রাজনৈতিক ন্যারেটিভ বিজেপির নতুন নয়। হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থানে স্লোগান তাঁরা পৌঁছে দিয়েছেন মানুষের কাছে, মানুষের কাছে লাভ জিহাদ, মুসলমানদের জনসংখ্যা বাড়ছে ইত্যাদিও পৌঁছে গিয়েছে। রামমন্দির থেকে কাশী, মথুরা, ৩০ হাজার মন্দিরের কাহিনিও মানুষ শুনেছেন। ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে, পুলওয়ামা, সার্জিকাল স্ট্রাইক, নরেন্দ্র মোদি পৃথিবীর নেতা ইত্যাদি জঙ্গি জাতীয়তাবাদী স্লোগানও আছে। কিন্তু এই সব ন্যারেটিভে কত শতাংশ হিন্দুকে এক ছাতার নীচে আনা গেল? হিসেব বলছে ২৫-২৬ শতাংশ দেশের মানুষ এই ন্যারেটিভেই খুশি। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল ইত্যাদি পরে হলেও চলবে। ওঁরা এই উগ্র হিন্দুত্ব আর জাতীয়তাবাদী স্লোগানে আপ্লুত, কাম হোয়াট মে, ওঁরা বিজেপিকেই ভোট দেবেন। এটা ২০০০-এ ১৪-১৫ শতাংশ ছিল, এখন সেটাই ২৫-২৬ শতাংশ। এই ভোট কিন্তু সহজে কমবে না। এর পরের ভোট আসে নরেন্দ্র মোদির ক্যারিশমা, উন্নয়ন, বিকাশ, দুর্নীতি বিরোধী, বংশানুক্রমিক শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের রায় থেকে। সেটাও প্রায় ১১-১২ শতাংশ। রাজ্যে ভোট হলে এই শতাংশটা কমে সাতে দাঁড়াচ্ছে। মানে বিজেপির ভোট মাইনাস ফ্লোটিং ভোট ৩৩ শতাংশ। আর সাধারণ নির্বাচনে যেখানে নরেন্দ্র মোদিই প্রার্থী, সেখানে ৪-৫ শতাংশ বেড়ে ৩৮ শতাংশের কাছাকাছি। এরপর যোগ হচ্ছে ফ্লোটিং ভোটার, কমবেশি ১০ শতাংশ, যাঁরা ভোটদানের আগের দিন বা দিন দুই আগে মনস্থির করেন। বাকি ৫২ শতাংশ ভোট নানা দলের কাছে বিভক্ত, সেটা বিজেপির কাছে প্রয়োজনীয়, মানে ভোট বিভাজন থাকলে ওই ৫২ শতাংশ ভোট নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। এবং ওই ফ্লোটিং ভোটার নিয়েই সমস্যা, এই ফ্লোটিং ভোটারেরা গোটা খেলাটা পাল্টে দিতে পারে।
এই ১০ শতাংশ ভোট কাদের? মূলত গরিব প্রান্তিক মানুষজনদের। যারা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, এবং বিত্তবান, তাঁদের বেশিরভাগ মানুষ খবরের কাগজ পড়েন, টিভি নিউজ দেখেন, আলোচনা করেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে আছেন, এঁরা এতটাই বিভক্ত যে এঁদের ভোট মাস তিন চার আগে থেকেই স্থির হয়ে থাকে। নিম্ন মধ্যবিত্তদের একটা অংশ আর গরিবদের একটা অংশ বিজেপিকে ভোট দেয়, একটা অংশ বিরোধীদের ভোট দেয়, কিন্তু এদেরই ১০ শতাংশ ভোটকে ফ্লোটিং ভোট বলা হয়, ভাসছে, শূন্যে দোদূল্যমান, নিজের এক্সপিরিয়েন্স, নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা থেকে একটা সিদ্ধান্তে এঁরা আসেন। এঁরাই শাসক বা বিরোধীদের প্রচারের লক্ষ্য, এবং সেই কারণেই প্রচুর পোস্টার, ব্যানার ছাপানোর পরে, সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় তোলার পরে, বিরাট বিরাট জনসভা করার পরেও রাজনৈতিক দল বাড়ি বাড়ি যায়, পদযাত্রা করে, রোড শো করে, সেই প্রচারের লক্ষ্য হল এই ভোটারেরা। এবং এই ভোটারদের প্রভাবিত করে মূল্যবৃদ্ধি, এই ভোটারদের প্রভাবিত করে বেকারত্ব। জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে কেবল শাকসবজির দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ, টোম্যাটোর দাম বেড়েছে ২০০ গুণ, আদার দাম বেড়েছে ১৭৭ গুণ, রসুন বেড়েছে ৭০ শতাংশ, লঙ্কা বেড়েছে ৫০ শতাংশ, মশলা বেড়েছে ২২ শতাংশ, চাল-ডাল বেড়েছে ১৩ শতাংশ। মানে এক মাসে কেবল না হলেই নয় এমন জরুরি খাবার জিনিসের দাম বেড়েছে যার জন্য একজন নিম্নবিত্ত মানুষ ৮৮ টাকা বেশি খরচ করছেন, মানে এই জিনিসগুলো কিনতে যদি আগে ওঁর ১০০ টাকা খরচ হত, তাহলে এখন ১৮৮ টাকা খরচ হবে। মাইনে বাড়েনি, বরং এই লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির ফলে তার মূল্য কমেছে। একজন গরিব মানুষের অভিজ্ঞতা কী বলছে?