রাস্তায় টিঁয়াপাখি নিয়ে যে জ্যোতিষীরা বসে থাকেন তাদের কাছ থেকে নয়, বা ১৩৪৬ জনের মতামত নিয়ে নয়, গতবারের জয় পরাজয়, তার পরে লোকসভা, বিধানসভার ফলাফল, সাংগঠনিক ক্ষমতা, প্রচারের অবস্থা ইত্যাদি খবরাখবরকে পাশাপাশি রেখে একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করছি আমরা, যে ধারণা থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কোন দল কতটা এগিয়ে, কোন দলের ভোট পার্সেন্টেজ কতটা হতে পারে, কোন দল অন্তত জেলা পরিষদ নির্বাচনে কতগুলো আসনে জিততে পারে, তার হদিশ পাওয়া যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে সবথেকে বড় সমস্যা হল তৃণমূল দল, কারণ যেভাবে ২০১৮-র নির্বাচন হয়েছিল, বা বলা ভালো করানো হয়েছিল, তার ভিত্তিতে সংগঠন বা মানুষের সমর্থন কোনওটাই বোঝার কোনও উপায় নেই। ধরুন মুর্শিদাবাদ জেলা, ২০১৮তে ফলাফল কী হয়েছিল? ভোট পড়েছিল ১১ লক্ষ ৭৯ হাজার ৯৪২, তৃণমূল পেয়েছিল ৭ লক্ষ ৮৪ হাজার ৬০১টা ভোট। তার মানে ৬৬.৪৯ শতাংশ ৭০টা জেলা পরিষদের মাত্র ২২টাতে নির্বাচন হয়েছিল, সেই ২২টার ২১টা পেয়েছিল তৃণমূল আর কংগ্রেস পেয়েছিল ১টা। মুর্শিদাবাদের সেই সময়ের তৃণমূল দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী, বলেছিলেন কংগ্রেসমুক্ত মুর্শিদাবাদ করে দেখাব, অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করেছিলেন। মাত্র তার পরের বছরে ওই মুর্শিদাবাদের বহরমপুর আসনে জিতলেন কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী, আবার তার দু’বছরের মধ্যেই ওই মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের ভরাডুবি, কারণ মুসলমান ভোটের তীব্র মেরুকরণ। কাজেই হিসেব করতে গিয়ে ২০১৯ আর ২০২১-এর নির্বাচনকেই গুরুত্ব দিয়েছি আমরা, এবং অবশ্যই এই মুহূর্তে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শক্তির দিকেও চোখ রেখেই একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করছি। হ্যাঁ, আমাদের বিষয় আজকে, উত্তরবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল।
প্রথমেই খেয়াল করুন বাংলার যুবরাজের তৃণমূলের নবজোয়ার, শুরুই হল ওই উত্তরবঙ্গ থেকে, সেখানেই একটা বিরাট সময় থাকলেন তিনি, প্রার্থী বাছাই, বিভিন্ন সাংগঠনিক ফাঁকফোকর বোজানোর চেষ্টা করলেন, ওই যে দণ্ডি কাটানো হয়েছিল বিজেপি করার অপরাধে, সেখানে সামাল দেওয়া, দলের মধ্যে লাগাতার খেয়োখেয়ি সামাল দেওয়া, এরই মধ্যে নাকি মানুষ প্রার্থী নির্বাচন করবে, মানুষের সামনে তখন চেয়ার ভাঙা আর ব্যালট কুচিকুচি হয়ে পড়ে আছে।
আরও পড়ুন: Aajke | পঞ্চায়েত ভোট হবে? ভোট হবে না, ভোট পিছোবে, ভোট হবে
তো এসব সামাল দিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, উত্তর আর দক্ষিণ দিনাজপুর ছেড়ে মালদায় নেমে এলেন তখনই উত্তর দিনাজপুর আর আলিপুরদুয়ার থেকে দলীয় কোন্দলের নতুন কাহানি সামনে চলে এল। কাজেই খেয়াল করুন এবার সামাল দিতে মাঠে নামলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিনহাটা উদয়ন গুহ সামলাচ্ছেন, সংগঠন চালানোর অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু আলিপুরদুয়ারে সামাল দিতে সেই মমতা। ওদিকে নিশীথ প্রামাণিক থেকে সুকান্ত মজুমদার চরকিপাক দিচ্ছেন উত্তরের জেলাগুলোতে, কিন্তু