উজবেকিস্তানে সাধারণভাবে মানুষজন বাইককে ডেথ অন হুইলস বলেন। এদিকে আমাদের দেশে আপাতত বাইক হল এক ইন থিং, এক মাচো আইকন, চড়লেই পৌরুষকার ঝরে ঝরে পড়ে। বিজ্ঞাপনে দেখবেন, সেসব বাইকের পিছনে উল্লাসে ফেটে পড়া রমণীর উচ্ছ্বাস, ওড়াচুল আর আঁচল। সেসব দেখতে দেখতে আর সরকারের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চূড়ান্ত অবহেলার জন্যই বেড়ে উঠেছে বাইক সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্যকে আরও বিস্তৃত করার জন্যই এমন সব বিজ্ঞাপন, যা কেবল বাইকের নয়, যা এক গতির বিজ্ঞাপন, যা আপনার নজর কাড়বে। এক লোভনীয় ইর্ষণীয় জীবনের বিজ্ঞাপন, বাইক কিনলে পেছনে থাকবেই সুন্দরী রমণী, যিনি আপনার বক্ষলগ্না হয়ে বসে থাকবেন। আরপর তেমন এক স্বপ্নের বাইকের জন্য যে ভাবে হোক পয়সা জোগাড় করা, তার জন্য কিডন্যাপ? চলবে। খুন? তাও চলবে। সীতা বলেছিলেন সোনার হরিণ চাই, আজকের প্রজন্ম বলছে বাইক চাই। একবার বাইক এসে গেলে, দেখে কে, কলকাতার রাজপথ শাসন করে সেই গর্বিত যুবক। এঁকেবেঁকে এক সর্পিল গতিতে পথচারীদের তাক লাগিয়ে সেই বাইক চলে যায় হুস করে। মুখ ঢাকা সেই কালো হেলমেট, গ্রিক সেনাপতির মতো চেপে বসে যুবকের মাথায় নয়, মগজে।
হ্যাঁ, খুব জেনেশুনেই বার কয়েক যুবকই বললাম, এর মানে এমনটা নয় যে যুবতীরাও বাইকে বসছেন না, বসছেন কিন্তু এখনও তা ব্যতিক্রম। ডেথ অন হুইলস-এ বসছে যুবক, তরুণেরা, প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়েও গতির স্বাদ নিতে উৎসাহী মানুষজন। তারপর, এক অসতর্ক মুহূর্তে মৃত্যু আসছে, হয় নিজের বা পিছনের আরোহীর বা দুজনের। রক্তাক্ত শরীর রাস্তায় পড়ে, বাড়ির লোকেরা তখনও জানেই না দু’ চাকার মৃত্যুদূত নিয়ে গেছে তাদের প্রিয়জনকে অনেক দূরে যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। আজ সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, দু’ চাকায় মৃত্যুদূত।
আরও পড়ুন: Aajke | মদনের প্রতিবাদ
ক’দিন আগেও যে মেয়েটিকে আমরা টিভির পর্দায় দেখেছি, সেই মেয়েটি আজ আর নেই। বাইকের পিছনে বসেছিল, হঠাৎ বাইক ব্রেক কষে দাঁড়ায়, সে ছিটকে পড়ে এবং অন্য আর এক গাড়ি তার উপর দিয়ে চলে যায়। তার অভিনয় শেষ, এরকম মৃত্যু কি তার কাম্য ছিল? তার বয়স ৩০, তার মা আগেই মারা গিয়েছে, সন্তানহারা পিতা জানতেও পারলেন না দু’ চাকায় মৃত্যুদূত এসে নিয়ে চলে গেল তাঁর কন্যাকে। ওই একই দিনে তিন বন্ধু বেরিয়েছিল বাইকে, করণ সিং, রোহিত কেশরী, নাসিম আলির বয়স ১৮ থেকে ২২-এর মধ্যে। ওরা বাইক চেপে বেরিয়েছিল, বাতাসের গতিতেই বাইক চলছিল, কারও মাথায় হেলমেটও ছিল না। আগরপাড়ার কাছে আলপাইন ডেয়ারির সামনে হঠাৎ তারা ইউ টার্ন নেয়, ওটাই জীবনের শেষ ইউ টার্ন। এক পিক আপ ভ্যানের ধাক্কায় তিনজনই ছিটকে পড়ে এবং ওখানেই মারা যায়। প্রশ্ন উঠছে কেন পুলিশ এই হেলমেট ছাড়া বাইকারদের আগেই ধরেনি, প্রশ্নটা হওয়া উচিত কেন এই বাইকাররা হেলমেট পরে না? ওই গতির অনুভূতিতে ধরার জন্য, শন শন হাওয়ার সঙ্গে খেলার জন্য? ওই একই দিনে আর এক দুর্ঘটনা ঘটে পঞ্চাশে পা দেওয়া ইঞ্জিনিয়ার সুব্রত আর ছেচল্লিশের ইন্টিরিয়র ডিজাইনার পারমিতা সান্যালের। উত্তরপ্রদেশের বারাবাঁকিতে এক পথদুর্ঘটনায় দুজনেই মারা গিয়েছেন, রোড ডিভাইডারে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটে, বাইকের গতি ছিল অস্বাভাবিক। এনফিল্ড স্পোর্টস বাইকে চেপে এই দম্পতি যাচ্ছিলেন লাদাখ, পথে এই দুর্ঘটনা। তাঁরা তাঁদের রোমাঞ্চকর বেড়াতে যাওয়ার গল্প বলতেন বন্ধুবান্ধব পাড়া প্রতিবেশীদের, সে গল্পের ইতি। একদিনে ছ’ জনের মৃত্যু, এবং এটা নতুন কিছু নয়, খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখুন, এরকম দুর্ঘটনার কথা প্রায় রোজই পাবেন, এক নয়, একাধিক পাবেন। তাহলে প্রশ্ন কি ওঠে না যে এই দু’ চাকার মৃত্যুদূত নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে? নাকি এসব চলতেই থাকবে, এই মৃত্যু হল গতি সভ্যতার কোল্যাটেরাল ড্যামেজ? কী বলছেন মানুষজন?
সেই কবে আদিম মানুষ দেখেছে হরিণের ক্ষিপ্রগতি, দেখেছে চিতাকে, সে আবিষ্কার করেছে যন্ত্র, চাকা, গাড়ি, উড়োজাহাজ। কিন্তু সেসব আবিষ্কার তার ব্যক্তিগত খিদেকে মেটাতে পারেনি। সে একলাই উড়ে যাবে ক্ষিপ্রগতিতে, গায়ে পড়বে সূর্যালোক আর পাশ দিয়ে বয়ে যাবে শন শন হাওয়া। এমনটা মানুষ হাতে পেল বাইক আবিষ্কার হওয়ার পরে। সাইকেল তাকে গতি দিতে পারেনি, বাইক তাকে সেই গতি এনে দিল। বহু সময়েই বাইকের বিজ্ঞাপনে সেই গতিই হয় মূল বিষয়, এক চিতার গতি আপনার হাতে তুলে দিতে পেরে ধন্য হয় বাইক নির্মাতারা যারা জীবনে কোনওদিনও বাইকে চড়েনি, চড়বে না। তাদের চড়ার প্রয়োজন নেই, গতির লোভ বিক্রি করে দু’ চাকায় এক মৃত্যুদূতকে পাঠিয়ে দেওয়াই যাদের কাজ। ভাবুন, ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন।