পটনা, ৯ অগাস্ট: দু’দশক আগে দেখা যেত এ রকম দৃশ্য! একই মঞ্চে লালুপ্রসাদ ও নীতীশ কুমার (বর্তমানে শুধু অসুস্থ লালুর জায়গায় তাঁর ছেলে তেজস্বী যাদব)। প্রতিপক্ষ নয়, মিত্র হিসেবে। বহু বছর ধরেই আমূল পাল্টে গিয়েছিল সেই ছবি। কিন্তু আজ রাজ্য-রাজনীতির দুই যুযুধান শিবির যেন ফিরে গেল কুড়ি বছর আগে। একই মঞ্চে, জোটবদ্ধ হয়ে সমস্বরে জানিয়ে দিল, কমণ্ডল রাজনীতিকে রুখতে আবার মণ্ডল রাজনীতি এখন বিহারের ভবিষ্যৎ।
বিজেপি বিহারকে অনেক নিচে নামিয়ে দিয়েছে। তাই বিহারের স্বার্থে বাধ্য হয়েই বিজেপি ছেড়েছেন বলে দাবি করলেন নীতীশ কুমার। তাঁর আরও দাবি, সাত দলের বিধায়ক সঙ্গে আছেন। ১৬৪ জন বিধায়ক নিয়ে নতুন সরকার গঠন হবে বলেও মঙ্গলবার দাবি করলেন বিহার-মহাগাঁটবন্ধনের নেতা নীতীশ কুমার। এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন নীতীশ। তার পরই পাটলিপুত্রে কংগ্রেস-আরজেডি-সহ সাত বিরোধী দল নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর নতুন সরকার গঠনের দাবি জানান নীতীশ। প্রসঙ্গত, নীতীশের দল জেডিইউয়ের বিধায়ক সংখ্যা এখন ৪৫। নীতীশকে সমর্থন করার ইঙ্গিত দিয়েছে কংগ্রেস। তাদের বিধায়ক সংখ্যা ১৯। সমর্থনের ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন সিপিআইএমএলের ১২ জন বিধায়ক। সিপিআই এবং সিপিএমের বিধায়ক সংখ্যা চার। এক জন নির্দল বিধায়কও নীতীশকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। আর তেজস্বী আরজেডির হাতে ৭৯ বিধায়ক।
এ দিন বৈঠকের পর আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব বলেন, গোটা বিহারে বিজেপি একা পড়ে গিয়েছে। রাজ্যের নৈতিক পতনের জন্য বিজেপি দায়ী। শুধু বিহার নয় বিজেপির অপশাসনের ফলে দেশের পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ হয়ে গিয়েছে। জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে। দেশের মানুষ বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। মানুষ এখন বিকল্প সরকারের খোঁজ করছে। তেজস্বীর আরও দাবি, বিরোধীদের কণ্ঠস্বর রোধ করার চেষ্টা করছে বিজেপি। দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। সেই কাজই আমরা শুরু করলাম। গণতন্ত্র-সংবিধান-দেশ বাঁচানোর জন্য এই মহাজোটবন্ধন দরকার ছিল। সেই কাজই আমরা আর সম্পূর্ণ করলাম-দাবি তেজস্বী যাদবের।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে মুখ্যমন্ত্রী থাকছেন সেই নীতীশ কুমারই। শুধু রাজনৈতিক গাঁটছড়ার শর্তপালনের জন্য উপ মুখ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র দফতরের দায়িত্ব নিতে পারেন তেজস্বী যাদব। বিধানসভার বর্তমান বিজেপির স্পিকারের জায়গায় কংগ্রেসকে ওই পদটি দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে বিজেপি বিরোধী জোট। বিকেল ৪টে নাগাদ মহাগাঁটবন্ধনের নেতারা রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে সেকথা জানিয়ে দিয়েছেন।
আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, আপাতত নীতীশ কুমারের হাতেই মুখ্যমন্ত্রিত্ব সঁপে দেওয়া হলেও এটাই চিরকালীন নয়। একদা সাপে-নেউলে সম্পর্কের দুই দলই ২০২৫ সালের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে একমত হয়েছে। ঠিক হয়েছে, আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত নীতীশ কুমারই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালাবেন। কিন্তু, বিধানসভা ভোট অর্থাৎ ২০২৫-এর আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর হবে তেজস্বীর কাছে। ২০২৫ সালের বিধানসভা ভোটে এই জোট লড়াই করবে তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বে।
দুর্নীতি, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগে এক নয় একাধিকবার লালুপ্রসাদ যাদব এবং তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র তেজস্বী যাদবের সঙ্গত্যাগ করার পর ফের আরজেডির আশীর্বাদ মাথায় নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকে যেতে চলেছেন নীতীশ কুমার। বিহারকে জঙ্গলরাজ থেকে আধুনিক নগরে পত্তনকারী মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের প্রতি সমর্থন দিচ্ছে আরজেডি, কংগ্রেস ও বাম দলগুলি। বিজেপি তলেতলে কোটি কোটি টাকার টোপ দিয়ে নীতীশের দল ভাঙানোর চেষ্টা করছিল, এই অভিযোগে জেডিইউ-বিজেপির মধ্যে মন কষাকষি শুরু হয়। সেটাকেই অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করেন তেজস্বী। ধীরে ধীরে দু’দলের সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকে। তা স্পষ্ট হয়, দিল্লিতে নীতি আয়োগের বৈঠক এনডিএ শরিক নীতীশ কুমার বয়কট করায়।
বিহারের ঘোলা জলে মাছ ধরার সুযোগ হারাতে চায় না কোনও রাজনৈতিক দলই। যেমন, বিহারে রাষ্ট্রপতি শাসন চাইলেন চিরাগ পাসোয়ান। মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠক করে রামবিলাস পাসোয়নের ছেলে চ্যালেঞ্জ জানালেন নীতীশকে। বললেন, “এককভাবে বিধানসভায় জিতে আসুন।” বিহারে বিধানসভা নির্বাচনের আগেও বার বার নীতীশের দিকে আঙুল তুলেছিলেন চিরাগ। নীতীশের সঙ্গে বিবাদের জেরেই বিধানসভা ভোটের আগে বিহারে এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন চিরাগ।
অন্যদিকে বিজেপির দাবি, নীতীশ কুমার বিহারের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। বিহার বিজেপির সভাপতি সঞ্জয় জওসওয়াল মঙ্গলবার বলেন, ২০২০ সালে বিহারের মানুষ এনডিএকে সমর্থন জানিয়েছিল। ওই সময় বিধানসভা ভোটে এনডিএ শরিক হিসেবে জেডিইউ বিজেপির থেকেও কম আসন পেয়েছিল। তা সত্ত্বেও আমরা নীতীশ কুমারকে মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিয়েছি জোটের স্বার্থে। নীতীশ কুমার সেই জনমতকে অগ্রাহ্য করে জোট ভেঙে দিলেন।তাঁর আরও অভিযোগ, জেডিইউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বিজেপির সঙ্গেও।
এক সময় অমিত শাহ কটাক্ষ করে লালু-নীতীশের জোট সম্পর্কে বলতেন, ‘লালুর কোলে নীতীশ’। নীতীশ এ ব্যাপারে নীরব থাকলেও তাঁকে পাশে নিয়ে তার জবাব দিতে শোনা যেত লালুকেই। বেশ কয়েক বার শোনা গিয়েছে, “ছোট ভাই তো বড় ভাইয়ের কোলেই আসবে। নীতীশ আমার ছোট ভাই। ও আমার কোলে আসবে না তো কী তোমাদের কোলে যাবে?” তার পরই লালু-নীতীশ একে অন্যকে বুকে জড়িয়ে ধরার ছবি। পাশাপাশি বসে, এক সঙ্গে বসে চা খেলেন। কথা বললেন বিভিন্ন প্রসঙ্গে। ভাষণ শেষে দু’জনে হাত তুলে উপস্থিত জনতাকে যখন বিজেপি-বিরোধী যাত্রার সূচনা-বার্তা দিতেন, হাততালিতে ফেটে পড়ত সভাস্থল। সেই ছবিই আবার ফিরে এল পাটলিপুত্রে। পার্থক্য শুধু একটাই লালুর বদলে এখন তাঁর ছেলে তেজস্বী।