মনোনয়ন পর্ব শেষ। ঘোষণা থেকে মনোনয়ন পর্ব শেষের মধ্যে ভাঙড়ে দু’জন আইএসএফ কর্মী, খড়গ্রাম আর ডোমকলে দু’জন কংগ্রেস কর্মী, ভাঙড় আর নবগ্রামে একজন করে মোট দু’জন তৃণমূল কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ গুলিতে, কেউ বোমাতে। মোদ্দা কথা হল খুব শান্তিতে শুরুয়াতের যে দাবি বা আশ্বাস ছিল, তা কিন্তু হল না। আর মর্নিং শোজ দ্য ডে, কথাটাকে ধরে নিয়ে যদি এগোই তাহলে আগামী দিনে আরও রক্ত ঝরবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই মনোনয়ন পর্বের শেষে ছবিটা কী রকম? এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী কমবেশি ৯০ শতাংশ মনোনয়ন জমা পড়েছে, মানে ৯০ শতাংশ আসনে নির্বাচন হবে। বিজেপি ৬০ হাজারের মতো আসনে প্রার্থী দিয়েছে, বাম ৫৪ হাজারের মতো আসনে প্রার্থী দিয়েছে, তৃণমূলের ৮২ হাজারের মতো প্রার্থী নমিনেশন জমা করেছে। এদিকে মোট আসন ৭৩ হাজার ৮৮৭, তার মানে প্রায় আট সাড়ে আট হাজার বেশি জমা পড়েছে যা পরে প্রত্যাহার করা হবে বা ডামি হিসেবে থেকে যাবে বা শেষমেশ তাঁরা প্রতীক চিহ্ন না পেয়ে গোঁজ প্রার্থী হিসেবেই থেকে যাবেন। ২০১৮তে ৩৫ শতাংশের বেশি আসনে বিরোধীরা প্রার্থীই দিতে পারেনি, এবার ৯০ শতাংশ আসনে বিরোধীরা লড়ছে, এটা কিছুটা উন্নতি তো বটেই। কিন্তু সেই উন্নতি বিরোধীরা চাপ না দিলে কি হত? বিরোধীরা রুখে না দাঁড়ালে কি হত? নাকি এটাই স্বাভাবিক, সংগঠন আছে যাদের তারা একদিনে ৪০ হাজারের মতো নমিনেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। কাজেই এবার ওই ৯০ শতাংশ আসনে নির্বাচনে এই মুহূর্তে কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা দেখে নেওয়া যাক। এটাই বিষয় আজকে, মনোনয়ন শেষ, এই পর্বে কারা এগিয়ে? কারা পিছিয়ে?
জলের মতো সোজা হিসেব, পঞ্চায়েত ধরে রাখতে পারলে, এ রাজ্যের ধমনী শিরার দখলদারি পাওয়া যায়। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার কাজ হয়, বহু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সেই লাভের গুড় বা মধু। পঞ্চায়েত হাতে থাকলে তবেই তো ওই গড় গড় করে আউড়ে যাওয়া প্রকল্প, স্বাস্থ্য সাথী, সবুজ সাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, রূপশ্রী, কন্যাশ্রীর সাহায্য পৌঁছে দেওয়া যায় মানুষের কাছে। এই হিসেব বিজেপি, বাম, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস সব্বাই জানে। কাজেই সর্বশক্তি দিয়েই লড়বে সবকটা দল। কিন্তু কে কোথায় ছিল এই ক’দিন আগে, বিধানসভা নির্বাচনে? তৃণমূল পেয়েছিল ৪৭.৯৪ শতাংশ ভোট, বিজেপি ৩৭.৯৭ শতাংশ, সিপিএম ৪.৭৩ শতাংশ, কংগ্রেস ২.৯৩ শতাংশ, আইএসএফ ১.৩৬ শতাংশ ভোট। হ্যাঁ, এর মধ্যে শিক্ষা দুর্নীতির প্রশ্ন এসেছে, এসেছে ইডি, সিবিআই, শাসকদলের নেতাদের জেলে পোরা হয়েছে। এটা যেমন ঠিক, তেমনই ঠিক দুয়ারে সরকার, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্য সাথীও হয়েছে, দিদিকে বলো হয়েছে, এখন সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীও হচ্ছে। রাজ্যের জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ মানুষ সরকারের ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারি।
আরও পড়ুন: Aajke | বাম জমানাতেও গোলাপ আর ঠান্ডা জল ছিল না, সেদিনও পড়ত লাশ
