আকাশের গায়ে নাক পাতলে ভেসে আসছে বারুদের গন্ধ। টুপটাপ ঝরছে শোক। সুপারপাওয়ারদের নখদন্ত শ্বাপদের আগ্রাসেনের থেকেও হিংস্রতায় ভরা। বেঁচেবর্তে থাকার করুণ আর্তি মিলিয়ে যায় রণহুঙ্কারে। তবুও আতঙ্কের মাঝে ভালবাসা জ্বলজ্বল করে, অনেকটা আবেগ চোবানো বদ্ধভূমির নিস্তেজ প্রান্তরে…
সব ছেড়ে যাওয়ার রাস্তা ঘিরে হালকা তুষারপাত হয়, নিষ্পলক তাকিয়ে থাকার দৃষ্টিতে জয়-পরাজয়ের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষাও মিইয়ে যায়, শুধু থেকে যায় কত না বলা প্রতিশ্রুতি। যুদ্ধের ধু ধু প্রান্তরে দাঁড়িয়ে কথোপকথনে বিশ্বজনীন প্রেমের বার্তায় লেখা থাকে যুদ্ধ ও বারুদের প্রত্যাখ্যান…
আমাদের ফের কবে দেখা হবে?
যুদ্ধ শেষের বছর খানেক পর…
যুদ্ধ কবে শেষ হবে?
যবে ফের আমাদের দেখা হবে…
দেখা সত্যিই কি হবে? গোটা দুনিয়াকে শাসন করার যে ভয়ঙ্কর আক্রোশ যখন মুহুর্মুহু বদলাতে থাকে পুতিনরূপী বিভীষিকায়, তখন ইউক্রেনীয় কবি লুদমিলা খেরসনস্কা তার চারপাশের যুদ্ধ দেখতে দেখতে নিজের শরীর দেখেন,
মানুষের গলায় কবরস্থান,
একটি বুলেট দেখতে একটি চোখের মতো,
সেলাই করা ছিল।
কবি কাতেরিনা কালিতকোর যুদ্ধও একটি শারীরিক দেহ,
প্রায়শই যুদ্ধ আসে এবং শুয়ে থাকে তোমার মাঝে শিশুর মতো
একলা হতে ভয় পায়।
কবিতার ভাষা আমাদের পরিবর্তন করতে পারে বা নাও পারে, তবে এটি আমাদের ভিতরকার পরিবর্তনগুলি দেখায়। কবি আনাস্তাসিয়া আফানাসিয়েভা উত্তম পুরুষ বহুবচন ব্যবহার করে লিখেছেন,
আমরা, আমাদের দেখাচ্ছি কীভাবে একটি দেশের ভোগদখল তার সমস্ত নাগরিককে আক্রান্ত করে, তারা যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন তাতে কী আসে যায়?
যখন একটি কামানসহ একটি চারচাকার যান
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল
আমরা জিজ্ঞেস করিনি আপনি কে
আপনি কার পক্ষে আছেন
আমরা মেঝেতে পড়ে গেলাম এবং সেখানে শুয়ে রইলাম।
কাতিয়া কাপোভিচ আধুনিক রুশ সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি। মেয়েবেলার অনেকটা সময় কেটেছে ইউক্রেনে। এখন মার্কিন প্রবাসী।
ইউক্রেনীয় ও রুশিরা যেন হৃদয়ের ভাইবোন, প্রাচীন কাল থেকে তারা ধর্ম ও সংস্কৃতির ডোরে বাঁধা। তবু বহু ইউক্রেনবাসীর মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়, কৃষ্টির বিনিময়ে বড়দার ভূমিকা নিয়েছে রাশিয়া। সেই ক্ষোভেরই কি বৃহত্তর স্ফুরণ এই দ্বৈরথ?
কাতিয়ার রচনায় এক রক্তক্ষয়ী হানাহানির ছোঁয়া রয়ে গিয়েছে,
ডনবাসের একটি গাঁয়ে বেড়ে ওঠা-
খেলতাম সেখানে আমরা আগে, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা,
খনিজ ধাতুমূলের কালচে ঢিপির মাঝখানে-
সেই খনিটির স্মৃতি আবার দেখতে দাও ফিরে।
সেই, যেখানে পাওয়া গেছে খুঁজে হৃত্পিণ্ড জেনো,
থ্যাঁতলানো একটি চেরির দাগ, চোখে লেগে আছে
একটি ক্ষতচিহ্নের স্মৃতি, গ্রীষ্ম শৈশবের দিন
রিনরিনে স্বর কারও, খতম করেছে।
বেরিয়ে এলাম তারপর, অবরোধ বাধা থেকে।
মৃত, জীবিতেরা একসাথে ফেরে ঘরে,
হৃদয়ের নীচে রয়ে গেল ধাতব টুকরো ছোট,
সে ধোঁকা দিয়েছে জেনো একটি বুলেটে
এখন দেখছি শুয়ে আছি, পুরাতন গ্যালারির মাঝে
বুকে আছে থ্যাঁতলানো চেরি।
আমি ছোট সৈনিকের মতো, বড়দের ব্যাধি নিয়ে।
ওগো জন্মভূমি ইউক্রেন, আমায় মার্জনা করো।
কবির কলম ঝলসে উঠলেও যুদ্ধবিরতির লক্ষণ নেই। থাকার কথাও নয় যদিও। রাশিয়ার আগ্রাসনে জেলেনস্কি পিছু হঠবেন আর নির্ভেজাল আত্মসমর্পণে রণে ভঙ্গ দেবেন, এমনটা ভাবা ভুল। পুতিন ভাবতে পারেন, পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিতে পারেন। তাঁর কাছে পরমাণু অস্ত্র প্রচুর, কিন্তু প্রয়োগ করার দুঃসাহস তিনি দেখাবেন না। 1914-র প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কিংবা 1939-এর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিত ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে, বিষয়টা এত সহজ নয়। বাইডেন চমকাচ্ছেন, পাল্টা চীনের সঙ্গে বৈঠকে বসে পুতিন বোঝাতে চাইছেন, বেড়ে খেলো না। রাষ্ট্রপুঞ্জের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে রাশিয়া-বিরোধী প্রস্তাবের পক্ষে ভোট না দিয়ে ভারত-চীন বোঝাতে চাইছে, আমেরিকার দাদাগিরি মানব না। কিন্তু ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতির বার্তা কীসের ইঙ্গিত? নরম মাটিতে আঁচড়াচ্ছেন পুতিন, ভালই বোঝেন মোদি কিংবা জিনপিং। তবে সে মাটি পশ্চিমি দেশগুলির জল-হাওয়া পেয়ে অতটাও নরম নয়, বিলক্ষণ জানে দুই প্রতিবেশী দেশ। আমেরিকা ও নেটোভুক্ত দেশগুলি ইউক্রেনের পাশে। এই পরিস্থিতিতে বেড়ে খেলার ভুল ভারত-চীন করবে না। শুধু জানান দেবে, আমরাই নির্ণায়ক শক্তি। পরিপ্রেক্ষিত যুদ্ধ হোক বা থামানোর কৌশল। তবে ভয় অন্য জায়গায়। গ্লোবাল অর্থনৈতিক মহামন্দা ও দুনিয়ায় ক্ষুধা-দারিদ্র্য আরো ছেয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটবে না তো? ওয়াল স্ট্রিট পাড়া, গ্লোবাল পুঁজিবাজার, বিজনেস হাউজগুলো রীতিমতো শঙ্কিত। যুদ্ধের এক বছর পেরিয়ে সবাই মোটামুটি বুঝে গিয়েছে, যুদ্ধ নিয়ে মিথ্যে প্রপাগান্ডায় দেশপ্রেম দেখাতেই হবে, এটি কোনও কাজের কথা বা পদক্ষেপ নয়। কারণ কেউ যদি লাগাতার বলে চলে যে, তারা জিতেই চলেছে, তা হলে তো এতদিনে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তা হচ্ছে কোথায়? মোদ্দা কথা, এই যুদ্ধ শুরু থেকেই গ্লোবাল প্রভাবের। আর বাইডেনই এমন একটি যুদ্ধ হয়ত চেয়েছেন। শুরু থেকেই গোটা পশ্চিমি দুনিয়া এক নিজ পক্ষশক্তি খাড়া করতে চেয়েছিল। হয়েছেও তাই। প্রধানত ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো সবাই এমনকি খোদ আমেরিকাও কম বা বেশি পরিমাণে রাশিয়ান তেল অথবা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাই এটি রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে সীমিত একটি যুদ্ধের ঘটনা যতটা না এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি প্রভাবশালী ঘটনা হল, রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ। চলতি ভাষায় বললে যার মানে দাঁড়ায়, রাশিয়াকে ভাতে মারোর পরিকল্পনা ও যুদ্ধ। এটি মূলত বাইডেনের আমেরিকার (ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বগলে নিয়ে) পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এটি কি ইউক্রেন যুদ্ধে জেতার জন্য রাশিয়ার ওপর মুদ্রা অবরোধের যুদ্ধ? শুরুতে এমন দাবি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু এখন অন্য কাউকে বিশ্বাস করানোর আগে তারা নিজেরাই আর তা বিশ্বাস করে না। তাদের লক্ষ্য পরিষ্কার, তারা রাশিয়াকে দেখতে চায় যেন সে ১৯৯১ সালের আগের মতো এক সোভিয়েত ইউনিয়ন, যে রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বব্যাঙ্কের সদস্যরাষ্ট্র যারা ছিল, তাদের কারও সঙ্গে তেমন বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল না। এমনকি সোভিয়েত ব্লক বলে যেসব রাষ্ট্র ছিল, যেমন পোল্যান্ড বা রোমানিয়া, এদের সঙ্গেও ‘বাণিজ্য-প্রধান’ এমন কোনও সম্পর্ক ছিল না। ১৯৯২ সাল থেকে রাশিয়াসহ সব পুরোনো কমিউনিস্ট ব্লকের রাষ্ট্র আইএমএফের সদস্য হয়ে যাওয়ার পরে এখন যেন বাইডেন চাইছেন পুতিনের রাশিয়ার সদস্যপদ শূন্য করে দিতে। কিন্তু তা এতটা সহজ নয়। কারণ, রাশিয়া ইরান নয়। তবে অনেকে অবশ্য প্রশ্ন করতে পারেন, রাশিয়া তো চীনের মতো হবু গ্লোবাল নেতা নয়। স্বাধীন মর্যাদা নিয়ে দুনিয়ায় সামর্থ্য অনুসারে ব্যবসা-বাণিজ্য করে চলতে চায়। পশ্চিমাশক্তির স্বপ্ন ছিল, রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক-সামরিক সব রকমের চাপ সৃষ্টি করে তাকে কোণঠাসা, রিক্ত করে রাখা। আর এর সঙ্গে তারা দেখতে চেয়েছিল রাশিয়ার এই কল্পিত দুস্থ দশা দেখে চীনের প্রতিক্রিয়া কী হয়! রাশিয়াকেই বাঁচাতে ছুটে যায় ও বিপদে জড়ায়, নাকি রাশিয়াকেই হারিয়ে ফেলে। রাশিয়া ও ইরানের একটা মিল আছে। দুই দেশই তাদের তেল-গ্যাস আর কোনও দেশ কিনুক আর না কিনুক, এরা দুজনেই চীনে ২৫ বছর ধরে লাগাতার জ্বালানি সরবরাহ করতে চুক্তিবদ্ধ। আর এটিই এ দুই দেশকে আমেরিকান অবরোধের হাত থেকে, এ দুই দেশের অর্থনীতিকে অন্তত কিছুটা স্থায়ী রিলিফ দিয়েছে। ঠিক এই পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে পড়েছে অন্যতম পশ্চিমি দেশ জার্মানি। তারা হঠাৎ বিশাল গ্যাস সঙ্কটের মুখোমুখি। রাশিয়া প্রায় ৬০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এই কারণেই ইউরোপে রাশিয়া সুবিধাজনক অবস্থায়। কারণ, ইইউ রাষ্ট্রগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সবাই