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ২০২৪-এ নরেন্দ্র মোদির সামনে তিনটে বিপদ, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব আর জোট
২০২২-এ তিনি ৩৭ টাকা দিয়ে চাল কিনতেন, আজ তাঁকে ৪২ টাকা দিয়ে এক কিলো চাল কিনতে হচ্ছে। আটা ছিল ৩২, হয়েছে ৩৫। অড়হর ডাল ছিল ১১০, বেড়ে এখন ১৪০ টাকা প্রতি কিলো, দুধ ৫২ টাকা লিটার ছিল, এখন ৫৭ টাকা প্রতি লিটার। টোম্যাটো ৩৪ টাকা থেকে ৮৪ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ধরে নিলাম টোম্যাটো তিনি খাবার তালিকা থেকে বাদ দেবেন, কিন্তু ডাল, চাল, দুধ, আটা না কিনে যাবেন কোথায়? ৭০ টাকার পেট্রল এখন ১০০ টাকা ছাড়িয়ে দৌড়চ্ছে, তার মানে তিন বছরে বেড়েছে ৪২ শতাংশ। তিন বছর আগেও ৭০০ টাকা ছিল গ্যাসের দাম, এখন ১১০০ টাকা ছাড়িয়েছে। ইলেকট্রিক বিল বাড়ছে, ওষুধের দাম বাড়ছে। এই অভিজ্ঞতাকে কোন প্রচার দিয়ে ঢাকা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলার চেষ্টা করছেন, এটা কোভিডের জন্য হয়েছে, বরাবরের মতোই মিথ্যে বলছেন উনি। কোভিডের লকডাউন একটা শক দিয়েছিল, সেই শক কেটেছে, কারখানা চালু হয়েছে, বাজার বসছে, কিন্তু দাম কমছে না। কেন? কার দোষে? বাজারে জিনিস কম আর কেনার লোক বেশি হলে দাম বেড়ে যায়, আমাদের দেশে বাজারে জিনিস পড়ে আছে, মানুষ কিনছে না, তাহলে? তাহলে দাম বাড়ে যদি মানুষের কাছে টাকা প্রচুর এসে যায়। জিনিস আছে, কেনার লোকও আছে, কিন্তু সেই মানুষদের কাছে প্রচুর টাকা আছে, তাহলেও জিনিসের দাম বাড়ে, আমাদের দেশে তাও নয়, মানে মানুষের হাতে যে প্রচুর টাকা তাও নয়। তাহলে? আসলে মানুষের হাতে টাকা নেই, মানুষের কেনার ক্ষমতাই নেই, যার ফলে যাঁরা বিক্রি করতে বসেছেন, তাঁদেরকে ১০টার বদলে দুটো জিনিস বিক্রি করে লাভ করতে হচ্ছে, তাঁরা দাম বাড়াচ্ছেন, তাঁদের লাভের হার বজায় রাখার জন্য। এর ফলে ১০টার বদলে ২টো জিনিস বিক্রি হচ্ছে, যার ফলে চাষির আনাজ, ফসল বিক্রি হচ্ছে না, কারখানার মাল বিক্রি হচ্ছে না, কাজেই সেখানে মজুরি কমছে, মানে মানুষের হাতে আরও টাকা কম আসছে।
এক ভিসিয়াস সার্কল, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তবে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হবে, বিক্রি হলে আরও প্রোডাকশন হবে, আরও মজুরি বাড়বে। কিন্তু তার বদলে উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। কিন্তু তা কি সর্বত্র? সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কাছেই কি টাকা নেই? না তাও নয়, এক শ্রেণির মানুষের কাছে প্রচুর প্রচুর টাকা আছে, চলে যান ফাইন ডাইনিং রেস্তরাঁতে, ফুটপাথের খাবারের দোকানে লোক কমছে, কিন্তু ফাইন ডাইনিং রেস্তরাঁতে লোক আছে, সেখানে হুউউস করে উড়ে যাচ্ছে কাঁটা ছাড়া ৬০০০ টাকা দামের ইলিশের প্লেট। বিক্রি হচ্ছে ২৫/৩০/৬০ লক্ষ টাকা দামের গাড়ি, কমদামি ফ্ল্যাট পড়ে রয়েছে কিন্তু ৩/৪/৫/৭ কোটি টাকার ফ্ল্যাট বিকোচ্ছে হু হু করে। এবং এই বৈষম্য আরও সমস্যা তৈরি করছে। ওই দরিদ্র, হতদরিদ্র মানুষটি দেখছেন একপাশে ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি আর অন্যদিকে তার পেটে খিদে, তার পরিবারের মানুষের জন্য ওষুধ নেই, পানীয় জল নেই। কিন্তু মোদিজি তো এগুলো দেবেন বলেছিলেন, বলেছিলেন সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, আচ্ছে দিনের গল্প শুনিয়েছিলেন সেই মানুষটাকে যার ছেলেরা সবল, সাবালক কিন্তু চাকরি পায়নি। যার নিজের রোজগার কমছে, তার ভোগ্যপণ্য কেনার ক্ষমতা কমছে। এই ১০ শতাংশের ঘাড়ে চেপেছে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, সে পায়নি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, যা মোদিজি তাঁকে দেবেন বলেছিলেন। কাজেই এই ১০ শতাংশ ভোট নিয়ে মোদিজি, বিজেপি-আরএসএস নার্ভাস, তাঁরা লিখেই দিচ্ছেন, কেবল রামমন্দির আর মোদিজির উপর ভরসা করে এ ভবতরী পার করা যাবে না। মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্ব এক প্রবল প্রভাব ফেলবে আগামী নির্বাচনে এবং তার উপরে আরেক সমস্যা হল ইন্ডিয়া জোট। বিরোধী ভোট ভাগাভাগির কারণে যে ক’টা আসন বিজেপি পেত, সেগুলো নিয়েও এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু জায়গায়, মহারাষ্ট্র, বিহার, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, আর আমাদের বাংলায় জোটের ফলে বিজেপি বেশ কিছু আসন খোয়াবে। সব মিলিয়ে হাজারো তীব্র হিন্দুত্ব আর জঙ্গি জাতীয়তাবাদের স্লোগান দিয়েও, মোদিজিকে রাজ্যে রাজ্যে প্রচার করানোর পরেও ওঁদেরই হিসেব মতো আসন কমছে। বিভিন্ন সার্ভেতে বলা হচ্ছে জোটের আসন বাড়ছে, কিন্তু জিতে যাচ্ছে কি? আরএসএস–বিজেপি হেরে যাচ্ছে কি? না, এখনও সেই তথ্য নেই, কিন্তু একটা সোজা হিসেব হল, আকাশের দিকে বল ছুড়ে দিলে নিউটনের গ্রাভিটেশন থিওরি মেনেই তা নীচে পড়বে, মাঝপথ থেকে আবার উপরে উঠবে না। এই যে পতন শুরু হয়েছে, তা আরও তীব্র হবে, ৫ রাজ্যের ভোটের পরে হু হু করে নামবে। নরেন্দ্র মোদি সেটা বুঝেছেন, আরএসএস–বিজেপি সেটা বুঝেছে, মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্ব নিয়ে নতুন টাস্ক ফোর্স তৈরি হয়েছে, মোদিজি নিজে তার মনিটরিং করছেন। জোট সামলানোর জন্য ইডি আর সিবিআই, মিডিয়া তো হাতে, কেবল কয়েকটা জিনিসের দাম অনেকটা কমিয়ে অবস্থার সামাল দিতে পারবেন কি আমাদের প্রধানমন্ত্রী? তিনি জানিয়েছেন, ১ লক্ষ কোটি টাকা বাজারে ছেড়ে দেবেন, যাকে মানি ইনফিউজ করা বলে, মানে মানুষের হাতে টাকা দেওয়া। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সেটাও এক ঝটকাতে করতে গেলে বিরাট ক্ষতি হতেই পারে, টাকার দাম কমে গিয়ে অন্য সমস্যার জন্ম দিতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো একাধারে অর্থনীতিবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী, গবেষক বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ, গণিতজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং সাহিত্যিক, কাজেই তাঁকে বুদ্ধি দেবে এমন মানুষই বা কোথায়? কাজেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ পর্যন্ত, ওঁর সরে যাওয়ার পরেই হতে পারে নতুন ভারত নির্মাণ।