উদ্যোগপর্ব, এই প্রস্তুতির কথা জানত না। কিছুদিন পরেই শুরু হবে ভীষ্ম পর্ব, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মুখোমুখি পাঁচ ভাই, অন্যদিকে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য। যুদ্ধ যে হবে তা জানত কৌরবরাও। জানতেন দুর্যোধন, জানতেন শকুনি, কর্ণ, দুঃশাসন। জানতেন এবং এই যুদ্ধকে থামানোর চেষ্টা করছিলেন বিদুর, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য। কাজেই কৌরবপক্ষেও এক প্রস্তুতিপর্ব চলছিল, সেনা, অস্ত্র জোগাড় করার, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্যদের দলে রাখার, শ্রীকৃষ্ণের ১৮ লক্ষ অক্ষৌহিনী সেনার দিকেও নজর ছিল দুর্যোধনের। মোদ্দা কথা কৌরবপক্ষেও প্রস্তুতি চলছিল। তাই তো মহাভারতের সব থেকে বড় পর্ব হল এই উদ্যোগপর্ব। আজকের মহাভারতের রাজনীতির দিকে তাকালেই এটাও পরিষ্কার হবে, সেই প্রস্তুতিপর্ব চলছে। গতকাল বলেছিলাম বিরোধীদের প্রস্তুতিপর্বের কথা, আজ শাসক দল বিজেপি, তার মাথার ওপর বসে থাকা সংগঠন আরএসএস-এর প্রস্তুতি পর্বের দিকে তাকানো যাক। প্রথমে আসি আরএসএস-এর কথায়। তারা রাজনীতিকে সমাজের সঙ্গে মিশিয়ে এক ককটেল বানায়, সেখানে খুব সূক্ষ্ণ রাজনীতির চাল দিতে থাকে, সেগুলো ভালভাবে না দেখলে মনে হবে কথামৃত পাঠ চলছে। আসলে যে তীব্র বিষ তারা ছড়ায়, ছড়াচ্ছে তা বুঝতে একটু সময় লাগে বইকি। খেয়াল করুন, দেশের চার দিকে গোহত্যা, গরুর মাংস বিক্রি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে মানুষ পিটিয়ে মারা হচ্ছে, কিছু মানুষজন তাদের মাথায় গেরুয়া ফেট্টি, তারা স্রেফ পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলছে। আরএসএস সরসংঘচালক বললেন, গোহত্যার নামে হিংসা বন্ধ হোক, আমরা গরুকে মা বলেই জানি, আমরা গোমাতার পুজো করি, কিন্তু তা নিয়ে হিংসা উচিত নয়। এই হিংসা এক ক্রিমিনাল অ্যাক্ট, অপরাধ, একে আটকানোর বা কথা বলার দায় ছিল নরেন্দ্র মোদির, তিনি চুপ। সরসংঘচালক মনে করিয়ে দিলেন, আমরা গোমাতার পুজো করি, আমরা গরুকে মা বলি। কারা? আমরা হিন্দুরা। মানে, কারা গরু পুজো করে না? কারা গরু কাটে? মুসলমানরা। কার্যকারণ ব্যাখ্যা করে দিলেন। সাফ জানিয়ে দেওয়া, তোমরা গরু কেটো না, আমরা পিটিয়ে মারব না। এটাই আরএসএস। আসছে লোকসভার নির্বাচন, হয় এসপার নয় ওসপারের লড়াই। কেবল উচ্চবর্ণের সমর্থনে চলবে না, কেবল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যদের সমর্থনেই চলবে না, দরকার দেশের গরিষ্ঠাংশ নিম্নবর্ণের মানুষজনদের সমর্থন, তাঁদেরকে এক ব্র্যাকেটে আনতে হবে। হিন্দু ব্র্যাকেটের মধ্যেই আনতে হবে ওই অবহেলিত, শোষিত নিম্নবর্ণের মানুষজনদের। সরসঙ্ঘচালক বললেন, জাতি ভেদাভেদ অতীতের ব্যাপার, এখন সবাই সমান। এখন সবাই হিন্দু। মেসেজ ক্লিয়ার অ্যান্ড লাউড, হিন্দু খতরে মে হ্যায়, অতএব হিন্দু একতা দরকার, হিন্দু ভোট এক জায়গাতে আসা