তারিখ পে তারিখ, তারিখ পে তারিখ— সিনেমাতে সানি দেওল বলেছেন। অনেকেই বলে আদালত বিচার দেয় না, তারিখ দেয়, তারিখ পে তারিখ। ভুল বলে, বিলকুল ভুল। তারচেয়ে অনেক বেশি তারিখ দেয় রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক নেতারা, সরকার, হরেক কিসিমের সরকার। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দেশের মানুষকে বলেছিলেন, কালোবাজারি, আড়তদারি বন্ধ করে তাদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাব। আজাদি কা অমৃত মহোৎসব চলছে, ৭৫ বছর পার হয়ে গেল, কালোবাজারি বন্ধ হয়নি, আরও বিস্তৃত হয়েছে। এখন কৃত্রিম অভাব তৈরি করা যায়, তেল থেকে দানা শস্য, পেঁয়াজ থেকে আপেল গোডাউন বন্ধ রেখে দাম বাড়িয়ে নেওয়া যায়। অথচ জওহরলাল নেহরুর পরে আরও ১৩ জন প্রধানমন্ত্রী এসে গেছেন, তারিখ পে তারিখ, কালোবাজারি বন্ধ হয়নি। সেই প্রতিশ্রুতির ক’দিন পরেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন সেই অনবদ্য ক’টা লাইন, ল্যাম্পপোস্টে জোড়াবলদ লটকে, শকুনেরা চোখ মটকে, বলে ভোট দে। ল্যাম্পপোস্টে আজও কত শত নির্বাচনী প্রতীক ঝোলে। ৬৭ নির্বাচনের কিছুদিন আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্লোগান দিলেন, রোটি কপড়া আউর মকান, মাঙ্গ রহা হ্যায় হিন্দুস্তান। জনপ্রিয় হল স্লোগান। ইন্দিরা গান্ধী, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেন, কিন্তু রোটি কপড়া আউর মকান? না, ভারতবর্ষে এখনও বিশাল সংখ্যক লেংটি পরা মানুষ রুটির স্বপ্ন দেখে। গরিব মানুষের রুটির স্বপ্ন রুপোলি পর্দায় চলে এল, ১৯৭৪ এ সিনেমা তৈরি হল, রোটি কপড়া আউর মকান, লোকের মুখে মুখে গান—
হায় মহেঙ্গাই মার গয়ি,
শক্কর মে ইয়ে আটে কি মিলাই মার গয়ি
পাউডার ওয়ালে দুধ দি, মালাই মার গয়ি
রেশনওয়ালে লাইন কি লম্বাই মার গয়ি
জনতা যো চিখি, চিল্লাই মার গই
বাকি কুছ বচা তো মহেঙ্গাই মার গই
মনোজ কুমার, অমিতাভ বচ্চন, শশী কাপুর, জিনাত আমান, মৌসুমি চ্যাটার্জি, ১৯৭৪ এ সবথেকে বেশি টাকা কামাল এই ছবি আর ২২তম চলচিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবি, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ গীতিকার, শ্রেষ্ঠ সুরকার, শ্রেষ্ঠ গায়ক, শ্রেষ্ঠ গল্প সব পুরস্কারই পেল এই ছবি। কিন্তু গরিব আরও গরিব হল। আরও মজার ব্যাপার হল ততদিনে স্লোগান পালটে গেছে, এবার নতুন স্লোগান গরিবি হঠাও, তারিখ পে তারিখ, স্লোগানের পরে আবার স্লোগান, আপাতত আমরা হাঙ্গার ইনডেক্স, ক্ষুধা নির্দেশিকায় বিশ্বে ১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭, আর মহেঙ্গাই? জিনিসপত্রের দাম? সবাই জানেন। কিন্তু ১৯৭৫-এর স্লোগান ছিল গরিবি হঠাও, মহেঙ্গাই ভাগাও। এরপর রাজনেতারা আর ট্যাঞ্জিবল কিছু নিয়ে, মানে মাপা যায় এমন কিছু নিয়ে মাঠে নামলেনই না, জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে স্লোগান উঠল গণতন্ত্র ফেরাও, গণতন্ত্র বাঁচাও। কোনটাকে গণতন্ত্র বলে? একজন ৮০ ঊর্ধ্ব জেসুইট ফাদারকে বিনা প্রমাণে জেলে রেখে মেরে ফেলা? দেশের বেআইনি মুদ্রা লেনদেন বন্ধ করার এজেন্সির ১০০টার মধ্যে ৯৫টা রেড, মামলা বিরোধী নেতা, বিরোধী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, এটা গণতন্ত্র? সেই জরুরি অবস্থার দিনগুলোতে বিজেপির নামকরা সব নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলী মনোহর জোশি, আরএসএস-এর নানাজি দেশমুখ প্রত্যেকেই তো গণতন্ত্র বাঁচানোর স্লোগান দিয়েছিলেন। গঙ্গা যমুনা দিয়ে জল বয়ে গেছে, তারিখ পে তারিখ চলা গয়া, গণতন্ত্র এখন ভাগাড়ে, শকুনেরা গণতন্ত্রের অবশিষ্ট মাংসও খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। জরুরি অবস্থা শেষ হয়েছে, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েই শুরু হয়েছিল, দিন ঘোষণা করেই জরুরি অবস্থা শেষ হয়েছে, কিন্তু তার বদলে এখন অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। এর পরে একটা তারিখ কিন্তু মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, লালকৃষ্ণ আদবানি রথে উঠলেন, দাঙ্গা হল, অজস্র লোক মারা গেল, নেতারা স্লোগান দিলেন, মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে। স্কুল নয়, কলেজ নয়, ইস্পাত কারখানা নয়, বিদ্যুৎ প্রকল্প নয়, রামলালার মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে। স্বাধীনতার পরে এই প্রথম রাজনৈতিক নেতা, রাজনৈতিক দল তাদের কথা রাখল, আদালতের রায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাবরি মসজিদ ভাঙা হল, তারপর আবার আদালতেরই রায় নিয়ে রামমন্দিরের শিলান্যাস হল, উদ্বোধনও হয়ে যাবে। স্বাধীনতার পর থেকে এই প্রথম রাজনৈতিক নেতা, এক ধর্মনিরপেক্ষ সরকার হিন্দুদের আরাধ্য রামলালার মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। আমরা মোদি জামানাতে ঢুকে পড়েছি, যেখানে হিন্দুরাষ্ট্র তৈরির স্লোগান উঠছে, কাজও চলছে, বিধর্মী দেখলে জয় শ্রী রাম বলাও, পিটিয়ে মারো, বাজারে গিয়ে জানিয়ে দাও জবাই বন্ধ, গরু নিয়ে যাচ্ছে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলো। যা বলেছে আরএসএস ১৯৪৮-এ, তাই অক্ষরে অক্ষরে পালন হচ্ছে। কিন্তু দারিদ্র? ক্ষুধা? বেকারত্ব? মূল্যবৃদ্ধি? সেই রোটি কপড়া আউর মকান? আবার সেই তারিখ পে তারিখ, কেবল প্রতিশ্রুতি। নিন একটি মণিমাণিক্য তুলে ধরছি, ২০১৮, ৩ রা ডিসেম্বরে তেলঙ্গানা রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারে গিয়ে মোদিজি কী কী বলেছিলেন শুনুন।
( https://youtu.be/aQq_jZcpl3U 1.05 – 1.59)
