শুভাশিস মৈত্র: অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে বিজেপি (BJP) হঠাৎই বেশ চুপ করে গিয়েছে। এবার বিজেপি নতুন করে সামনে আনল, এক দেশ এক ভোটের তত্ত্ব (One Nation One Election)। সারা দেশে লোকসভা ভোট এবং সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট এক সঙ্গে করা যায় কি না তার সব রকমের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে (Ram Nath Kovind) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রিপোর্ট তৈরি করতে।
হিন্দু মহাসভার প্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভাবনা, ‘এক নিশান, এক বিধান, এক প্রধান’-এর সঙ্গে ‘এক দেশ এক ভোট’-এর কথাও বিজেপি বেশ কিছু দিন ধরে বলে আসছিল। রামনাথ কোবিন্দকে দিয়ে কমিটি তৈরি করে এবার সেই লক্ষ্যে আর এক ধাপ এগোল বিজেপি, এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
গত ৪৮ ঘণ্টায় তিনটি এমন ঘটনা ঘটেছে, যা ভারতীয় রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক দিকে গত বৃহস্পতিবার গার্ডিয়ান সহ দুটি আন্তর্জাতিক মানের সংবাদপত্রে ‘মোদি ঘনিষ্ঠ আদানি গোষ্ঠী’র নাম করে বড় রকমের শেয়ার দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। যে খবর পরের দিন শুক্রবার বেশ কিছু ভারতীয় সংবাদপত্রও করেছে প্রথম পাতায়। তা নিয়ে দেশ তোলপাড় (আদানি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে অবশ্য এই সব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলা হয়েছে)। অন্যদিকে তারই সঙ্গে শুক্রবারের মুম্বইয়ে ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক নিয়েও দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষের মধ্যে যথেষ্ট কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের মত, মোদি-আদানি সংক্রান্ত খবর এবং ইন্ডিয়া জোটের আলোচনা থেকে দেশের মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতেই বিজেপি ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ নিয়ে কমিটি গড়ার কথা বলে বিষয়টিকে ফের সামনে নিয়ে এল। এবং সে কাজে কিছুটা সফলও হয়েছে তারা।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে জেতার পরই নরেন্দ্র মোদি এক দেশ এক ভোটের কথা বলেছিলেন। তাঁর প্রধান যুক্তি ছিল, এর ফলে ভোট পরিচালনার খরচ কমবে, ভোটের জন্য অনেক কম সময় ব্যয় হবে। মোদি এই মন্তব্য করার পর তৎকালীন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা বলেছিলেন আমরা তৈরি, তবে এটা করতে হলে সব দলকে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সামনেই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন। সম্ভবত কেন্দ্র কাশ্মীরের ভোটও শিগগিরই করতে আগ্রহী। অন্তত শীর্ষ আদালতে সরকারের পক্ষ থেকে এমনটাই জানানো হয়েছে। তার পরেই আসবে আগামী মে-জুন মাসে লোকসভা ভোট। তাহলে কি নরেন্দ্র মোদি এক দেশ এক ভোটের কথা বলে আসন্ন লোকসভা ভোট এগিয়ে এনে পাঁচ বিধানসভা ভোটের সঙ্গে করতে চলেছে? আলোচনা চলছে তা নিয়েও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সেদিনও বলেছেন, কেন্দ্র লোকসভা ভোট ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে করে ফেলতে পারে। সেদিকেই কি এগোচ্ছে দিল্লির রাজনীতি?
আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বরে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। কেন্দ্রের সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রল্হাদ জোশি তাঁর এক্স হ্যান্ডে এ ব্যপারে ছোট্ট একটি পোস্ট করেন। কেন হঠাৎ এই বিশেষ অধিবেশন ডাকা হল, তাতে তা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। ওই অধিবেশনেই কি ভোট এগিয়ে আনার কথা বলা হবে? এই নিয়েও চর্চা এখন তুঙ্গে।
লোকসভা-বিধানসভার ভোট ভারতে অতীতে ১৯৫২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এক সঙ্গে হয়েছে চার বার। ১৯৭২-এর নির্বাচন ইন্দিরা গান্ধী এক বছর এগিয়ে এনে ১৯৭১-এ করেছিলেন। তখনই প্রথম এই প্রথা ভেঙে যায়। এক সঙ্গে সব ভোট করার সব থেকে বড় অসুবিধে হল, নানা কারণে রাজ্যে বা কেন্দ্রে এক টানা পাঁচ বছর সরকার থাকে না বা টেকে না। তখন কী হবে? যেমন ভারতের লোকসভা ভোট নানা কারণে পাঁচ বছর পূর্ণ করার আগেই করতে হয়েছে এমন ঘটনা ঘটেছে ১৯৭১, ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৯১, ১৯৯৮, ১৯৯৯ এবং ২০০৪ সালে। এমন যে ভবিষ্যতে আর কখনও ঘটবে না সে কথা রাজনীতিতে জোর দিয়ে কখনওই বলা যায় না। আর এক বার যদি জোর করে সব ভোট এক সঙ্গে করা যায়, সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ভারতের মতো বিরাট এবং বৈচিত্রময় দেশে খুব সহজ কাজ নয় বলে মনে করেন অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞই।