হ্যাঁ, হয়তো সামনের মাসেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। রাজ্য জুড়ে রাজসূয় যজ্ঞ। ৩৩১৭টা গ্রাম পঞ্চায়েত, ৩৪১টা পঞ্চায়েত সমিতি আর ২০টা জেলা পরিষদের নির্বাচন। সেই অর্থে এত ব্যাপক গণতান্ত্রিক প্রয়োগ অন্য কোনও নির্বাচনে নেই। কাজেই প্রতিটা গ্রামে শুরু হয়ে যাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। এবং এই নির্বাচন যে আসছে তা কোনও রাজনৈতিক দলের, নেতাদের অজানা নয়। হঠাৎ কালবৈশাখীর মতো নির্বাচন নেমে এল তা তো নয়। প্রত্যেকের জানা ছিল। তাই ঢাকে কাঠি পড়ার সময়েই আসুন দেখে নেওয়া যাক কারা কারা হোমওয়ার্ক কতখানি সেরে রাখল, কারা যত্ন করে, মন দিয়ে হোমওয়ার্ক করেছে, কারা করেনি। কারণ দেশ খতরে মে হ্যায়, জি টোয়েন্টি, মাদার অফ ডেমোক্র্যাসি, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সংবিধানকে বাঁচাতে হবে এইসব বড় বড় বিষয়গুলো রাখা থাকে লোকসভা আর কিছুটা হলেও বিধানসভা নির্বাচনের জন্য। বড় বড় নেতাদের চোখধাঁধানো র্যালিতে এসব নিয়ে লোকসভা নির্বাচনে বিস্তর বক্তিমে হবে। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের চরিত্র আলাদা। গ্রামের রাস্তা, গ্রামের হাসপাতাল, স্কুল, স্কুলের মিড ডে মিল, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে প্রাপ্য সাহায্য, খয়রাতি, বন্যা, খরা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সরকারি সাহায্য মেলা বা না মেলা, সাধারণ সুরক্ষা মানে শান্তিতে বেঁচেবর্তে থাকা এই সবই এই নির্বাচনের ইস্যু। হ্যাঁ, অন্তত আমাদের রাজ্যে কিছু সামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে পঞ্চায়েতের ইস্যু এখনও হিন্দু খতরে মে হ্যায়, গো হত্যা কিংবা রামমন্দির বা হনুমান পুজো নয়। কাজেই হোমওয়ার্ক খুব জরুরি। আজ সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, কোন দল কতটা তৈরি, জিতবে কারা?
প্রথমেই শাসকদলের কথায় আসা যাক। হ্যাঁ, রাজ্য জুড়ে সিবিআই ঘুরছে যেন স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বাজলে কচিকাঁচারা। তারা যেমন ছুটে বেড়ায়, তেমনই এই লক্ষ্যবিহীন ছোটাছুটি, চারিদিকে রব দুর্নীতি দুর্নীতি। তাঁরা যত ছুটছেন ততই বিরোধী দল বলছে দেখেছেন, দেখেছেন সব চোর সব চোর। কিছু মানুষ বিশ্বাস করছে বইকী। কিন্তু সিবিআই ইডি-র এই ছোটছুটি তো আজকের নয়, তাঁরা তো ছুটেই চলেছেন সেই কবে থেকে, বহু মানুষই এখন প্রশ্ন করছেন, ছোটাছুটিই সার হচ্ছে না তো স্যর? কাউকে দোষী বলে সাব্যস্ত করা হবে কবে? নারদা গেছে, চিটফান্ড গেছে, চাকরি দুর্নীতিও তো কম দিন হল না, কেবল জেরা আর জেরা, কিছু লোককে জেলে রাখা। বেশ তো, আসল কাজটা কবে হবে? অর্থাৎ বেশ কিছু মানুষ এই দূর্নীতি তত্ত্বে বিশ্বাস করছে কিন্তু বেশ কিছু মানুষ এটাকে এক রাজনৈতিক চক্রান্ত হিসেবেও দেখছে। কিন্তু এই দুর্নীতির ইস্যুতেই নির্বাচনটা হবে কি? হলে কাঁটে কা টক্কর দেখব আমরা। কিন্তু সাধারণ রাজনৈতিক ধারণা হল, গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোট স্থানীয় ইস্যু নিয়েই বেশি প্রভাবিত হয়। সেখানে তৃণমূল অনেক কদম এগিয়ে, তাঁরা একদিকে সরকারি প্রকল্পের ঝুড়ি নিয়ে হাজির, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, আরও অনেক শ্রী নিয়ে তাঁরা তৈরি করেছেন এক বিরাট ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারির বেস ওয়ার্ক। অন্য দিকে নির্বাচনের ঠিক আগে মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের জন্য জনজোয়ার। ওই ব্যালট বক্স ছিনতাই ইত্যাদিও আসলে মানুষের ঢল এবং ঢালকেই প্রমাণিত করে। অন্যদিকে সিপিএম কিছুটা হলেও মাঠে, এখনও সংগঠনের সবকটা কলকব্জা যে দারুণ কাজ করছে তা নয়, তবুও কিছুটা তো হচ্ছে। ওনাদের সমস্যা, জেলার জমায়েতে লোক যাচ্ছেন বটে, গ্রামের মিছিলে, মহল্লার মিছিলে এখনও লোক নামানো যাচ্ছে না। বাংলা কংগ্রেস তো জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়, ভোট হলে তখন কিছু মিটিং মিছিল হবে। পোস্টার দেওয়াল লিখন হবে কিন্তু তার জন্য ফেলো কড়ি মাখো তেল। কিছু পকেট আছে যেখানে তাঁরা আছেন, প্রচার করলেও আছেন, না করলেও আছেন, ওগুলো কংগ্রেসের জমিদারি। অন্যদিকে বাংলার বিজেপি হল চাতক পাখি, মুখ হাঁ করে বসে আছে, কবে বৃষ্টির জল মুখে পড়বে, ওনাদের কাজ করবে ইডি সিবিআই ইনকাম ট্যাক্স। ওনারা কেবল টুইট করবেন আর সাংবাদিকদের সামনে কথা বলবেন। গ্রামে গ্রামে ঘোরা, বুথ কমিটি তৈরি করা, প্রতিটা পঞ্চায়েতের প্রার্থী ঠিক করা, তাকিয়ে দেখুন, এর একটারও কাজে হাতও কি দিয়েছে তিন মুখো বাংলার বিজেপি? কে কটা সভা করার দায়িত্ব পেলেন, সেটা ফোনে সাংবাদিকদের জানিয়ে অন্য গোষ্ঠীকে হ্যাটা করেই চলেছেন। শুভেন্দুকে দিয়েছে ৩০টা সভা আমাকে ৭০টা, সুকান্ত গোষ্ঠীর দাবি। কাজেই গ্রামবাংলার মাটির দিকে নজর রাখলে বলাই যায় আপাতত অ্যাডভানটেজ তৃণমূল। সেটাই আমরা মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পঞ্চায়েতের নির্বাচন এসেই গেল, জিতছে কারা? কী বলছেন জনগণ শুনুন।
এবার একটা অন্য কথা, তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই নব জোয়ার, জন জোয়ার ইত্যাদির আগেই বলেছেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে, বিরোধীরা নিশ্চিন্তে প্রতিদন্দ্বিতা করবেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা বরদাস্ত করব না। এগুলো মন থেকে বলা কথা? প্রতিশ্রুতি? না নিছক বাওয়াল তা দেখার জন্য কিন্তু মানুষ বসে রয়েছে। বিরোধীরা নমিনেশন ফাইল করতে যাবেন আর রাস্তা জুড়ে খাঁড়া হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে উন্নয়ন, তাই যদি হয় তাহলে গা-জোয়ারি করে এ নির্বাচন তো জেতা যাবে, এর পরের নির্বাচন কিন্তু কঠিন হয়ে যাবে, এ কথাও মনে রাখাটা দরকার।