২০২২-এর মধ্যে সবকা পক্কা ঘর হোগা, কেবল কি ঘর? ঘরে নল থাকবে, নলে জল থাকবে, এলইডি বাল্ব থাকবে, ডাইনিং টেবলে হায়দরাবাদি বিরিয়ানি থাকবে এই কথাটাই যা বলেননি। নাটকীয় সুরে, গলা কাঁপিয়ে বলেছেন, ওই কংগ্রেসের মতো প্রতিশ্রুতি নয়, কেবল চারটে দেওয়াল নয়, খাওয়া দাওয়ার পরে পাকা শৌচালয়ও থাকবে সেই ঘরে, কতদিনের মধ্যে? ২০২২-এর মধ্যে, কেন ভাই ২০২২ কেন? কারণ আজাদি কা ৭৫ সাল পুরা হোগা, আমরা অমৃতকালে ঢুকে পড়ব, দেশের প্রত্যেক গৃহহীন মানুষ ঘর পাবে। এখন গজনী সিনেমার আমির খান, তফাত হল এখানে শর্ট টার্ম, লং টার্ম দুটো মেমোরিই লস হয়ে গেছে, মিথ্যে বলেছিলেন, ভুলে মেরে দিয়েছেন, আর এখন? লখনউতে আজাদি কা অমৃত উৎসবে আবার আরেকটা বীজ পোঁতার কথা বলছেন, সে গাছ নাকি ২০৪২-এ ফল দেবে। ২০৪২-এ মোদিজির বয়স কত হবে? ৯২, তখন আবার অন্য আরেক তারিখ পাওয়া যাবে। তো আসুন একটু বাস্তব ছবির দিকে নজর রাখা যাক। আমাদের দেশে গৃহহীনদের সমস্যা কোন পর্যায়ে, আলোচনা করতে গিয়েই থমকে যাবেন। আমার দেশের সরকার কোন জঙ্গলের তলায়, কোন পাহাড় খুঁড়লে কত তামা, লোহা বক্সাইট পাওয়া যাবে তার হিসেব করে রেখেছে, কোন জাহাজ বন্দর, কোন উড়োজাহাজ বন্দর বেচে দিলে, কাকে বেচা হবে, কত টাকায় বেচা হবে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব আগাম ঠিক করে রেখেছে। কোন প্রান্তে কত টাকার ফ্লাইওভার হবে, কত টাকার মূর্তি হবে, কত টাকার মন্দির হবে তা ঠিক করে ফেলেছে, কিন্তু দেশের গৃহহীনদের সংখ্যা ঠিক কত? মানে রাস্তা, ফুটপাথ, ডাস্টবিনের পাশে, রাস্তার ধারে রাখা পাইপের ভেতরে যে মানুষজন আছেন, তাঁদের সংখ্যা কত? গ্রামেও যারা খোলা আকাশের নীচেই শুতে বাধ্য হয়, তাদেরই বা সংখ্যা কত, তা জানার কোনও চেষ্টাই করেনি। গৃহহীন মানুষদের ঘর দিতে গেলে প্রথমে তো জানতে হবে, কত মানুষের মাথার তলায় ছাদ নেই। না, সরকার বাহাদুর সেরকম কোনও হিসেব করেনি, তাহলে? তাহলে ভরসা বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগত কিছু সার্ভে। তো সেখান থেকে খুব কনজারভেটিভ, খুব কম করে ধরলেও যে সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে তা হল সাড়ে চার কোটি পরিবারের মাথায় ছাদ নেই, তাদের বাড়ি নেই। অর্থাৎ পরিবারের সংখ্যা ৫ জন ধরলে, দেশের ২২-২৩ কোটি মানুষের ঘর নেই, এটা আজকের হিসেব, প্রধানমন্ত্রীর কথা মতো এদের ঘর, কল, জল, শৌচালয় সব পাওয়ার কথা এই আগস্ট মাসে, যেদিন স্বাধীনতা ৭৫ বয়সে পা দেবে। এবং মাথায় রাখুন এই সংখ্যাটা হল কেবল তাদের, যাদের ঘর বলতে কিছুই নেই। এরপর হল জুগগি ঝোপড়ি, কোনওভাবে মাথা গুঁজে বেঁচে থাকা, কী ভাবে? কেন অস্কার পাওয়া ছবি স্লামডগ মিলিওনিয়ার দেখে নিন, চলে যান মানিকতলা, ঢাকুরিয়া খালপাড় বস্তিতে। সবকা ঘর, ঘর মে কল, কল মে জল, এসব বাওয়ালি দিতে গেলে একটা মারও নীচে পড়বে না। এই মুহূর্তে দেশের ৪৫ কোটি মানুষের কাছে পানীয় জল পৌঁছয়নি, জল বলে যেটা খান, সেটা কোনও সাহেবকে নয়, মোদিজিকেই খাওয়ালে দিন দশেক হাসপাতালেই থাকতে হবে। কতটা নির্লজ্জ হলে এরকম মিথ্যে বলে দেওয়া যায়, এবং বলার সময়ে