দরকার। আরএসএস-এর প্রার্থনা, “নমস্তে সদা বৎসলে মাতৃভূমে ত্বয়া হিন্দুভূমে সুখং বর্ধিতেহহম্।” অনুবাদ– হে সন্তানদের প্রতি স্নেহময়ী মাতৃভূমি, তোমাকে নিরন্তর প্রণাম করি। হে হিন্দুভূমি, তোমার দ্বারা আমি সুখে প্রতিপালিত হই। হ্যাঁ হিন্দুভূমি। হিন্দু কারা? যারা বেদ উপাসক। যে বেদের চতুর্বণের কথা বলা আছে, বলা আছে ব্রাহ্মণ মগজ থেকে, ক্ষত্রিয় স্কন্ধ অর্থাৎ কাঁধ থেকে, বৈশ্য জানু থেকে আর শূদ্র পদতল থেকে সৃষ্ট। যে শূদ্রদের বেদপাঠ নিষিদ্ধ। আরএসএস আপাতত সেই শূদ্রদের এক ব্র্যাকেটে এনে ভোট শতাংশ বাড়াতে চাইছে। প্রস্তুতিপর্বের শুরুতেই সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত এই কাজটা সেরে রাখতে চাইছেন। নির্বাচনের দিন যত কাছে আসবে, তিনি তত জোরে এই জাতিপ্রথার বিরুদ্ধে বলবেন, জাতিপ্রথার অবসান নয়, আসলে ভোট শতাংশ বাড়ানোটাই তাঁর লক্ষ্য।
এবার আসুন সরাসরি রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির দিকে। রাজ্যে রাজ্যে ভিজিলেন্স, সিবিআই, ইডির হানা, আইন কানুনের যথেচ্ছ পরিবর্তন করে এইসব এজেন্সিগুলোর হাতে প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া, তার সুফল সর্বত্র। একজন বিজেপি এমপি এমএলএ এই তদন্তের মুখে নেই, তাদের বাড়িতে ইডি বা ইনকাম ট্যাক্স হানা দিচ্ছে না। এমনকী অভিযোগ আছে, এমন নেতারাও যদি বিজেপিতে যোগ দেন, তাঁরাও ক্লিন সার্টিফিকেট পাচ্ছেন, তাঁদের আর ইডি অফিসে ডাকা হচ্ছে না, সিবিআই কোনও এক মন্ত্রবলে তাদের দিকে তাকাতেও ভুলে যাচ্ছে। উদাহরণ আমাদের কাঁথির টাচ মি নট খোকাবাবু এবং আরও অনেক দলবদলুরা। এটাও এক প্রস্তুতিপর্ব, কারণ এই খবর ফলাও করে দেখানো হবে চ্যানেলে চ্যানেলে, সরকারে আছে বিজেপি, দুর্নীতি করছে বিরোধীরা। ফলও ফলছে, কদিন আগেই গ্রেফতার হয়েছিলেন শিবসেনার উদ্ধব গোষ্ঠীর নেতা সঞ্জয় রাউত, বেল পেয়ে বাইরে আসার পর থেকেই তাঁর গলায় উল্টো সুর, আমি নিশ্চিত সে সুর আরও পরিষ্কার হবে আগামী দিনে। উদ্যোগপর্বের দ্বিতীয় খেলাটা মোক্ষম জায়গায়, টাকা টাকা টাকা, রৌপ্য গড়ন, চক্রবরণ, তুই বিনে সব ফাঁকা। কে না জানে নির্বাচন জিততে টাকা দরকার। আর বিজেপি সেই টাকা জোগাড়কে এক শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে চলে গেছে। কর্পোরেট ফান্ডিং যাতে নিরপেক্ষ হয়, তার জন্য ইলেকটোরাল বন্ড-এর ব্যবস্থা হল, মানে শিল্পপতিরা টাকা দিয়ে ব্যাঙ্কের কাছ থেকে বন্ড কিনবে, তারপর তা দেবে রাজনৈতিক দলগুলোকে, তারা সেই বন্ড ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে টাকা তুলে নেবে। খানিকটা আপনি যেমন বিয়েতে গিফট ভাউচার দেন, খাম থেকে বার করে মিলিয়ে দিলে কে কত টাকা দিয়েছে বোঝাই যাবে না। কিন্তু মজাটা হল, সরকারে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে কোন শিল্পপতি কত টাকার বন্ড কিনছেন, তা সরকারের কাছে পরিষ্কার, আর সেই টাকার কতটা বিজেপির