যে মানুষটির সারা জীবন চলে গেল ক্ষমা চাইতে চাইতে সেই মানুষটিকে বলা হচ্ছে স্বতন্ত্র বীর, কেন? বলা হচ্ছে এই ক্ষমাবীর বিনায়ক দামোদর সাভারকর নাকি ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং আর নেতাজি সুভাষ বসুর অনুপ্রেরণা। তাঁর ক্ষমা চাওয়ার চিঠি বহুচর্চিত, বহুবার আমরাই বলেছি, সে কথাতেও আসব, তার আগে দেখে নেওয়া যাক, রণদীপ হুডার সিনেমাতে যে দাবি করা আছে, সেই তথ্য নিয়ে ইতিহাস কী বলছে? কারণ লোকমুখে লোককথা তৈরি হয়, ইতিহাস নয়। ইতিহাস সাল সন তারিখ মেনেই যা ঘটেছে তার প্রামাণ্য বিবরণ। প্রথমে আসা যাক ক্ষুদিরাম বসুর কথায়। খুব নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে তাঁর সম্বন্ধে যা বলা যায় তা হল এক ১৮ বছরের কিশোর অনুশীলন সমিতির পরিকল্পনায় ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেবকে মারতে গিয়েছিলেন, ঘটনাচক্রে মিস অ্যান্ড মিসেস কেনেডি নামের দুই মহিলা মারা যান। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন, তাঁকে ফাঁসির সাজা শোনানোর পরে বিচারক জিজ্ঞেস করেন যে ক্ষুদিরাম এই সাজার অর্থ বুঝেছেন কি না? ১৮ বছর বয়সি কিশোর হেসেই জবাব দেন, বিলক্ষণ বুঝেছি। এবং ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ইংরেজি পত্রিকা দ্য এম্পায়ার লিখছে, ক্ষুদিরাম বসু ফাঁসিকাঠেও ছিলেন চিয়ারফুল অ্যান্ড স্মাইলিং, হাসিমুখে আনন্দেই তিনি ফাঁসির মঞ্চে ওঠেন। এদিকে সেই সময়ে সিনেমাতে বলা তাঁর অনুপ্রেরণাদাতা স্বতন্ত্র বীর সাভারকর তখন কী করছিলেন? প্রথমত তখন তিনি দেশে ছিলেন না, তিনি তখন বিদেশে। ১৯০৯-এ একটা বই দ্য ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স লেখার পরে কিছু মানুষের তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায়, তার আগে তিনি ব্যারিস্টারি পড়তে পড়তে লন্ডনে ইন্ডিয়া হাউজে যে সব বিপ্লবীরা জড়ো হতেন, সেই সমস্ত বৈঠকে হাজির থাকতেন। ১৯০৯-এ মদন লাল ধিংড়া কার্জন উইলিকে প্রকাশ্যেই খুন করেন এবং এই হত্যার সঙ্গে নাম জড়ায় সাভারকরের, পুলিশ তাঁকে খুঁজতে থাকে। তিনি প্যারিসে পালিয়ে যান, শেষে ধরাও পড়েন, তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসার পথে তাঁর সেই বিখ্যাত ‘জহাজ সে ছলাং’ লাগানোর ঘটনা, তিনি জাহাজের পট হোল দিয়ে সমুদ্রের জলে লাফ মারেন, কিন্তু মাত্র ৭ মিনিটের মধ্যেই পাড়ে ওঠার পরেও তিনি ধরা পড়েন, যা আমরা তাঁর লেখা বিবরণ থেকেই পাই। ভারতে আসার পরে তাঁর বিচার শেষে ৫০ বছরের জেলের আদেশ নিয়ে তাঁকে আন্দামানে পাঠানো হয়। অর্থাৎ দেশের মধ্যেও মানুষ তাঁকে চেনেন ১৯১০-এ, ওদিকে আগস্ট ১৯০৮-এ ক্ষুদিরাম বসু শহীদ হয়েছেন। কে কার থেকে প্রেরণা নেবেন? এই জেলে ঢুকেই উনি ক্ষমা চাইলেন। মানে ৬ জুলাই ১৯১১তে তাঁকে আন্দামানে নিয়ে যাওয়া হল, ৩০ আগস্ট ১৯১১তে তিনি তাঁর প্রথম ক্ষমা প্রার্থনা জমা করে দিলেন, ১৯০৮-এ ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে শহীদ হয়েছিলেন। রণদীপ হুডা ডাঁহা মিথ্যে বলছেন, না জেনে নয়, এই মিথ্যেও এক বিরাট পরিকল্পনার অঙ্গ।
