রাজনীতি স্ক্রিপ্টেড এক্সারসাইজ নয়, সবটা চিত্রনাট্যকার লিখে দেবে আপনি গিয়ে সেই শব্দগুলো আপনার মতো করে উচ্চারণ করবেন, সেই অভিব্যক্তিতে মানুষ মুগ্ধ হবে। ম্যাডাম এটা সিনেমা, আপনি সিনেমা করেন কিন্তু আপাতত এটা রাজনীতির আঙিনা, এখানে আপনাকে প্রশ্ন শুনতে হবে, প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। হ্যাঁ, এই কথাগুলো নুসরত জাহানের জন্যই বলছি। তিনি তো কেবল অভিনেত্রী নন, বিউটি কুইন নন, তিনি একজন সাংসদ। আজ যখন রাজ্যজুড়ে শাসকদলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, দুর্নীতির দায়েই শাসকদলের নেতারা যখন জেলে তখন দুর্নীতির আরেকটা অভিযোগ দলকে বিব্রত করবে বইকী। কাজেই আপনি দুর্নীতির অভিযোগ শুনেই নিজেই সাংবাদিক বৈঠক ডেকেছেন, বেশ করেছেন, প্রথম পদক্ষেপকে স্বাগত, কিন্তু তারপর? দুটো ব্যাঁকা প্রশ্ন শুনেই মেজাজ হারালে চলবে? আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটা তো খুব হালকা নয়। প্রবীণ সহনাগরিকরা তাদের প্রাপ্য পাননি, তাঁদের ঠকানো হয়েছে, তাঁরা অভিযোগ করছেন, আপনাকে তো সে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে এই অগ্নিপরীক্ষা আপনাকে বার বার দিতে হবে, আপনাকে আরও বেশি দিতে হবে কারণ আপনি উড়ে এসে জুড়ে বসে সাংসদ। রোজকার মিছিলে থাকেননি, পুলিশের লাঠির ঘায়ের ওজন জানেন না, মানুষের অভাব অভিযোগের বারমাস্যায় আপনি ছিলেন না। টলিগঞ্জের তথাকথিত মেন স্ট্রিম সিনেমার অভিনেত্রী হিসেবে ল্যাটারাল এন্ট্রি মিলেছে, তাই বলে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না, প্রশ্ন শুনেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে সুচিত্রা সেন বনে যাবেন তা তো হয় না। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, নুসরত আপনি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন।
রাজনীতি তো সর্বত্র, এমনিতে পেশাদার রাজনীতিবিদেরা আছেন যাঁরা রাজনীতি ছাড়া আর কিচ্ছুটি করেন না। আছেন তো, আমাদের রাজ্যে একমাত্র বিধান রায় আর সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এই দুই কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ দিলে প্রত্যেকেই ছিলেন ২৪ ঘণ্টার রাজনীতিবিদ, বিধান রায় প্রখ্যাত ডাক্তার ছিলেন, ডাক্তারি ছাড়েননি। আর সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ছিলেন আইনজীবী, শেষ দিন পর্যন্ত আইন পেশায় ছিলেন। বাকি সব্বাই ১০০ শতাংশ ২৪ ঘণ্টার রাজনীতিবিদ। বাংলার রাজনীতিতে বেশিরভাগই তেমনটাই, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, বিজেপি, নকশাল নেতাদের সিংহভাগই ওই পেশাদার রাজনীতির মধ্যেই পড়েন। অভিনয়, মেডিক্যাল ইত্যাদি পেশার খুব কম মানুষজন সরাসরি রাজনীতিতে এসেছেন। অধ্যাপনা বা আইনজীবী পেশার বহু মানুষ এসেছেন, কিন্তু যাঁরা এসেছেন তাঁদের অধ্যাপক বা আইনজীবী হিসেবে সেই নামডাক আছে এমনও নয়, তাঁরাও ওই ২৪ ঘণ্টার পেশাদার রাজনীতিবিদদের মধ্যেই পড়েন।
