মোদিজি তাঁর দেশ সেবার কথা বলেছেন, বলেছেন বিরোধীরা কীভাবে তাঁর কবর খুঁড়তে চায়, বলেছেন দেশ কীভাবে হই হই করে এগিয়ে চলেছে বিকাশের লক্ষ্যে। তো এসব কথা বলার জন্য যাওয়া আসা ইত্যাদি মিলিয়ে সময় লেগেছে ১১০ মিনিট, আর খরচ হয়েছে প্রতি মিনিটে ৮.৬২ লক্ষ টাকা। দেশের একজন প্রান্তিক চাষি মাসে রোজগার করেন ১৪-১৫ হাজার টাকা। মোদিজি তাঁর দেশপ্রেমের বাওয়াল দিতে যে টাকা মিনিটে খরচ করলেন, তা ওই প্রান্তিক চাষির ৫ বছরের রোজগার। সত্যিই এরপর দেশ যে এগিয়ে চলেছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। তাহলে এবার জানতে ইচ্ছে করবেই যে মোদিজি এই অমৃতবচন কোথায় গিয়ে দিলেন যার দাম মিনিটে ৮.৬২ লক্ষ টাকা? তিনি গিয়েছিলেন কর্নাটকে। অবশ্য ভোটের মুখে তিনি আর যাবেন কোথায়? যে রাজ্যে ভোট সেই রাজ্যে ১০টা শিলনোড়া পোঁতার পরে কংগ্রেসের জন্য দেশ এগোয়নি আর এখন দেশ গড়গড়িয়ে চলছে, এটা বলতেই তো তিনি যান, বটমলাইন হল ভোট ভিক্ষা।
তো কর্নাটকে গিয়েছিলেন মোদিজি, সফরসূচি সবটা জুড়ে দেখা গেল, তিনি ১১০ মিনিট কাটিয়েছিলেন কর্নাটকের হুবলি ধারওয়াড় জেলায় আইআইটি-র নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধনে। বিরোধী জেডিএস নেতা গুরুরাজ হানশাহিমারাদ একটা আরটিআই করে মোদিজির এই ১২ মার্চের অনুষ্ঠানের খরচ জানতে চেয়েছিলেন। জানা গেল, ১১০ মিনিটের এই রাজকীয় অনুষ্ঠানে খরচ হয়েছে ২০ কোটি টাকা। এবার তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে সেই ক্যাম্পাস তৈরি করতে কত খরচ হয়েছিল? অনেকে এই প্রশ্নও করতে পারেন যে এই ২০ কোটি টাকা সেই ক্যাম্পাসেই খরচ করলে আর কী কী করা যেত? মোদিজি কেবল ক্যাম্পাসের উদ্বোধন করবেন আর চলে যাবেন তা তো হয় না, ইনি জ্ঞান দেবেন, সেই জ্ঞান যাঁরা শুনতে আসবেন, তাঁদের আনার জন্য কর্নাটক পরিবহণ দফতরের খরচ হয়েছে ২.৮৯ কোটি টাকা। সভামঞ্চ, সামনের প্যান্ডেল, ফকির প্রধানমন্ত্রীর জন্য এয়ারকন্ডিশন ইত্যাদির খরচ হয়েছে মাত্র ৪.৬৮ কোটি টাকা। কেবল খাওয়ার জন্য খরচ হয়েছে ৮৬ লক্ষ টাকা। মাইক, ক্লোজ সার্কিট টিভি, ব্যারিকেড তৈরির খরচ ৪০ লক্ষ টাকা, ব্যানার ফেস্টুন, বিভিন্ন প্রচারে খরচ হয়েছে ৬১ লক্ষ টাকা। ৬০ হাজার লোক আনতে জন প্রতি খরচ হয়েছে ১০০০ টাকা। মাত্র ১১০ মিনিট তিনি ওই ক্যাম্পাসে ছিলেন, ভাষণ দিয়েছেন, চলে গেছেন তার খরচ ৯.৪৯ কোটি টাকা, মানে মিনিটে ৮.৬২ কোটি টাকা। গত ৯ বছরে বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে মোদিজির উপস্থিতিতে খরচ হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।