এরপর রণদীপ হুডার দাবি, শহীদ ভগত সিংও নাকি সাভারকর দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। প্রথমত অনুপ্রেরণা শব্দটা এই সময়ের মতো অত ছোঁয়াচে ছিল না, যে কেউ যার তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হত না। ভগৎ সিংয়ের অনুপ্রেরণা ছিল না? ছিল বইকী, অগস্ত ভ্যালেঁ, এক ফরাসি বিপ্লবী যিনি ৯ ডিসেম্বর ১৮৯৩-এ ফ্রেঞ্চ চেম্বার অফ ডেপুটিজ, যা খানিক আমাদের আইনসভার মতো ছিল, সেখানে বোমা ছুড়েছিলেন, তাঁকেও ফাঁসি দেওয়া হয়। ভগৎ সিং এনার জীবনী পড়ে অনুপ্রাণিত হন। কতটা? ভগৎ সিং বোমা ছোড়ার পরে আদালতেই বলেছিলেন, বধির শাসককে কিছু শোনানোর জন্য একটা বড় শব্দের প্রয়োজন ছিল, আমি ঠিক সেটাই করেছি, ঠিক একই কথা অগস্ত ভ্যালেঁও বলেছিলেন। তাহলে এই সাভারকরের অনুপ্রেরণার কথা আসছে কেন? কারণ ভগৎ সিংয়ের জেল ডায়রি। বিচার চলছে, ফাঁসির ঘোষণা হয়েছে, সেই সময়, এমনকী ফাঁসি হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত তিনি পড়তেন, প্রচুর প্রচুর বই পড়তেন। সেই বই এর তালিকাতে রাসেল ছিলেন, দস্ত্রেওভিস্কি ছিলেন, মার্কস ছিলেন, লেনিন ছিলেন। সেই বইগুলো থেকে কিছু কথা তাঁর ডায়রিতে টুকে রাখতেন। সেখানেই সাভারকরের ওই দ্য ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স বই থেকে তিন চার লাইন তিনি টুকে রেখেছিলেন। এগুলো অনেকেই করেন, এই কথা নিয়ে তিনি কিছু লিখবেন বা বলবেন, তাই কোটেশন জড়ো করে রাখা হয়। কিন্তু গোটা ডায়রিতে ছ’ লাইন লেখা দেখেই অনুপ্রেরণার গল্প তৈরি? মজার কথা হল ওই ডায়রিতে জালিয়ানওয়ালাবাগের কুখ্যাত মাইকেল ও’ডয়ার, সে সময়ের পঞ্জাবের গভর্নর, যিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিল্যান্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ারকে গুলি চালানোর আদেশ দিয়েছিলেন, সেই মাইকেল ও’ডয়ারেরও কিছু লাইন, একটা কোটেশন আছে, তিনি হয়তো কোনও লেখার জন্য তা টুকে রেখেছিলেন। তাহলে তো বলতে হয় ভগৎ সিং মাইকেল ও’ডয়ার দ্বারাও অনুপ্রাণিত ছিলেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | সাভারকর পথ দেখিয়েছিলেন নেতাজিকে?
চলুন ক্ষমাপ্রার্থনার অনুপ্রেরণাটা একবার দেখে নেওয়া যাক। জেলে ঢোকার এক মাসের মধ্যেই ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা চাইছেন ক্ষমাবীর সাভারকর, আর ভগৎ সিং? ফাঁসির আদেশ হয়ে গেছে, বাবা কংগ্রেসি অজিত সিং ব্রিটিশদের কাছে পুত্রের প্রাণভিক্ষা করে চিঠি পাঠিয়েছেন। ভগৎ সিং বাবাকে চিঠি লিখছেন, এরকম কাপুরুষতা আমি আশা করিনি, আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়ছি, যা আমাদের জন্মসিদ্ধ অধিকার। এটা একটা যুদ্ধ চলছে। এখানে ক্ষমা কিসের? আপনার এই ক্ষমাপ্রার্থনা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লজ্জা দেবে। একেবারে শেষ দেখায় কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সর্দার অজিত সিং, বলেছিলেন, ভগৎ আমাকে ক্ষমা কোরো। হ্যাঁ, এটাই ছিলেন ভগৎ সিং, অনুপ্রেরণা কে কার কাছ থেকে নেবে? জেলে ঢোকার পর থেকে সাভারকর এবং তাঁর ভাই, বৌদিরা মিলে মোট ১৫-১৬টা ক্ষমাযাচিকা দায়ের করেছেন, নানান ভাষায়, কখনও আমাকে ক্ষমা করে দিন, কখনও আমি আমার ভাই এসব কাজে আর জড়িত হব না ইত্যাদি লিখেছেন, কখনও সব্বাইকে ছেড়ে দিন, মধ্যে এক লাইন আমাকে ধরে রাখুন বাকিদের ছেড়ে দিন জাতীয় কথাও লিখেছেন। আচ্ছা ক্ষমাযাচিকা, ক্ষমাপ্রার্থনা কি নতুন ব্যাপার? না এক্কেবারেই নয়। অনেক বিপ্লবীও ক্ষমা চেয়েছেন, হতাশ হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন, কষ্ট সহ্য না করতে পেরে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু সেসব ক্ষমাযাচিকা আর সাভারকারের ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্যে দুটো তফাত আছে। প্রথমটা হল এইসব ক্ষমা চেয়ে বা রেহাই চেয়ে চিঠিগুলোতে তিনি সাফ জানিয়েই দিচ্ছেন, তিনি এরকম কাজ আর করবেন না, শুধু তাই নয়, যারা এ ধরনের চিন্তাভাবনা করেন, তাঁদেরকেও সঠিক পথে নিয়ে