নীরব মোদি, ললিত মোদি, নরেন্দ্র মোদি, এই প্রত্যেকটা চোরের পিছনে সারনেম মোদি কেন? সব্বার পদবি মোদিই কেন? ১৩ এপ্রিল কর্নাটকের কোলারে নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে রাহুল গান্ধী এই কথা বলেছিলেন। না বললে ভালো করতেন, কিন্তু যাই হোক বলেছিলেন। ওই একই লোকসভার নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি অশ্লীলতমভাবে এই বাংলায় দিদি ও দিদি বলে টোন টিটকিরি করছিলেন, ওই নির্বাচনী প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদি-শাহকে কিম্ভুতকিমাকার, হোঁদলকুতকুত বলেছেন, ওই একই নির্বাচনী প্রচারে বিহারের গিরিরাজ কিশোর সিং গডসেকে দেশপ্রেমিক বলেছিলেন, স্বাধ্বী ঋতাম্ভরাও গডসেকে দেশপ্রেমিক বলেছিলেন, অনুরাগ ঠাকুর তো স্লোগান দিয়েছিলেন, দেশ কে গদ্দারো কো গোলি মারো শালো কো। লিস্ট অনেক লম্বা, কিন্তু মামলা একটাই হল। গুজরাতের এক বিধায়ক, পূর্ণেশ মোদি বললেন, রাহুল গান্ধীর এই বক্তৃতা মোদি সমাজের অপমান। মামলা দায়ের হল, ১৬ জুলাই ২০১৯, নিম্ন আদালত জানাল, রাহুল গান্ধীকে সশরীরে আসতে হবে না। ১০ অক্টোবর রাহুল গান্ধী আদালতকে জানালেন আমি দোষী নই, আইনের ভাষায়, প্লিডেড নট গিলটি। ২৪ জুন এবং ২৯ অক্টোবর, ২০২১, রাহুলের বয়ান জমা হল আদালতে। উনি জানালেন, মামলাকারী যা বলতে চাইছেন তা সত্য নয়, উনি মোদি পদবিধারী প্রত্যেককে অপমান করতে চাননি। ২৩ ফেব্রুয়ারি বিচারকের গলায় অন্য সুর, তিনি পূর্ণেশ মোদির আপিল খারিজ করলেন যেখানে পূর্ণেশ মোদি রাহুল গান্ধীকে সশরীরে হাজির থেকে বয়ান দেওয়ার জন্য আপিল করেছিলেন। ওই দিনই মামলার রায় দেওয়ার কথা ছিল কারণ ২২ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই রায়দান ২৮ ফেব্রুয়ারি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়, ২৮ ফেব্রুয়ারিও এই রায়দান স্থগিত থাকে।
এর মধ্যে পূর্ণেশ মোদি গুজরাত হাইকোর্টে আসেন, ৭ মার্চ তিনি হাইকোর্টে পিটিশন দিয়ে জানান যে মামলা সম্বন্ধীয় কিছু প্রমাণ, একটা সিডি আর পেন ড্রাইভ নিয়ে কিছু সমস্যা আছে, তিনি সময় চাইছেন। এই পিটিশনে তিনি অসত্য কথাও বলেন, তিনি বলেন যে মামলার শুনানি চলছে, ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে যথেষ্ট প্রমাণ আনার সময় দিচ্ছেন না, যদিও মামলার শুনানি শেষ হয়েছিল, রায় দেওয়াটাই যা বাকি ছিল। এসব এখন গুজরাত হাইকোর্টের রেকর্ড খুললেই দেখা যাবে। কিন্তু গুজরাত হাইকোর্ট পূর্ণেশ মোদির এই রায় স্থগিত রাখার এবং আরও সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করার আবেদনে সায় দেয়, কাজেই রায়দান স্থগিত থাকে। এরপর একবছর পরে পূর্ণেশ মোদি হঠাৎই হাইকোর্টে হাজির হন, বলেন হুজুর সব সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির, আপনি স্টে অর্ডার তুলে নিন, যিনি স্টে চেয়েছিলেন তিনিই তুলে নিতে বলছেন, হাইকোর্ট স্টে অর্ডার তুলে নিল। এরপর কোনও শুনানি নয়, মানে নতুন কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি কিছুই নয়, আগের শুনানির ভিত্তিতেই গুজরাতের নিম্ন আদালতে রায়দান হল ২৩ মার্চ, রাহুল গান্ধীকে সুরাত আদালত দু’ বছরের জেলের সাজার কথা জানালেন। এরমধ্যে, মানে পূর্ণেশ মোদির ওই রায়দান স্থগিত রাখার আপিল আর স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়ার আপিলের মাঝখানে দুটো ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথমটা হল, সুরাত আদালতের বিচারক বদলে গেছেন, আর হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের