আপনারে বড় বলে বড় সে নয়, লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়। হরিশচন্দ্র মিত্রের কবিতা। মোদিজি নামও শোনেননি, পড়ার কথাও নয়। তাই মাঝেমধ্যেই যখন নিজের ৫৬ ইঞ্চির চওড়া বুক নিয়ে কথা বলেন, গর্ব করেন, তখন বোঝা যায় আদতে ৫৬ ইঞ্চির চওড়া হৃদয় তাঁর কোনও দিনই নেই। বরং হিন্দিতে বড়বোলে যাকে বলা হয়, বাংলায় হামবড়া, তিনি আদতে সেটাই। বল্লভভাই প্যাটেল নিজেকে আয়রন ম্যান বলেননি, সুভাষচন্দ্র বসু নিজেকে নেতাজি বলেননি, গান্ধীজি নিজেকে জাতির পিতা বলেননি, মোদিজি ক্ষণে ক্ষণেই নিজেকে ৫৬ ইঞ্চির চওড়া হৃদয় বলে থাকেন। পাকিস্তানের কথা হলেই ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, আরও কত কী। আর চীন হলে হীরণ্ময় নীরবতা। গালওয়ানে ঠিক কী হয়েছিল? এখনও দেশ জানে না। অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তে চীনের গ্রাম, রাস্তা তৈরি হচ্ছে, মোদিজি সে নিয়ে স্পিকটি নট। ভক্তরা বলেছেন, হুঁ হুঁ বাওয়া এটা স্ট্রাটেজি, ওরা ওই ক’খানা ব্রিজ আর রাস্তা বানাক, আমরা মোদিজির নেতৃত্বে তলায় তলায় ওদের অর্থনীতি ধসিয়ে দেব। এবং হঠাৎই এক সকালে দেশ জানল, চীনের টিকটক সমেত বেশ কিছু অ্যাপ ভারত সরকার ব্যান করে দিয়েছে। ভক্তরা জয়ধ্বনি দিল, বলল, নাও, বোঝো এবার ঠেলা, মোদিজি দিয়েছে এক্কেবারে টাইট করে, এবার না খেতে পেয়ে মরবে। আবার ক’দিন পরে আবার হুকুম জারি, আরও কিছু চীনের মোবাইল অ্যাপ বাতিল করা হইল। এরপর মোদিজি আরেক দাওয়াই দিলেন, আত্মনির্ভর ভারত, লোকাল পে ভোকাল, মেক ইন ইন্ডিয়া। দেশজুড়ে সমস্বরে সে কী বাহবা বাহবা ধ্বনি। এই প্রথম ভারতবর্ষ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলল, এর আগে কেউ এভাবে ভাবেনি। মানে ভাকরা নাঙ্গাল, বোকারো, ভিলাই, ইস্পাত, বিদ্যুৎ, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, এইমস, আইআইটি, ভাবা স্পেস সেন্টার, এসব কী ছিল? কারা করেছিল? অটলজির সময়ে গোল্ডেন কোয়াড্রিয়াঙ্গল, কী ছিল? গোটা দেশ জুড়ে মোবাইল যোগাযোগ কী ছিল? আজ্ঞে না, আইটি সেল সাফ জানিয়ে দিয়েছে ওসব কিছুই নয়, ভারত এবার বিশ্বগুরু হবে, ৫ ট্রিলিয়ন ইকনমি হবে। মেক ইন ইন্ডিয়া, মেক ইন ইন্ডিয়া, ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতে প্রডাক্টিভিটি লিঙ্কড ইনসেনটিভ স্কিম চালু হল, ঝানু এবং বুঝদার শিল্পপতিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল, প্রথমে সব সুবিধেগুলো নাও, তারপর কোম্পানিই তুলে দেব। ৫০০-১০০০ জন বেকার হয়ে যাবে ইত্যাদি ধমকি দাও, আবার সুবিধে নাও। কিন্তু মোদিজি জানালেন, সুফল ফলতে শুরু করেছে, আর সামান্য অপেক্ষা। কবে? ২০১৯-এ। চীন এগিয়ে গেছে এই ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পকে বাড়িয়ে, ভারতও এগোবে। ভক্তরা বলল, চীনের প্রডাক্ট বয়কট করো, বাড়ি ফেরার সময়ে সস্তায় চীনা ম্যাজিক লাইট কিনে দেওয়ালির কাজ এগিয়ে রাখল। তিন বছর তো প্রায় হল, আপাতত ছবিটা কেমন? চীন কি পিছিয়ে পড়ছে? আমরা কি মেক ইন ইন্ডিয়ায় এগিয়ে গিয়েছি? লোকাল পে ভোকাল-এর খবর কী? এমনিতে খুব বেশি স্ট্যাটিসটিক্স-এর দরকার নেই, বাজারে গেলেই বোঝা যাবে হাল হকিকত। ইলেকট্রনিক্স বাজারের ৭০ শতাংশ চীনের দখলে, ফুটপাথের সস্তা খেলনা থেকে, ঘর সাজাবার আলো, টিভি, ফ্রিজ, মাইক্রো ওভেন থেকে মোবাইল, রোবট সবই ওই চায়নার। ল্যাপটপ থেকে ঘড়ি, গিফট থেকে ওয়াইন বানানোর কার্বো সবটাই আসছে চীন থেকে, বাকিটা কোরিয়া, দামি কিছু ব্র্যান্ড ইতালি, জার্মানির, কিন্তু সেগুলোও তৈরি হয়ে আসছে চায়না থেকে। এসব জানতে কোনও বই পড়তে হবে না, অ্যামাজন এ চলে যান, যে কোনও প্রডাক্ট বাছুন, তারপর কান্ট্রি অরিজিনটা দেখে নিন। তবে কি এত বড় দেশ, এত মানুষ, কেবল বাজার দেখেই সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়, আর অ্যামাজন, বাজার বা ফুটপাথ দেখে সমসাটা কত বড় তা তো বোঝা যাবে না, তাই চলুন কিছু তথ্যও দেখে নেওয়া যাক। আগেই বলে রাখি তথ্যগুলো আমাদের দেশের এক্সপোর্ট ইমপোর্ট সম্পর্কিত সরকারি রিপোর্ট থেকেই নেওয়া, আর সেগুলোর সঙ্গেই কিছু তথ্য পেয়েছি চাইনিজ কাস্টমস এ ডেটাবেস, সিজিএসই চাইনিজ জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ কাস্টমস থেকে যা গত কয়েকদিনে ইকোনমিক টাইমস সমেত বিভিন্ন কাগজে ছাপা হয়েছে। প্রথমেই বলে নেওয়া যাক এই ট্রেড ডেফিসিট ব্যাপারটা কী? খুব সোজা কথায় আমাদের দেশ কোনও একটা দেশকে কিছু রফতানি করে, কিছু আমদানি করে, এই এক্সপোর্ট আর ইমপোর্টের তফাতকেই বলা হয় ট্রেড ডেফিসিট। এমন হতেই পারে যে আমরা বেশি রফতানি করলাম, ১০০ টাকার রফতানি করলাম, আর ৭০ টাকার আমদানি করলাম, তাহলে আমাদের ট্রাড ডেফিসিট প্লাস ৩০ টাকা, মানে টাকাটা আমরা পাব, আর যদি এমন হয় যে আমরা ৭০ টাকার রফতানি করলাম আর ১০০ টাকার আমদানি তাহলে সেটা নেগেটিভ ট্রেড ডেফিসিট, আমাদের সেই টাকাটা দিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কোথাও ট্রেড ডেফিসিট নেগেটিভ হবে কোথাও প্লাস ডেফিসিট, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হল মাইনাস ট্রেড ডেফিসিট বাড়তেই থাকা, মোদিজির সরকার এই নিয়েই বিরাট বিরাট কথা বলেছে, ওই যে মেক ইন ইন্ডিয়া ইত্যাদি। বিশেষ করে চীনের মতো একটা দেশ, যারা নাকি আগ্রাসী নীতি নিয়ে পড়শি দেশগুলোকে তাদের আর্থিক ঋণের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে চাইছে, চীনের কাছে পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার ঋণ শোধ করা এই মুহূর্তে প্রায় অসম্ভব, সেই চীনের সঙ্গে ব্যবসা তো করতেই হবে কিন্তু ট্রেড ডেফিসিট বাড়তে থাকলে তার পরিণাম তো ভাল হবে না। ২০২০-তে মেক ইন ইন্ডিয়া, টিকটক ব্যান ইত্যাদির পরে আমরা ভেবেছিলাম, ২০২১-এ অন্তত চীনের সঙ্গে ট্রেড ডেফিসিট উবে না গেলেও কমবে। হিসেব কী বলছে? ২০২১-এ আমরা চীন থেকে আমদানি করেছি ৯৭.৫২ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রী, আর রফতানি করেছি ২৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি টাকার সামগ্রী। ওই বছরে মাইনাস ট্রেড ডেফিসিট ৬৯.৩৮ বিলিয়ন ডলার। এই টাকাটা কত বড় টাকা? সেটা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দিই। গত আর্থিক বছরে আমাদের দেশের ডিফেন্স বাজেট মানে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৩ বিলিয়ন ডলার। ওদিকে ৫৬ ইঞ্চির বকওয়াস চলছে, তার মধ্যে বছর ঘুরছে, ২০২২-এর প্রথম ৯ মাসে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, গত বছরে আমদানি ছিল ৯৭.