আসবেন। তিনি লিখছেন, “সরকার যদি তাদের বহুমুখী দয়ার দানে আমাকে মুক্ত করে দেন, তাহলে আমি আর কিছু পারি না পারি চিরদিন সাংবিধানিক প্রগতি এবং ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্যের অবিচলিত প্রচারক হয়ে থাকব। সরকার আমাকে যত কাজ করতে বলবে, সেই মতো আমি সব কাজ করতে প্রস্তুত। কারণ, আমার আজকের পরিবর্তন যেহেতু বিবেকের দ্বারা পরিচালিত, তাই আমার ভবিষ্যতের আচরণও সেইরকমই হবে।” এটাই নয় এরপরে লিখছেন, “‘অন্যভাবে যা পাওয়া যেতে পারে, সেই তুলনায় আমাকে জেলে আটকিয়ে রাখলে কিছুই পাওয়া যাবে না। শক্তিশালীর পক্ষেই একমাত্র ক্ষমাশীল হওয়া সম্ভব। কাজেই অনুতপ্ত সন্তান, প্রডিগাল সন, বখে যাওয়া ছেলে, পিতৃতুল্য সরকারের দরজা ছাড়া আর কোথায় ফিরে যাবে। মহামান্য হুজুর অনুগ্রহ করে বিষয়টি বিবেচনা করবেন এই আশা রইল।” কাজেই ক্ষমাপ্রার্থনার ভাষা নিয়েই প্রথম প্রশ্ন।
কিন্তু তারচেয়েও বড় প্রশ্ন আছে। যা খুশি লিখে ক্ষমা চাইবার পরে জেল থেকে বেরিয়ে আবার একই বিপ্লবের পথে হাঁটব, এটাও তো একটা পরিকল্পনা হতেই পারে। উদাহরণও আছে, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল। ওনারই সঙ্গে আন্দামানেই ছিলেন, ক্ষমা চাইলেন, ছাড়া পেলেন, ছাড়া পেয়েই কাকোরিতে ট্রেন ডাকাতি করেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান সোশ্যালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে। ধরা পড়েন, এবার ফাঁসিও হয়। উত্তরপ্রদেশের গোন্ডা জেলে, যে গোন্ডার সাংসদ বিজেপির ব্রিজভূষণ শরণ সিং, যাঁর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আছে। আলোচনায় ফিরি। তো সাভারকর কি এইরকম কিছু ভাবছিলেন? জেল থেকে ছাড়া তো পাই, তারপরে দেখে নেব? না, সেটা হলে তো এত প্রশ্ন উঠত না। তাঁর অজস্র ক্ষমাযাচিকার পরেও তাঁকে জেল থেকে না ছেড়ে মহারাষ্ট্রের ইয়েরওয়াড়া জেলে পাঠানো হয়। সেখানে বসেই তিনি তাঁর মুক্তির অন্য পথ খুঁজে নেন, এখানে বসেই তিনি হিন্দুত্ব বইটি লেখেন, তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামের শত্রু তখন বদলে গেছে, তিনি ইংরেজ নয়, মুসলমানদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হিন্দুদের এক ব্র্যাকেটের তলায় আনার পরিকল্পনা, হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণা এখান থেকেই শুরু। অর্থাৎ তিনি জেল থেকে বেরিয়ে লড়বেন ইংরেজদের সঙ্গে? না, তিনি ইংরেজদের কথা দিয়েছেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়া তো দূরস্থান, তিনি ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলাটাই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন। কাজেই তাঁর ক্ষমাযাচিকা ছিল তাঁর অন্তরের কথা, যে মানুষ তাঁর প্রথম বইতে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইকে সেলিব্রেট করছেন, উদযাপন করছেন। বারবার তাঁর বইতে তিনি লিখছেন, দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল হিন্দু-মুসলমানের যৌথ নেতৃত্বে। সেই মানুষটা কেবল আন্দামান থেকে বেরিয়ে মহারাষ্ট্রের জেল থেকে জানিয়ে দিলেন, হিন্দু-মুসলমান দুটো আলাদা জাতি, তারা এক সঙ্গে থাকতে পারে না, লড়তে হবে ওই মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে। যখন দেশের শাসক ব্রিটিশ, তখন তিনি এই কথা বলছেন। স্বাধীনতা কেন, স্বাধীনতার পরেও তিনি সেই জন্যই কাজ করেছেন। কেবল তাই নয়, স্বাধীনতার পরেও আবার তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন, হ্যাঁ আবার। সেই কথা বলবো কাল। আপনাদের মতামত জানান।