আরও পড়ুন: Aajke | পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি চিরটাকাল দিল্লি বিরোধী, এটাই বাংলার চরিত্র
কিন্তু বিশেষ করে ২০১১ পরবর্তীতে সব্বাইকে চমকে দিয়ে বাংলা সিনেমার বেশ কিছু নায়ক নায়িকা রাজনীতিতে নামলেন বা তাঁদের নামানো হল। সেসব বিখ্যাত মানুষজন রাজনীতিতে এসে নতুন কী দিলেন? দেব এক ধরনের রাজনৈতিক সৌজন্যের কথা বলেন যা আজকের রাজনীতিতে এক্কেবারেই অর্থহীন। মিমি বা নুসরত, সোহম ওই আছেন, মাঝেমধ্যে তাঁদের নিয়ে রসালো গপ্পো হয়, গসিপ ভাসে, কিন্তু রাজনৈতিক কথা তাঁরাও ভুলে বলেন না, মানুষ যে খুব আশা করেন তাও নয়। তৃণমূলের সায়নী আর বিজেপির লকেট সেই অর্থে ব্যতিক্রম যাঁরা মন দিয়েই রাজনীতি করছেন। কিন্তু এঁদের প্রত্যেকের মধ্যেই ওই অভিনেতা সত্তা জেগে জেগে ওঠে। কিন্তু রাজনীতি আর অভিনয় তো এক নয়, রাজনীতির বিরাট চাহিদা, মিডিয়া বুমের পরে যখন রাজনৈতিক নেতাদের যাবতীয় তথ্য প্রত্যেকের কাছেই এসে গিয়েছে, তখন মানুষ তাদের প্রতিনিধিকে তাদের সঙ্গে পেতে চায়, তাদের মতো করেই পেতে চায়। সেই জন্যই তারা এমপি-কেও চায় তাদের দরজায়, তাদের মহল্লায়, তাদের বিয়েবাড়িতে, তাদের আনন্দে বা শোকে। এমনি এমনি তো একজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে ওঠে না, তার জন্য সেই জনসংযোগটাও দরকার। আপনি বলতেই পারেন এঁদের তো লক্ষ্য ওই রাজনীতিবিদ হওয়া নয়। আপনি ঠিকই বলছেন, আর সেটাই সমস্যা, একটা ছোট অভিযোগ এলেই যাঁরা মিডিয়ার সামনেও মেজাজ হারাবেন, যাঁরা মিডিয়াকেই যাবতীয় দোষের ভাগীদার বলে সমস্যা থেকে পালানোর চেষ্টা করবেন, করছেন, এটাই স্বাভাবিক। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, সিনেমা অভিনয়, গান ইত্যাদি জগৎ থেকে যাঁদেরকে সরাসরি সাংসদ, বিধায়ক বা দলের বড় পদে বসানো হল, তা সে যে কোনও দলেরই হোক না কেন, তাঁরা কি তাঁদের পেশার কাজ ছেড়ে দলের কাজ, দেশের কাজ মানুষের কাজ করেন? করতে পারেন? শুনুন মানুষ কী বলেছেন।
জেলেনস্কি, ভোলোদিমির আলেক্সান্দ্রোভিচ জেলেনস্কি ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী। এই সেদিনেও মানুষ তাঁকে চিনতেন একজন স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান বলেই, কেউ কেউ এটাও জানতেন যে তিনি একজন চিত্রনাট্যকার। কিন্তু তিনি কেবল রাজনীতিতে নামেননি, ইউক্রেনের এই জটিল রাজনৈতিক সময়ে দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এমনটা আরও আছে, কিন্তু তাঁরা হয়ে উঠেছেন মানুষের ভরসার জায়গা, মানুষের কাছের লোক। রাস্তায় নামলে মানুষ এসে হাত মেলাচ্ছে, জেলেনস্কির হাতে গ্লাভস তো নেই। আজ নয়, মাত্র ক’দিন আগের ছবি, মমতা সিঙ্গুরের মাঠে, মানুষ এসে হাত দিয়ে কেবল ছুঁয়ে যাচ্ছে, মমতা হাসছেন, হাতটা বাড়ানো। সেই দলের নেত্রী দৃশ্যতই বিব্রত, জানিয়ে দিয়েছেন, নুসরত তাঁর নিজের জবাব নিজেই দেবেন। হ্যাঁ, নুসরত, প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলে চলবে না, উত্তর দিতে হবে, কারণ অভিযোগটা দুর্নীতির।