আবার অন্যদিকে বেশ ক’টা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করতে পেরেছেন দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদার বা শুভেন্দু অধিকারী। উত্তরবঙ্গে তাঁদের সংগঠন ধরে রাখতে পেরেছে বিজেপি। একের পর এক ইডি হানা, সিবিআই হানা বা ইনকাম ট্যাক্স হানা দিয়ে মানুষের কাছে একটা ছবি তৈরি করাতে পেরেছে বিজেপি, ক্রমাগত কোর্ট আর রাজ্যপালের কাছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গিয়েও এক ধরনের প্রচারে থেকেছে বিজেপি। কিন্তু তাদের দক্ষিণবঙ্গে সংগঠন, মানুষের সঙ্গে থেকে লড়াই, আন্দোলন কোথায়? অন্যদিকে বাম কংগ্রেসের জোট খুব বিশ্বাসযোগ্য নয়, মাঝে মধ্যেই সুরতাল কাটছে। বামেদের সংগঠনের নিচুতলায় এখনও তেমন শক্তপোক্ত চেহারা নেয়নি, কংগ্রেস এখনও সারা রাজ্যে নয়, ওই মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদিয়ার খানিক জায়গায়। যদিও বামেরা বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তোলার লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, বিধানসভায় শূন্য হওয়ার পরেও বহু নতুন ছেলেমেয়ে বামেদের হয়ে রাস্তায় নামছে এটাও বড় ব্যাপার। কিন্তু মোটের ওপর বাম কংগ্রেসের বেশ কিছুটা ভোট বাড়বে এটা নিশ্চিত, বিজেপির মোট ভোট কোনও ভাবেই ৩০ শতাংশের বেশি হবে না, নির্দ্বিধায় একথা বলা যায়। মানে তাদের বেশ কিছুটা ভোট কমছে, হুগলি, বর্ধমান, নদিয়া, বাঁকুড়া, দুই চব্বিশ পরগনাতে বিজেপির ভোট অনেকটা কমবে, সে ভোট যাবে বাম-কংগ্রেসের দিকে। মানে ক্রমে ক্রমে আমাদের রাজ্য ক্লাসিকাল ট্রায়াঙ্গল কনটেস্ট, তিন দলের যুদ্ধের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। যেখানে শাসকদল ৪০ শতাংশ ভোট পেলেই ৭৫-৮০ শতাংশ আসন জিতে ক্ষমতায় আসবে। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তেমনই একটা ছবি দেখা যাবে, আসনের হিসেব বলা সম্ভব নয়, কিন্তু ভোটের শতাংশ হিসেবে তৃণমূল কমবেশি ৪২-৪৩ শতাংশ, বিজেপি ২৮-৩০ শতাংশ আর বাম-কংগ্রেস ১৮-২০ শতাংশ ভোট পাবে। তার মানে এখনই তৃণমূলের উপর বড় চোট নেমে আসবে তেমন নয়। কিন্তু আগামী দিনে বিজেপি যদি আরও কমে, বিজেপি আবার তাদের ৮-৯ শতাংশে ফিরে যায়, তাহলে বাংলায় নতুন সমীকরণ তৈরি হবে, তার আগে পর্যন্ত এই স্থিতাবস্থা মোটামুটি বজায় থাকবে। আমরা মানুষের কাছে এই প্রশ্ন নিয়েই গিয়েছিলাম, পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটা? নাকি বাম কিছুটা বাড়বে, বিজেপি খানিক কমবে আর তৃণমূল কমবেশি একই জায়গায় থাকবে? মানুষ কী বললেন শুনুন।
আমাদের রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এখানে পালাবদলে সময় লাগে, এ রাজ্য কেরল বা রাজস্থান নয়, এবারে এক দল তো অন্যবারে অন্য দল, এ রাজ্যে হয় না। মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে এক শাসনের উপরে, এক দলের ওপরে আস্থা রাখে, মধ্যে দুটো স্বল্পসময়ের যুক্তফ্রন্টের সময়কে বাদ দিলে ৫২ সাল থেকে ৭৭ কংগ্রেসের শাসন, তারপর ৭৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বাম শাসন এবং তারপর তৃণমূলের শাসন। এই ১২ বছরে এমন কিছু হয়নি যাতে রাজ্যের রাজনৈতিক পালাবদল হবে। কিন্তু এরই সঙ্গে এটাও ঠিক যে এই ক্ষয় খুব ধীরে হলেও আগামী পতনের লক্ষণ, তৃণমূলের বিরুদ্ধে এক বড় অংশ মানুষের চলে যাওয়ার কারণ খুঁজে তা সামলানোর দায় তৃণমূলকেই নিতে হবে, তা না হলে ইতিহাস বড্ড রূঢ়, ক্ষমাহীন, তা তো আমরা জানি। ২০০৬-এর ২৩৫, ২০১১-তে ৩৫ হয়ে গিয়েছিল, ২০২১-এ শূন্য, এটাও তো আমরা দেখেছি।