কলকাতা: ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ভোটের (Panchayat Vote ) প্রচার শেষ হল বৃহস্পতিবার। প্রচারের শেষ লগ্নেও অশান্তি পিছু ছাড়ল না বাংলার। এদিনও রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়েছেন দুজন। মুর্শিদাবাদ এবং বীরভূমে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। জেলায় জেলায় শেষ দিনে প্রচারের ঝড় উঠেছে। শাসকদল থেকে বিরোধী সব দলের শীর্ষ নেতারা শুধু নন, মাঝারি এবং ছোট নেতারাও মিছিল, মিটিং, সভা, সমাবেশে গরম গরম ভাষণ দেন।
ভোটের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে বৃহস্পতিবার রাজভবনে ঘটা করে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস (C. V. Ananda Bose Governor of West Bengal ) তীব্র আক্রমণ করেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহাকে (WB Election Commissioner Rajiva Sinha)। রাজ্যপাল কমিশনারকে স্মরণ করিয়ে দেন, তিনি রাজধর্ম পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। রাজ্যপাল তাঁর উদ্দেশে বলেন, আপনাকে আমি নিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু আপনি রাজ্যবাসীকে হতাশ করেছেন। কেন এত মৃত্যু হয়েছে ভোটের আগে, তার দায় আপনাকে নিতে হবে। আপনার হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে। আপনি মানুষের কান্না শুনতে পাননি, মানুষের আর্তি আপনার কানে পৌঁছয়নি। রাজ্যপাল বলেন, বাংলায় মানুষের জীবন নিয়ে, আগুন নিয়ে খেলা হচ্ছে। হিংসার জন্য বাংলার মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, মিস্টার কমিশনার, এখনও সময় আছে। আপনি অ্যাকশন নিন। আপনি জিরো গ্রাউন্ডের কমিশনার হন।
প্রশাসনিক মহলের মতে, এই প্রথম কোনও রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে রাজ্যপাল এ ধরনের নজিরবিহীন আক্রমণ করলেন। স্বাভাবিকভাবেই শাসকদল বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এত জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান রাজ্যপাল আমাদের দরকার নেই। তিনি পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে এত চিন্তিত কেন, বুঝতে পারছি না। তৃণমূল নেতার অভিযোগ, রাজ্যপাল বিজেপির ব্রিফিং নিয়ে চলছেন। শাসকদলের রাজ্য মুখপাত্র কুণাল ঘোষ রাজ্যপালকে বিজেপির দালাল বলে কটাক্ষ করেন। তিনি বলেন, রাজ্যপাল, আপনি বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে রাখুন। ১১ জুলাইয়ের পর আপনাকে বাংলা ছেড়ে চলে যেতে হবে। রাজ্যপালের অবশ্য দাবি, আমি বিজেপির হয়ে কাজ করিনি। আমার সঙ্গে সব রাজনৈতিক নেতা দেখা করেছেন। আমি আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হিংসা রুখব।
এবার পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্ব থেকেই হিংসার শুরু। মনোনয়নের প্রথম দিনেই মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামে এক কংগ্রেস কর্মী খুন গুলি-বোমায়। জখম হন আরও কয়েকজন। তখন থেকে শুরু করে বৃহস্পতিবার প্রচারের শেষ দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক হিংসায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৭ জনের। এত মৃত্যু, এত হিংসা ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
এই হিংসার আবহে এবারের পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। তিনি মনোনয়ন পর্বে হিংসাদীর্ণ বিভিন্ন এলাকায় ছুটে গিয়েছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। রাজ্যপাল বলেন, আমি যেখানে হিংসা দেখব, সেখানেই ছুটে যাব। হিংসা রুখতে তিনি রাজভবনে শান্তিকক্ষ খুলেছেন। ভোটের তিনদিন আগে বুধবার শান্তি ও সামাজিক সংহতি কমিটি গঠন করেছেন ভোটে নজরদারি চালানোর জন্য। তার জন্যও শাসকদল তাঁকে বিঁধতে ছাড়েনি। বিরোধীরা অবশ্য রাজ্যপালের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার শুরু করেছিলেন উত্তরবঙ্গ দিয়ে। কিন্তু জলপাইগুড়ির প্রচার সেরে শিলিগুড়ি আসার পথে তাঁর হেলিকপ্টার দুর্যোগের কারণে বিপাকে পড়ে। কপ্টার থেকে নামতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পায়ে এবং কোমরে চোট পান। ফলে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আর প্রচার চালাতে পারেননি। এদিনই তিনি হাঁটুর ফ্লুয়িড সরানোর জন্য এসএসকেএম হাসপাতালে আসেন। সন্ধ্যায় তিনি হাসপাতাল ছাড়েন। এবার দাপিয়ে প্রচার চালান অভিষেক। পিছিয়ে ছিলেন না বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী প্রমুখ। এবারের প্রচারে শাসকদলের মূল অভিমুখ ছিল বাম-কংগ্রেস-বিজেপির বিরোধিতা। তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, তাদের হারাতে এই তিন দল জোট বেঁধেছে। যদিও বিরোধী তিন দল সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। বিরোধীদের দাবি, মানুষ এবার প্রতিরোধের মেজাজে। কাজেই শাসকদল ২-১৮ সালের মতো ভোট লুঠ করতে পারবে না।
এবারে পঞ্চায়েত ভোট কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে হবে কি না, তা নিয়ে দীর্ঘ টানাপড়েন চলে। মামলা গড়ায় হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। শেষে আদালতের চাপে রাজ্য নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক হয়েছে, প্রতি বুথে একজন করে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশ এবং একজন করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান থাকবেন। আদালতের নির্দেশেই ভোটে ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে।