আমাদের বর্তমান রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস ৪৫টা বই লিখেছেন ইংরিজি, মালয়ালম আর হিন্দিতে। এখানে এসে বাংলা শিখতে শুরু করেছেন, হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই তেনার বাংলায় লেখা বইও পেয়ে যাব আমরা। তিনি আরও বই লিখুন, পাঠকরা ঋদ্ধ হোক। কিন্তু আজ আলোচনা তাঁর বেশ পুরনো একটা বই নিয়ে। যে বইয়ের চতুর্থ সংস্করণ বের হয়েছে। হতেই পারে। শশী থারুরের মতো মানুষও যখন ওনার লেখা পড়ে উচ্ছ্বসিত তখন তাঁর লেখা বই চতুর্থ কেন দশম সংস্করণও বের হতে সময় লাগবে না। তাঁর এই বইটার নাম সাইলেন্স সাউন্ডস গুড। নীরবতাই মানায় ভালো। সেই বইয়ে বিভিন্ন সময় লেখা প্রবন্ধ আছে। এক প্রবন্ধে তিনি মিউনিখের বিয়ার ফেস্টিভাল-এর বিস্তৃত বর্ণনাও দিয়েছেন, অনেক খরচ করেই তিনিও নিজে হাজির থেকেছেন সেই আকণ্ঠ বিয়ারপানের আসরে। বিশাল এলাকায় বড় বড় টেন্টের এক একটায় হাজার কুড়ি মানুষ হাজির হয়, তারপর মন দেওয়া নেওয়া থেকে ভাঙা মন জোড়া দেওয়ার গল্পও আছে সেখানে। কিন্তু সবথেকে ইন্টারেস্টিং ওনার এই বইয়ের প্রথম প্রবন্ধটি এবং তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং হল ওনার বইয়ের নাম। যিনি প্রায় প্রতি কথায় চিৎকার করে নিজের মতামত জাহির করছেন, রাগ চাপতে পারছেন না, যাঁর প্রায় প্রতিটা পদক্ষেপে তাঁর পদমর্যাদার গন্ধ লেগে থাকছে, সেই তাঁর বইয়ের নাম— সাইলেন্স সাউন্ডস গুড, নীরবতাই মানায় ভালো। এবং তাঁর প্রথম প্রবন্ধটাই হল ক্ষমতা নিয়ে, ক্ষমতার নেশা নিয়ে। আজ সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, ক্ষমতা এক চূড়ান্ত নেশা।
আসুন তাঁর প্রথম প্রবন্ধ নিয়েই আলোচনা করা যাক। সেই প্রবন্ধের শুরুতে তিনি নাম না করে এক মন্ত্রীমশাইয়ের কথা বলছেন যিনি মানুষকে কথায় কথায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন, যিনি এক মহিলা কর্মচারীকে ফাইল ছুড়ে মেরেছিলেন, যিনি এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে থাপ্পড় মারার পরে সেই কর্মচারীর থাপ্পড় খেয়েছিলেন, যিনি এখন আর মন্ত্রী নেই, কিন্তু তাঁকে দেখে দফতরে বসিয়ে চা খাইয়ে ছিলেন সি ভি আনন্দ বোস। এই কথা বলার পরেই তিনি ক্ষমতা আর তার নেশা নিয়ে বলছেন, They will berate anyone they come across. Assert on things they are totally ignorant about. Throw to the winds all rules and regulations. Will claim that if they commit wrong doing it is because they have a right to do so and will insist on compliance by others. তিনি বলছেন এই মানুষেরা তাদের পথে যে আসবে তাকেই আঘাত করবে। যে বিষয় জানে না সেই বিষয়ে কথা বলবে। নিয়ম কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখাবে। এবং দাবি করবে যে যদি সে কিছু ভুল করেও থাকে, তাহলে সেই ভুল করার অধিকার তার আছে এবং সেই ভুল নির্দেশই সবাইকে মেনে চলতে হবে।
আরও পড়ুন: Aake | উত্তরে মমতা, দক্ষিণে যুবরাজ
সি ভি আনন্দ বোস কি এসব কথা নিজের সম্বন্ধেই লিখছেন? ধরুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস, তার আগাগোড়া মাথা তিনি কিছুই জানেন না, কিন্তু তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বারণ করার পরেও সেই দিবস পালন করলেন এবং সবাইকে সেখানে থাকার নির্দেশ দিলেন। একদল বাঙালি তাদের দেশভাগের যন্ত্রণার দিনে নাচাগানা করতে বাধ্য হল। তিনি কি নিজের ছবিই দেখতে চেয়েছিলেন? আমলাদের দ্বিচারিতা, তাদের অনুভূতিহীন গোঁয়ার্তুমির কথা লিখেছেন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস, সেটা কি নিজের উপাখ্যান? উনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ করবেন, করছেন, এটা জেনেও যে সেই নির্দেশের কোনও মানেই নেই, এক নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীর অধিকার কেড়ে নিয়ে তিনি কোন ক্ষমতার কথা বলছেন? যে ক্ষমতায় তাঁরই ভাষায় এক আমলা মানুষকে হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য করে এবং তাতে মজা পায়? এবং সেরকম একটা সময়ে এই সবের ওপরে তাঁর অনৈতিক কাজের অভিযোগও আমাদের সামনে, তিনি রাজভবনকে নিজের ব্যক্তিগত কাজের জন্য ব্যবহার করছেন। যে বই লিখে তিনি রয়্যালটি পান, বাংলা ভাষায় টাকা রোজগার করেন সেই বইয়ের উপরে জতীয় অশোক স্তম্ভ দেওয়ার অধিকার তাঁকে দিল কে? প্রকাশকের জায়গায় রাজভবন? কে দিল এই অধিকার? আমরা মানুষকে প্রশ্ন করেছিলাম, রাজ্যপাল নিজের বইয়ের উপর অশোক স্তম্ভ লাগিয়ে, রাজভবন থেকে বই প্রকাশ করে রোজগার করছেন। এই কাজ কি তাঁকে মানায়? এটা কি অনৈতিক নয়? শুনুন মানুষ কী বলছেন।
কিছু কিছু মানুষকে আমরা জ্ঞানপাপী বলে থাকি, মানে এই গোত্রের মানুষরা জানেন কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়, কিন্তু জেনেবুঝেও সেই অন্যায়টা তাঁরা করেন। রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস হলেন এই গোত্রের মানুষ, যিনি তাঁর ক্ষমতাকে অনায়াসে তাঁর স্বার্থে ব্যবহার করে চলেছেন, তিনি তাঁর বই সাইলেন্স সাউন্ডস গুড, নীরবতাই মানায় ভাল বইয়ের প্রথম প্রবন্ধে লিখছেন, Power is psychotropic. It is an intoxicant, hallucinant. It causes giddiness. The feet may falter and one may fall down. ক্ষমতা হল এক চূড়ান্ত নেশা। ক্ষমতা মানুষকে মাতাল করে, চোখের সামনে ভুল ছবি তুলে ধরে, মাথা ঘুরিয়ে দেয়। পা নড়বড় করে, এরফলে পতনও স্বাভাবিক। হ্যাঁ, মাননীয় রজ্যপাল, ক্ষমতার জোরে ধরাকে সরা না দেখাই ভালো, এতে পতন হয়, এবং এই বয়সে পতন সহ্য না হওয়ারই কথা।