ধাক্কায় আদানিরা নাকের জলে চোখের জলে। সংসদে রাহুল প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করছেন, আপনার আর আদানির সম্পর্কটা ঠিক কী, সেটা দেশের মানুষকে জানান। মোদিজি বক্তৃতা দিচ্ছেন বটে কিন্তু একবারের জন্যও আদানির নাম নিচ্ছেন না। এখানে এসে মনে হচ্ছে ডাল মে কুছ তো কালা হ্যায়। একবছর রায়দান স্থগিত কেন থাকল? নতুন কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ তো এল না কিন্তু রায় দেওয়া হল, রাহুল গান্ধীকে সংসদে আটকানোর জন্যই কি এমন রায় এল? এ প্রশ্ন করলেই তো আদালতের স্যাংটিটি, পবিত্রতা নিয়েই প্রশ্ন করতে হয়, কাজেই ওই প্রশ্ন আমি করছি না। কেবল মনে করিয়ে দিতে চাই, বিজেপি সরকারের সময়েই সদ্য রিটায়ার করার পরে লোকসভার মনোনীত সদস্য আমাদের সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন চিফ জাস্টিস রঞ্জন গগৈয়ের একটি উক্তি। তিনি বলেছিলেন, জাজেস ডোন্ট ফল ফ্রম হেভেন, বিচারকরা স্বর্গ থেকে অবতীর্ণ হন না। মানে খুব পরিষ্কার।
এর পরের ইতিহাস সব্বার জানা, গুজরাত হাইকোর্ট এই রায় বহাল রাখে কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই রায়কে স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এরমধ্যে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে,
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | অর্থনীতি নয়, বিকাশ নয়, এখন বিজেপির ভরসা উগ্র হিন্দুত্ব
রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ চলে গেছে, রায় বের হওয়ার একদিনের মধ্যে তড়িঘড়ি করেই সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়া হল, ওনার বাসভবন ছাড়ার নোটিস এল, উনি ছেড়েও দিলেন। এর মধ্যে দক্ষিণ থেকে উত্তর ভারত জোড়ো যাত্রা হয়েছে আর এই ক’দিন আগে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’ তৈরি হয়েছে। ঠিক সেই সময়ে সুপ্রিম কোর্টের এই স্থগিতাদেশ আচমকাই বিজেপি, মোদি-শাহকে খানিক বিপদে ফেলেছে বইকী। যে তৎপরতার সঙ্গে রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের পরে ততটাই তৎপরতার সঙ্গে ফেরতও দেওয়া হল। মল্লিকার্জুন খাড়্গে বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন, তারমধ্যেই এই খবর এল, তিনি নিজের হাতেই সব্বাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন। কিন্তু আসুন তা নিয়ে কথা বলার আগে সর্বোচ্চ আদালত কিসের ভিত্তিতে এই রায়দানকে স্থগিত রাখলেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক, কারণ সেই আলোচনা থেকেই বেরিয়া আসবে নিম্ন আদালতের রায়দানে কতটা গন্ডগোল ছিল। আমাদের ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের বিভিন্ন ধারায় অপরাধের বর্ণনা আছে, এবং সেই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি কী হতে পারে, তাও বলে দেওয়া আছে। আরও ভেঙে বলি, এমন নয় যে আমাদের ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে একটা অপরাধের একটাই নির্দিষ্ট শাস্তির কথা বলা আছে, তা না করে সেখানে সর্বোচ্চ শাস্তির কথা বলা আছে। ধরুন খুন। একজন খুন করেছে, পুরনো শত্রুতা, জমি নিয়ে বিবাদ, বার বার ঝামেলার পরে ক বাবু, খ বাবুকে খুন করল। মামলা জাজের কাছে এল, জাজ পুরোটা শুনলেন, হ্যাঁ, ৩০২ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসি। কিন্তু জাজ মনে করতেই পারেন যে এই মানুষটি বহুদিনের রাগ সামলাতে না পেরে একটা অপরাধ করেছে, তার অন্য কোনও অপরাধের রেকর্ড নেই, কাজেই