তেল-গ্যাস প্রশ্নে ওই একই রাশিয়ার ওপর কমবেশি পরিমাণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। গ্যাস একদিকে তুলনামূলক ক্লিন এনার্জির উৎস, অন্যদিকে, ইউরোপ মানেই বছরের ছয় মাসের বেশি যেখানে ঘর গরম রাখতে জ্বালানি না পোড়ালে ওসব দেশ বসবাসের অযোগ্য। ফলে ওই জীবনযাত্রা প্রচুর জ্বালানি খরচনির্ভর। এ জন্য তারা অনেকবার বাইডেনকে বুঝিয়েছিল ও সিদ্ধান্তে এসেছিল যে, ২০২৭ সালের আগে তারা রাশিয়ার বিকল্প উৎসের কাছে যাবে না। কিন্তু বাইডেনের চাপের মুখে তারা অনেকেই অপারগতার কথা বাস্তব হলেও উচ্চারণ করতে চায়নি। আবার হাঙ্গেরি বা ইতালির মতো দেশ খোলাখুলি চেঁচিয়ে বলে দিয়েছিল যে, রাশিয়ান গ্যাস ছাড়া তাদের অর্থনীতি চলবে না, তাই তারা কিনতেই থাকবে।
আর এই অবস্থায় খোদ রাশিয়াই গ্যাস বিক্রি বা সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়ে এক ঢিলে অনেক পাখি মারার কৌশল নিয়েছে। অনেকের মনে হতে পারে, রাশিয়া গ্যাস বেচবে না? নিজে এ কথা বলার সামর্থ্য পেল কী করে? হ্যাঁ, রাশিয়ার সেই সামর্থ্য এখন আছে। রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সঠিক নীতি-পলিসি প্রণয়নে সফল যে, অন্য দেশকে আগে রাশিয়ান রুবল কিনে পরে ওই রুবলে মূল্য পরিশোধ করার শর্তেই তেল-গ্যাস কিনতে ক্রেতাকে বাধ্য করতে পেরেছে তারা। ফলে বাইডেনের সুপারপাওয়ার হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। সব মিলিয়ে এখন খোদ আমেরিকাতেই একটি অংশের মনে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার বাঁশি বেজে উঠেছে। তারা বাইডেনের সমালোচনার দিকগুলো তুলে আনা শুরু করেছে। তবে আমেরিকা ও তার সহযোগী দেশগুলো ইউক্রেনে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। যার ফল হবে দুনিয়াতে তীব্র ক্ষুধার সঙ্কট ও গ্লোবাল অর্থনীতির সঙ্কট জটিলতর রূপ নেবে। এ পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন দায়িত্বজ্ঞানশূন্য আচরণ করছে, ব্যর্থ পলিসি আঁকড়ে থেকে চলছে। তাই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সহজে থামার নয়। তবে আপামর বিশ্ববাসী যে যুদ্ধ চায় না, কিছুতেই না।
তাই তো বলতে হয়, আমার বাম হাতে রাশিয়া, ডান হাতে ইউক্রেন। তাহার মাঝে তুমি দাঁড়িয়ে আছো, কী করে সইব এই মরণ! যদি কখনও না ফিরতে পারি, তবে ক্ষমা করে দিও। ক্ষমা কোরো হৃদয় ভরে আমার, চিঠি এল রক্তে লেখা সাদা কাগজের পাতায়। এ যুদ্ধ শেষের যুদ্ধ, তবে মনে রেখো হেরে গিয়েছিলাম, দেশকে রেখে পালিয়ে যাইনি কখনও। হয়ত আবার দেখা হবে কল্পনার জগতে, আর সেখান থেকে তুমি হাত বাড়িয়ে ডেকো আমায়। আমি নিদারুণ অভিমানকে দূরে সরিয়ে, আপ্রাণ ভালবাসব তোমায়।
আমরা, বিশ্ববাসী যে এই ছবিই দেখতে চাই, ফুলের মতো সুন্দর ইউক্রেনের পথঘাটে, নেশাতুর জীবনের কবির মতো, রং-রূপ-গন্ধের পসরা সাজিয়ে বসা দোকানির উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টির মতোই হানাহানি, রক্তক্ষয়ের বীবত্সতা ছাপিয়ে জয়গানের শিখা প্রজ্জ্বলিত থাক অনুচ্চারিত ভালবাসার আখরে।