কাছে এল তাও জানা, অতএব কোন শিল্পপতি বিরোধীদের কত টাকা দিল তাও জলের মতো পরিষ্কার। অতএব জলে থেকে কুমিরকে না চটিয়ে শিল্পপতিরা সিংহভাগ টাকা তুলে দিচ্ছেন বিজেপির হাতে। পরিসংখ্যান বলছে ইলেকটোরাল বন্ডের ৬৭ শতাংশ পাচ্ছে মোট প্রদত্ত ভোটের ৪১ শতাংশ পাওয়া বিজেপি, বাকিটা ভাগ হচ্ছে বিভিন্ন দলের মধ্যে। তার মানে লড়াইয়ের রসদ জোগাড় হয়ে গেল। এরপর হচ্ছে ২০২৪ নির্বাচনের ইস্যু সেট করা, আপনি বলবেন সে আবার কী? ইস্যু তো মানুষ বেছে নেয়, রাজনৈতিক দল কীভাবে সেট করবে? আছে আছে, তারও প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ২০২৪-এর মুদ্দা অযোধ্যার রামমন্দির। ২৪-এর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি নাগাদ মন্দির উদ্বোধন হবে, দেশজোড়া দর্শনার্থীরা আসবেন, সেখানেই শপথ নেওয়া হবে, কাশী মথুরার। আগামী নির্বাচন বেকার যুবকদের কথা বলবে না, কৃষকদের ফসলের সমর্থন মূল্যের কথা বলবে না, রোটি কাপড়া মকানের কথা বলবে না, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুতের কথা বলবে না। আরএসএস–বিজেপির স্বপ্ন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে গরিবগুর্বো মানুষ তাঁদের আধ্যাত্মিক অস্তিত্বকে খুঁজে পাবেন, চিৎকার করে বলবেন ইয়ে তো পহেলি ঝাঁকি হ্যায়, কাশি মথুরা বাকি হ্যায়, তারও প্রিলিউড আমরা শুনতে পাচ্ছি। এরপর আছে ফিফথ কলামনিস্টদের, বিশ্বাসঘাতকদের চোরা সমর্থন, কোথাও ইসলামের নাম করে তো কোথাও আমরাই সচ্চা ঝাড়ুদার বলে কিছু ভোট কাটুয়ার দল এসে হাজির হবে, ভোট কেটে সুবিধে করে দেবে বিজেপির। এবং শেষমেষ রয়েছে নির্বাচনের পরে সাংসদ কেনা বেচা, অমিত শাহ এ বিষয়ে ডক্টরেট করেছেন বললেও কম বলা হয়। কিন্তু এ প্রস্তুতি ঠিক নির্বাচনের রেজাল্ট বের হওয়ার পরেই হবে এমনটা কিন্তু নয়। বিরোধী দলের কালো ভেড়াগুলোকে এখন থেকেই চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে দিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্ব, অমিত শাহ, তাদেরকে প্রকাশ্যে দেখা যাবে নির্বাচনের পরে, বিজেপি যদি ২০-৩০টা আসনেও পিছিয়ে পড়ে, তারও জোগাড় হয়ে যাবে। এটাই বিজেপির প্রস্তুতিপর্ব। দুর্যোধন ভেবেছিলেন ভীষ্ম আমার দিকে, দ্রোণ কৃপাচার্যের মতো মহারথীরা আমার দিকে, অভেদ্য কবচ কুণ্ডল নিয়ে বীর কর্ণ আমার দিকে, কৃষ্ণের ১১ অক্ষৌহিনী সেনা আমার দিকে, কৃষ্ণ অস্ত্র ধরবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আমায় হারাবে কে? হেরেছিলেন তিনি, নির্মম ছিল সেই পতন। দেশজোড়া মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, কৃষকদের অসহায় অবস্থা, শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমতে থাকাই হয়ে উঠতে পারে নির্বাচনের মূল ইস্যু, পালটে যেতেই পারে সব চাল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত অ্যাডভান্টাটেজ শাসক দল, বিরোধীরা এখনও দিশাহীন।