আগামিকাল খবরের কাগজের নিশ্চিত শিরোনাম, “সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবার ধাক্কা খেল রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার হাইকোর্টের নির্দেশ বহাল থাকল।” ছাগলের তৃতীয় সন্তান ছাড়া এই খবরে কারও উল্লসিত হওয়ার কথা নয়, কিন্তু বাস্তবে উল্লাস দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মহলে। বিজেপির দফতরে রসগোল্লা, থুড়ি লাড্ডু বিতরণ হয়েছে কি না জানা নেই, কিন্তু দৃশ্যতই আমাদের কাঁথির খোকাবাবুর বডি ল্যাঙ্গোয়েজে উল্লাসের হিল্লোল দেখেছি। আলিমুদ্দিনেও খবর গিয়েছে, পেয়েছি, পেয়েছি, কেন্দ্রীয় বাহিনীর সুরক্ষা পাওয়া গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এদিনের রায়ে হাইকোর্টের রায়কে বহাল রাখল। মানে রাজ্য নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্য আবেদন করবে, দিল্লির সরকার সেই কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাবে। তারা নির্বাচনের সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করবে। আচ্ছা, এই রায় তো হাইকোর্ট দিয়েছিল, তাহলে রাজ্য সরকার তার বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে গেল কেন? রাজ্য সরকার কি জানত না যে এই রায় বজায় থাকবে? জানত, ভালো করেই জানত। কিন্তু দেখো ওরা ওদের পুলিশ এনে আমাদের শাসন করতে চায়, কেন্দ্র সরকারের পুলিশ দিয়ে রাজ্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে চায় বা আরও সোজা করে ওই কেন্দ্র রাজ্য সংঘাতকেই মানুষের সামনে তুলে ধরাটাই শ্রেয় বলে মনে করেছে রাজ্য সরকার। কেন্দ্রে বিজেপি, তারা মানুষকে নিয়ে নয়, ইডি, সিবিআইকে দিয়ে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে, এখন কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে চাপ তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে, এই ন্যারেটিভটাই আপাতত তৃণমূল নেত্রীর এক বড় অস্ত্র। তার বিপরীতে প্রত্যেক দল প্রায় হাত ধরাধরি করে সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে যাচ্ছে, হাই কোর্টে, সুপ্রিম কোর্টে। কাজেই এটা ঠিক লিগাল ব্যাটল নয়, এটা আদতে এক পলিটিকাল ব্যাটল, রাজনৈতিক লড়াই, সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, পঞ্চায়েত, কোর্টে জিতল বিরোধীরা, মাঠে জিতবে কে?
আমরা সাংবাদিকরা জানি, বিরোধী রাজনৈতিক দল জানে, শাসকদল জানে, নির্বাচন কমিশন জানে, বিচারকও জানেন যে কেন্দ্রীয় বাহিনী না হয় এল, তারপর? কারা তাদের জায়গা মতো পাঠাবে? কাকদ্বীপে যাবে না কঙ্কালীতলা, সেটা ঠিক করবে তো রাজ্য নির্বাচন কমিশন, মাথায় রাজীব সিনহা, মমতার সুপারিশ নিয়েই যিনি ওই পদে বসেছেন। এই সিদ্ধান্ত তো সুকান্ত মজুমদার বা মহঃ সেলিম নেবেন না। কাজেই শাসকদল জানে যে, হেসে নাও দু’দিন বই তো নয়, মাঠে যখন খেলা হবে তখন রেফারি তো আমরাই।
আরও পড়ুন: Aajke | পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যপাল বনাম তৃণমূল?
এবং চোখের সামনে আছে শীতলখুচির ঘটনা, আজও জানা গেল না যে কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীর কোন কোন অবিমৃষ্যকারিতার জন্য অতজন গ্রামবাসী প্রাণ দিয়েছিলেন? কেন সেদিন গুলি চালানো হল? কেন্দ্রীয় সুরক্ষা বাহিনী মানেই তো সাত খুন মাফ হয়ে যায় না। এবং ২০২১, হয়েছিল তো কেন্দ্রীয় সুরক্ষা বাহিনী দিয়ে ভোট, রেজাল্ট কী? চার জনের মৃত্যু ওই কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে আর তৃণমূলের ২১৫টা আসন। আসল রাজনীতি মাঠে হয়, গুন্ডামিকে রুখতে সঙ্গে মানুষ লাগে, সিআরপিএফ নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের সঙ্গে থাকতে হয়, তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হয়। কেবল আদালত আর মিডিয়াতে চাঁদমুখ দেখিয়ে জেতা যায় না এ শিক্ষা তো বামেদের আছে, বিজেপিরও আছে। বামেরা এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে আদালতে গিয়েছিলেন নাকি? খাদ্যের দাবিতে সওয়াল জবাবে ছিলেন নাকি প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার? মধ্য সত্তরে কংগ্রেসি গুন্ডারা বহু এলাকাতে ঢুকতেই পারেনি, পারেনি কারণ মানুষ সঙ্গে ছিল। অন্যদিকে বিজেপি? বাবরি মসজিদ না ভেঙে আদালতে গিয়েছিলেন নাকি? দেশজোড়া আদবানির রথযাত্রা সে কি এমনি এমনি? কংগ্রেসের হাতে জরুরি অবস্থায় কত ক্ষমতা, কিন্তু মানুষ সব ছক বাতিল করে দিয়ে বলেছিল, সিংহাসন খালি করো, কি জনতা আতি হ্যায়। হ্যাঁ, মানুষ চাইলে, মানুষ সঙ্গে থাকলে কেউ ভোট লুঠ করতে পারে না। বিরাট গন্ডগোল হচ্ছে? দেড় লক্ষ বিরোধী নমিনেশন জমা পড়েছে, সে কি এমনি এমনি। কিন্তু নিজেদের শক্তির ওপর আস্থা নেই, চলে যাচ্ছেন আদালতে, শাসকদল তো চাইছে সেটাই, নষ্ট করুন সমস্ত এনার্জি ওই আদালতেই। বিরোধীরা, বামেরা পারত না দার্জিলিং থেকে ক্যানিং পদযাত্রার আয়োজন করার? যা করলো অভিষেক, তার কাছাকাছিও কিছু একটা করার সংগঠন আছে বামেদের, বিজেপির বা অধীর কংগ্রেসের? নেই। নেই বলেই সহজ শর্টকাট পদ্ধতি হল আদালতে চলে যাও, প্রত্যেক কথায়, প্রত্যেক বিষয় নিয়ে। আমরা মানুষকে সেটাই জিজ্ঞেস করেছিলাম, আদালতে তো জিতছে বিরোধীরা, মাঠে জিতবে কারা? শুনুন মানুষ কী বলছে।
বহু প্রাচীন কথা, মানুষ দুর্বলতা পছন্দ করে না, মানুষ বিজেতাদের পক্ষে থাকে, ইতিহাস লেখে বিজেতা। রাজনৈতিক দল মাঝে মধ্যেই সে সব ভুলে শর্টকাটে রেজাল্ট পেতে চায়, আদালত, থানা আর প্রশাসনের কাছে আবেদন নিবেদন করে অধিকার পাওয়া যায় না, সারা পৃথিবীর ইতিহাস সেটাই বলে। মানুষের সঙ্গে থাকাটাই রাজনীতি, বাকিটা শর্টকাট, কাজেই সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পরে ওই অমোঘ প্রশ্নটা থেকেই যাবে, হ্যাঁ, আদালতে জিতলেন তো বিরোধীরা, শামলা পরা বিকাশ ভট্টাচার্য বা ঋজু ঘোষালেরা, কিন্তু মাঠে? সেখানে কে জিতবে?