এই কর্নাটকে তিনি কতবার গেলেন? নয় নয় করে ৮ বার, বিভিন্ন প্রকল্পের নাম করে সেখানে যাওয়া, আদতে ফকির তাই সকালে দুপুরে আর বিকেলে আলাদা পোশাকে তো ওনাকে দেখেইছি, এবার দেখা গেল জলপাই পোশাক পরে মাথায় টুপি দিয়ে সাফারিতে যেতে। চোখে রে ব্যানের রোদচশমা, পকেটে গোঁজা মঁ ব্লাঁ পেন, পোশাক আর জুতোর দাম লাখখানেক তো হবেই, উনি নাকি ফকির। আজ থেকে বহু আগে একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, আমার পোশাক-আশাকের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কোনও দামি জিনিস পাবেন না, কিন্তু আমি টিপটপ থাকতে ভালোবাসি। আজ কার্টিয়ের, রে ব্যান, মঁ ব্লাঁ ব্র্যান্ড ছাড়া তাঁর চলেই না। সে না চলুক, আপাতত আলোচনার বিষয় কর্নাটক। সামনে কর্নাটকের নির্বাচন, মোদিজি সেখানে যাচ্ছেন, পাল্লা দিয়ে অমিত শাহ, তাঁর সঙ্গে মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যরা। কোটি কোটি টাকা ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে সরকারের যেগুলো ছিল সরকারি অনুষ্ঠানের আড়ালে আদত ভোটপ্রচারের। এবার ভোট প্রচারও শুরু হবে, সেখানেও অবশ্যই পিছিয়ে থাকবে না বিজেপি। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। টাকা তো ছড়াচ্ছেন মোদিজি, খোলামকুচির মতো পয়সা খরচ হচ্ছে কিন্তু তারপরেও টেনশন তো কমছে না। তাহলে আসুন টেনশনের মূল কারণটাই বলে নিই। ২০১৮-র পরে এই প্রথম কোনও রাজ্যে প্রি পোল, মানে নির্বাচনের আগে সমীক্ষাতে কংগ্রেস এগিয়ে আছে বা কংগ্রেস জিতছে এমন সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। এবং সে সব সংস্থা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজি যে ইতিহাস আজকের ছাত্রদের পড়াতে চান
এবিপি নিউজ-সি ভোটারের হিসেবে কংগ্রেস ২২৪টা আসনের মধ্যে ১১৫ থেকে ১২৭টা আসন পেতে পারে, বিজেপি ৬৮ থেকে ৮০টা আসন, জেডিএস, দেবেগৌড়ার দল ২৩ থেকে ৩৫টা আসন পেতে পারে আর অন্যান্যরা ০ থেকে ২। লোক পোল বলছে ১১৬ থেকে ১২৩টা আসন পাবে কংগ্রেস, ৭৭ থেকে ৮৩ পাবে বিজেপি, ২১ থেকে ২৭ পাবে জেডিএস। মাট্রিজ নামের একটি এজেন্সির সমীক্ষায় বিজেপি পাবে ৯৬ থেকে ১০৬, কংগ্রেস ৮৮ থেকে ৯৮, জেডিএস ২৩ থেকে ৩৩। অর্থাৎ তাদের মতে কাঁটে কা টক্কর। পপুলার পোলস নামে এক এজেন্সি বলছে রাজ্য ক্লাসিকাল হাং অ্যাসেম্বলির দিকে এগোচ্ছে, কংগ্রেস পেতে পারে, তাদের হিসেবে ৮২ থেকে ৮৭ কংগ্রেস, ৪২ থেকে ৪৫টা আসন পেতে পারে জেডিএস। এবং কেবল এই সমীক্ষাই নয়, বিজেপির নিজের সমীক্ষাও বলছে যে এগিয়ে আছে কংগ্রেস। তাতে কী? দলের নাম কংগ্রেস নয়, দলের নাম বিজেপি। যত রকমের অস্ত্র থাকতে পারে সবটা বের হতে শুরু হয়ে গেছে। সেসব অস্ত্রের কথায় আসছি, তার আগে একবার বুঝে নেওয়া যাক, এই কর্নাটকের নির্বাচন তা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? এমনিতে দক্ষিণে বিজেপির শক্তি কোথায়? তামিলনাডু শূন্য, কেরালা শূন্য, অন্ধ্রপ্রদেশ ২৫-এ শূন্য, তেলঙ্গনা ১৭তে ৪ জন বিজেপি। মানে দাক্ষিণাত্যে ভরসা বলতে এই কর্নাটক। কিন্তু কর্নাটকের রাজ্য রাজনৈতিক ইতিহাস ও বিজেপির পক্ষে, তাও নয়। প্রত্যেকবারই তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে দূরেই থাকতে হয়েছে। কিন্তু তাঁরা দল ভেঙে, এমএলএ জোগাড় করে সরকার তৈরি করেছেন। এবারে কিন্তু তাদের সরকার পেতেই হবে। না পেলে দাক্ষিণাত্যে যে পা তারা রেখেছে, সেখান থেকে তাদের পেছনে সরতে হবে। কেবল তাই নয়, কর্নাটক কংগ্রেস জিতলে রাহুল গান্ধীর পদযাত্রার ওপর নির্বাচনী সিলমোহর পড়বে। হিমাচলের জয় সরাসরি পদযাত্রার নির্বাচনী প্রভাবের বাইরেই ছিল, কিন্তু কর্নাটকের জয় সরাসরি ওই পদযাত্রার রাজনৈতিক ফলাফল হিসেবে উঠে আসবে। দুই, নিজের রাজ্যে হেরেছেন জগৎপ্রকাশ নাড্ডা, কিন্তু মল্লিকার্জুন খাড়গে? একজন কন্নডিগা, কর্নাটকের ভূমিপুত্র, কাজেই সেই জয় কংগ্রেসকে নতুন অক্সিজেন দেবে। এবং এই নির্বাচনের পরেই তেলঙ্গনা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থানের নির্বাচন, সে লড়াই বিজেপির কাছে কঠিন হবে কারণ কংগ্রেস তার নতুন শক্তি নিয়ে মাঠে নামবে।
এবং আমরা যতই বলি যে লোকসভা আর বিধানসভার নির্বাচন এক নয়, তাও এইসব রাজ্যের নির্বাচনের ফলের প্রভাব অবশ্যই লোকসভায় পড়বে। কোনওভাবে একট বিরোধী সরকার তৈরি হলে এই ১০ বছরের যে যে অস্ত্র বিজেপি ব্যবহার করেছে, সেই সবকটা অস্ত্র ব্যবহৃত হবে তাদেরই বিরুদ্ধে, সেটাও বিজেপি জানে। কিন্তু এবার অন্যদিকটাও ভাবুন। অনেকেই বলছে, ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ওই শুরুয়াতি ঝিমিয়ে পড়াই জেতা দলকে হারায়। হারা দলকে জেতায়। কংগ্রেসের সমস্যা হল তার জেতার জন্য যে খিদে, তার অভাব। খেলাধুলোয় যাকে বলে সেই কিলিং স্পিরিট, সেটা বিজেপির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে, কংগ্রেসের নেই, অন্তত রাহুল গান্ধীকে দেখলে তেমন খিদে টের পাওয়া যায় না। বরং একজন ভালো আদর্শবাদী আধা দার্শনিক টাইপের রাজনীতিবিদও মনে হয়। কাজেই এই জেতা ম্যাচও তারা হারতেই পারে, তাহলে এক্কেবারে উলটো ফলাফল দেখব আমরা। আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজস্থানে কংগ্রেসের ভাঙন দেখব, আমরা তেলঙ্গনায় কংগ্রেসের আরও অনেক নেতাদের, যাঁরা কদিন আগেই রাহুলের পদযাত্রায় হেঁটেছেন, তাঁদের দেখব দল ছেড়ে চলে যেতে। সত্যিই দেশ এক কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের দিকে হাঁটা দেবে। সেও বিজেপির কাছে আরেক সমস্যা, কিন্তু সে আলোচনা আরেকদিন করা যাবে। আপাতত কর্নাটক হল এক ওয়াটারলু, যেখানকার ফলাফল আগামী ভারতীয় রাজনীতির আঙিনায় অনেক উত্থান-পতনের সূচনা করতে পারে। তাই কর্নাটকে যেতেই পারেন ভাগ্যানুসন্ধানে। গত ২০২১-এর ভোটে হুগলির এক বাসিন্দা, চেন্নাই থেকে তৃণমূল, কংগ্রেস, বিজেপির প্ল্যাস্টিক ফ্ল্যাগ ছাপিয়ে এনে তাঁর দাবি মতো কোটি টাকা কামিয়েছেন।
কর্নাটকে কোটি নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা উড়তে শুরু করেছে, টাকা ওড়ানোর নেতৃত্বে দেশের প্রধানমন্ত্রী। ভাবুন একবার এক মিনিটে ৮.৬২ লক্ষ টাকা খরচ করছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। টাকা উড়ছে, ধরতে পারলে ধরুন।