তাকে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন জেল দেওয়া যায়। আবার একটি ছেলে তার বাবার সম্পত্তি পাওয়ার জন্য ঠান্ডা মাথায় তার মা, বাবাকে খুন করেছে। প্রথম অপরাধ কিন্তু এই খুনের চরিত্র আলাদা, বিচারক ছেলেটিকে সর্বোচ্চ দণ্ড, ফাঁসি দিতেই পারেন। তেমনিই রাহুল গান্ধীর এই ক্রিমিনাল ডিফেমেশন কেস, মানহানির মামলায় সর্বোচ্চ সাজা দু’ বছর, অতএব কেন এই ক্ষেত্রে রাহুল গান্ধীকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হবে, তার তো একটা ব্যাখ্যা থাকতে হবে। সুরাত আদালত বিরাট রায় দিয়েছে, বিরাট মানে অনেক পাতার রায়। বিশাল সেই রায়ে মোদি সারনেম নিয়ে প্রচুর কথা, কীভাবে মানহানি হয়েছে তা নিয়েও অনেক কথা, অনেক পুরনো মামলা ইত্যাদি লেখা হয়েছে, কিন্তু একবারও বলা হয়নি যে ক্রিমিনাল ডিফেমেশন কেস-এর সর্বোচ্চ সাজাটিই রাহুল গান্ধীর কেন প্রাপ্য? কেন সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হল, তা নিয়ে ওই রায়ে একটাও কথা নেই।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আমাদের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী কোনও সাংসদ তাঁর অপরাধের জন্য যদি দু’বছর বা তার বেশি কারাবাসের দণ্ড পান, তাহলে তাঁর সাংসদ পদ খারিজ করা হবে। কাজেই একজন সাংসদকে ঠিক দু’ বছরের সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার আগে নিশ্চয়ই সেই সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার পিছনে যথেষ্ট কারণ থাকাটা উচিত ছিল এবং রায়ে তার উল্লেখও জরুরি ছিল কিন্তু গুজরাত নিম্ন বা উচ্চ আদালতের রায়ে তার উল্লেখ ছিল না। সেই জন্যই সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দিল এবং রায় এসেছে শুক্রবার। সোমবার তড়িঘড়ি করেই বিজেপিকে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামতে হল, রাহুল গান্ধীর সদস্যপদ ফেরত দেওয়া হল। কিন্তু এরমধ্যেই আরেক বিপদ ঘটে গেছে, উত্তরপ্রদেশের এটাওয়ার সাংসদ রামশঙ্কর কাটেরিয়াকেও নিম্ন আদালতে দাঙ্গায় উসকানি দেওয়ার এবং দাঙ্গায় ভূমিকা থাকার অপরাধে দু বছরের সাজা শুনিয়েছে এবং এটা সর্বোচ্চ সাজাও নয়। দু’ দিন আগেই এই রায় এসেছে, আজ এটাও দেখতে হবে যে এটাওয়ার এই সাংসদের সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়া হয় কি না। তবে এই সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়ার ইস্যুতে বিজেপির মুখ যে পুড়েছে তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই, আরও মুখ পোড়ার আগেই তাঁরা সাংসদ পদ ফেরত দিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামলেন। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই গেছে, বিজেপি, মোদি–শাহ যে রাহুল গান্ধীকে সংসদে অন্যায়ভাবে আটকাতে চাইছেন, এই ন্যারেটিভ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। দুই, কেবল কংগ্রেসি নয়, ইন্ডিয়া মঞ্চের প্রত্যেক দলই উজ্জীবিত, তাঁরা আজ মিষ্টি খাবেন, খাওয়াবেন, চ্যানেলে চ্যানেলে এই খবর চলবে, বিরোধীরা বিজেপিকে নতুন উদ্যমে আক্রমণ করবেন। তিন হল, রাহুল গান্ধী ঠিক অনাস্থা ভোটের আগে সংসদে ঢোকার ছাড়পত্র পেলেন, এখন তাঁর উচ্চতা বেড়েছে, মোদিজির উচ্চতা কমেছে, সংসদে দুজনের দ্বৈরথে রাহুল গান্ধী অ্যাডভানটেজ, এটা বলাই বাহুল্য। চার নম্বর লাস্ট বা নট দ্য লিস্ট, আমাদের গণতন্ত্রের এক অন্যতম স্তম্ভ বিচারব্যবস্থা নিয়ে মানুষ খানিকটা ভরসা ফিরে পেল, অনেক পথ চলা বাকি, কিন্তু যা হল তাই বা কম কী?