জন বার্লাকে নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন। তাঁর বিজেপিতে উত্থান দেখার মতো, আদিবাসী হিসেবে একটা প্রেফারেন্সও তিনি পেয়েছেন, কিন্তু তিনি আপাতত সাগিনা মাহাতো, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তার সঙ্গে জুড়েছে আদিবাসীদের বিভিন্ন ইস্যু, যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি অমিত শাহ, মোদিজি দিয়েছিলেন ২০১৯-এ সভায় সভায়, কিন্তু সেসব তো ছিল নির্বাচনী জুমলা, এখন সেসব হারিয়ে যাওয়া প্রতিশ্রুতির দায় জন বার্লার ওপরে। তার মধ্যে গুজব, ওনাকে মন্ত্রিত্ব পদও ছাড়তে হতে পারে, সব মিলিয়ে যে বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে বিজেপি উত্তরবঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিল, তা ধরে রাখাটাই বিরাট প্রশ্নের মুখে, সেখান থেকে খুব একটা এগিয়ে যাবে, এমন কথা তো বিজেপিও ভাবছে না। ওদিকে উত্তরবঙ্গে বামেরা যেটুকু এগিয়েছে তা ওই শিলিগুড়ির এধারে ওধারে, পঞ্চায়েত ভোটে উত্তরবঙ্গে বামেরা তেমন করে প্রচারেও নামতে পারেনি। ২০১৯ বা ২০২১-এর রেজাল্ট আপনাদের মনেই আছে। তবে বামেদের এই পিছিয়ে পড়ার বদলে খানিক আরও সক্রিয়তা থাকলে বিজেপির কিছু ভোট কাটা যেত, মানে সরকার বিরোধী অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি ভোট, কিছুটা হলেও ভাগাভাগি হত, যা হবেও, কিন্তু তেমন বিরাটভাবে হবে না যা হলে ফলাফল অন্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিত। এইসব সাতপাঁচ হিসেবের পরেও উত্তরবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে এগিয়ে তৃণমূল। আলিপুরদুয়ার জেলাপরিষদ যেখানে বিজেপি জিতবেই, এমনটাই ভাবা হচ্ছিল সেখানে এখন হাওয়া ঘুরে গেছে। জেলাপরিষদে আলিপুরদুয়ার নিয়ে একেবারে নিশ্চিত হওয়ার মতো জায়গায় বিজেপি নেই। বাকি জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর এবং দক্ষিণ দিনাজপুরে তৃণমূল জেলাপরিষদের দখল রাখবে, কিন্তু কোচবিহারেও লড়াই হবে, বাকি জেলাতে বিজেপিও বেশ কিছু জেলা পরিষদ সদস্য জিতিয়ে আনবে। আমরা উত্তরবঙ্গের এই জেলাগুলোর কিছু মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের জেলায় ফলাফল কী হতে চলেছে, শুনুন মানুষ কী বলছেন।
একটা সময় ছিল, যখন উত্তরবঙ্গ রাজ্যের মূল অংশ থেকে অন্তত রাজ্য রাজধানীর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, তৃণমূল সরকার আসার পরে সেই বিচ্ছিন্নতা অনেকটা কেটেছে। কিন্তু আদিবাসী, রাজবংশী ইত্যাদি আইডেনটিটি এবং পাহাড়ের রাজনীতিতে দিল্লির প্ররোচনা বন্ধ হয়নি, যার ফলে সেখানে দক্ষিণের মতো শক্ত জমি এখনও তৈরি করে উঠতে পারেনি তৃণমূল। অন্যদিকে বিজেপি এই আদিবাসী, গোর্খা, রাজবংশী ইত্যাদি নিয়ে ট্রাপিজ খেলাতে মাস্টার, কত সন্তর্পণে বিজেপি রাজ্যসভা ভোটের আগে অনন্ত মহারাজের নামটা ভাসিয়ে দিয়েছে, এও ওই রাজনীতিরই এক অঙ্গ, সেই চালে বাজিমাত হবে তেমন নয়, কিন্তু কোচবিহার বা আলিপুরদুয়ারে বিজেপি লড়াই দেবে, বাকি তিন জেলায় নিশ্চিত জিতবে তৃণমূল। তার মানে প্রশ্ন রইল কোচবিহার আর আলিপুরদুয়ার নিয়ে, মমতা ঘুরে এসেছেন কদিন আগেই, তাতেই নাকি খেলা ঘুরেছে। সুকান্ত মজুমদার বলেছেন আমরাই জিতব, আমরা বলছি দুটোতেই লড়াই হবে কিন্তু অ্যাডভানটেজ তৃণমূল।