চোখেমুখে মিথ্যে বলার চিহ্নমাত্র নেই। একেই মনোবিদরা প্যাথোলজিকাল লায়ার বলে। পার্থ চট্টোপাধায়, অনুব্রত মণ্ডল চুরি করেছেন? চটি ছুড়বেন, ইচ্ছে হলে বেশক ছুড়ুন, কিন্তু এখানে কী ছুড়বেন? সেটাও তো ঠিক করতে হবে। দেশের প্রতি সাতজনের একজন রাতে যখন শুতে যান, তখন মাথার ওপর থাকে খোলা আকাশ, বৃষ্টি পড়লে, জন্তু জানোয়ারের মতো মাথা বাঁচাতে অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে। দেশের প্রতি ছ’জনের একজনের বাড়িতে স্যানিটারি টয়লেট, শৌচালয় নেই। মহিলারা ভোর তিনটেয় ওঠেন, অন্ধকার ঢাকে লজ্জা, কৃষ্ণ নয়। দেশের প্রতি তিনজনের একজন পরিস্রুত পানীয় জল পায় না। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, আমলা দামলা, বিচারক, সাংবাদিকদের টেবিলে মিনারেল ওয়াটার থাকে। শুনিনি কোনও বিচারককে এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে কোনও কথা বলতে। দেশ স্বাধীন, আমার একটা ভোট, আপনারও একটা। কেউ ১৫০০ টাকা দামের মিনারেল ওয়াটার খাবে, কেউ নোংরা নর্দমার জল, এ কোথাকার ন্যায়? কোনও ঘোষ, গাঙ্গুলি, ভট্টাচার্য কালো শামলা পরে দেশের নেতাদের বিচারের কাঠগড়ায় এনে তো দাঁড় করানোর কথা বলেন না। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি? কতজনের? ১০-১৫-৫০ হাজার, দু’ লক্ষ, ৬ লক্ষ? ২০ কোটি মানুষের ঘর নেই। আম্বানির অ্যান্টিলায় প্রত্যেকটা কুকুরের আলাদা ঘর আছে, ২০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকায় তৈরি সেই বাড়ি, হ্যাঁ, ২০,৬৭২ কোটি টাকায় তৈরি ২৭তলা বাড়ি, যাতে গাড়ি রাখার গ্যারাজ আছে ১৬৮ খানা, সিনেমা হল আছে, সুইমিং পুল আছে, ৫০ জন বেদজ্ঞ পণ্ডিতকে দিয়ে পুজো করিয়ে গৃহপ্রবেশ হয়েছিল। এসব ধর্মাবতারের চোখে পড়ে না, ধর্মাবতারের কাছে খবর নেই বা ধর্মাবতারের সাহসে কুলোয় না, এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু বলার, যে লোকটা কিছুদিন আগেই সর্বসমক্ষে মিথ্যে কথা বলেছে তাকে ডেকে নিয়ে এসে জেলে পোরার। একধারে দেশের প্রধানমন্ত্রী মিথ্যে বলছেন, অন্যধারে নিরাশ্রয় মানুষ ফুটপাথে দিন কাটাচ্ছেন, আরেক ধারে প্রধানমন্ত্রীসখা আম্বানির কুকুরেরাও এসি ঘরে রাত কাটায়। এরথেকে অশ্লীল আর কীই বা হতে পারে। বছর শেষ হয়ে এল, রাজনৈতিক নেতাদের কথা বললাম, একটু রাজনৈতিক ভাঁড়েদের কথাও বলা যাক। মন খারাপ থাকলে আমার অ্যাডভাইস, কাঁথির টাচ মি নট খোকাবাবুর ভিডিও দেখে নিন, হাসতে হাসতে মন ভালো হয়ে যাবে। তো এই ভাঁড়ও তারিখ দিয়েছে, সব তারিখ পেরিয়ে গেছে, এখন তারিখ নয় বছরের কথা বলছেন, কী কথা? বিনা নির্বাচনে, মানুষের রায় ছাড়াই ওনার বাংলার মসনদে বসার ভারি শখ, উনি সেই শখপূরণ করার কথাই বলে যাচ্ছে। সংবিধান হত্যার কথা বলছেন, তো পাগলের গো বধে আনন্দ, কী আর করা যাবে, বছর শেষে বিশুদ্ধ ভাঁড়ামি উপভোগ করুন, হাসুন, ভালো থাকুন, দেখা হবে নতুন বছরে।