৫২ বিলিয়ন ডলার, এই বছরের ৯ মাসের মধ্যেই আমরা আমদানি করেছি ৮৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। ওদিকে রফতানির খবর কী? সেটাও কমেছে, প্রথম ৯ মাসে ভারতের রফতানি ১৬.৫ বিলিয়ন ডলার, মানে প্রথম ৯ মাসে ৭৩ বিলিয়ন ডলারের ট্রেড ডেফিসিট। যাঁরা এ বিষয়ে খবর রাখেন, তাঁদের মতে এবছরে ট্রেড ডেফিসিট ১০০ বিলিয়ন ডলারের এধারে ওধারে থাকবে। মানে ওই ডিফেন্স বাজেটের সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জলের বাজেট বরাদ্দটাও ধরে নিন। অনেক সময়ে ক্যাপিটাল গুডস আমদানির ফলে ট্রেড ডেফিসিট বাড়ে, কিছুদিন পর থেকে সেটা কমে, কারণ ক্যাপিটাল গুডস, যেরকম ভারী মেশিন, যন্ত্রপাতি, যা দিয়ে বিভিন্ন জিনিস উৎপাদন হবে, সেটা আবার রফতানি হবে, তো সেই খাতে আমদানি আখেরে লাভ দেয়, চীনকে আমরা যা রফতানি করেছি তা কিন্তু ওই গোত্রেরই। লৌহ আকর ৮৭৮ মিলিয়ন, এ বছরে কমেছে ৭৩ শতাংশ, চাইক্লিক হাইডোকার্বন ৩২৫ মিলিয়ন ৫৮.৪ শতাংশ কমেছে, রিফাইন্ড কপার ৩১৯ মিলিয়ন ডলার, ৬৩ শতাংশ কমেছে। মানুষের চুল, যা দিয়ে চীন উইগ তৈরি করে সারা পৃথিবীকে বিক্রি করে, ২৫৩ মিলিয়ন ডলারের, এটাও ২৮ শতাংশ কমেছে। কিন্তু চীন থেকে আমরা যা আমদানি করেছি, তার মধ্যে মেশিনারি, মেকানিকাল পার্টস, অ্যাপ্ল্যায়েন্সেস আমদানি হয়েছে ১৪.৬ বিলিয়ন ডলারের কিন্তু ইলেক্টনিক্স, ইলেক্ট্রিকাল পার্টস ইত্যাদি আমদানি হয়েছে ২২ মিলিয়ন ডলারের, জুতো ২৩৬ মিলিয়ন ডলারের, ফার্নিচার ৫৩৪ মিলিয়ন ডলারের, জামাকাপড় ১.৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের আর পুতুল, টয়েজ আমদানি হয়েছে ১৬৩ মিলিয়ন ডলারের। অথচ গত তিন বছর ধরে আমরা শুনে আসছি এই সব ক্ষেত্রেই প্রডাক্টিভিটি লিঙ্কড ইনসেনটিভ দেওয়া হচ্ছে। সে সব যাচ্ছে কোথায়? কোম্পানি তৈরি হচ্ছে ছাড় নিচ্ছে, তারপর উবে যাচ্ছে। শেষ করার আগে কয়েক বছর আগে থেকে কিছু ডেটা দেওয়া যাক, ৫৬ ইঞ্চির কেরামতিটা বোঝানো যাবে। ২০১২-তে চীন থেকে আমাদের আমদানি ছিল ৩৯.৩ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রী, ২০১৩-তে ৩৮.৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৪-তে ৪২.১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৫য় ৪৫.৬, ২০১৬য় ৪৪.৩, ২০১৭য় ৫৩.২, ২০১৮-তে ৫৬.৪, ২০১৯-এ ৫২.৭। চীনে কোভিড শুরু হয়ে গেছে, ২০২০-তে ৪০.৭, আমাদের দেশে কোভিড চলছে, ২০২১তে ৬২.২ আর ২০২২ সালে ৮৯.৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি করা হয়েছে। এই পুরো হিসেবটা প্রত্যেক বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের। গত বছরে আমাদের মোট আমদানি ছিল ৯৭.৫২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের, এবছর প্রথম ৯ মাসেই ৮৯.৭ বিলিয়ন ডলার। মোদিজির মেক ইন ইন্ডিয়া আসলে এক বিশুদ্ধ তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়, আর তাঁর ভক্তদের উল্লাস আসলে এই তামাশারই অঙ্গ।