বৃহস্পতিবার আবার দেশের মানুষ দেখল, আদানি সম্পর্কিত নির্দিষ্ট অভিযোগের একটারও জবাব না দিয়ে দেশের চায়ওলা, কাম চওকিদার কাম ফকির একইভাবে অনাপ সনাপ বকে গেলেন। গোটা বক্তৃতা জুড়ে হোয়াটঅ্যাবাউটরি, কেন রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নেহরু পদবি ব্যবহার করেন না, দেশ এগিয়ে চলেছে, ৭০ বছরে এই প্রথম ভারতবর্ষকে বিশ্ব স্বীকৃতি দিচ্ছে, এবং সেই পুরনো ভিকটিম কার্ড, আমার দিকে, সরকারের দিকে কিচড়, কাদা ছোড়া হচ্ছে। আসলে কেউ প্রশ্ন করলেই মোদিজির মনে হয় সে কাদা ছুড়ছে, প্রশ্নাতীত আনুগত্য চান তিনি, দুনিয়ার প্রত্যেক স্বৈরতান্ত্রিক যেমনটা চায়। তিনি বলছেন, আমাদের নামে মিথ্যে নোংরা অভিযোগ আনা হচ্ছে, শুনুন- https://youtu.be/spgDpctQnLw (1:25:17–1:25:44)। মোদিজি, অভিযোগ নোংরা না মিথ্যে তা কখন বোঝা যাবে? তখনই বোঝা সম্ভব যখন আপনি যুক্তি দিয়ে তথ্য দিয়ে বোঝাবেন যে এই অভিযোগগুলো মিথ্যে, কেবল নোংরা আর মিথ্যে অভিযোগ বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা তো আমরা বুঝতে পারছি। আপনাকে প্রশ্ন করলেই আপনি ভিকটিম কার্ড খেলতে শুরু করবেন। কী না আপনাকে গালি দেওয়া হচ্ছে, কী না আপনার দিকে কাদা ছোড়া হচ্ছে। আরে বাবা জবাব দিন অভিযোগের, আপনাকেই তো বলতে হবে যে একজন ব্যবসায়ী যিনি পৃথিবীর ৬০৯ নম্বর ধনী ছিলেন, তিনি আপনি আসার পরে মাত্র সাত বছরে কীভাবে ২ নম্বরে এলেন? এর উত্তর তো আপনার কাছেই আছে যে আপনি তাঁকে সঙ্গে করে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন, যেখানেই যাচ্ছেন সেই দেশের সঙ্গে ওই আদানির ব্যবসায়িক চুক্তি পাকা হয়ে যাচ্ছে কেন? কার নির্দেশে? জবাব না দিয়ে এই ভিকটিম কার্ড খেলা বন্ধ করুন, ওসব ভ্যানতাড়া মানুষ বুঝে গেছে।
আপনি আধার কার্ড নিয়ে বললেন। প্রশ্ন হচ্ছে আদানিদের দুর্নীতি নিয়ে আপনি আধার কার্ড নিয়ে বলছেন, কী বলছেন? দেশের মানুষকে জানাচ্ছেন যে বিরোধীরা কীভাবে আধার কার্ডের বিরোধিতা করছে। শুনুন- https://youtu.be/spgDpctQnLw (1:16:38–1:16:56)। এবার দয়া করে আপনার, হ্যাঁ আপনারই পুরনো একটা ভাষণ শুনুন, আপনি সেদিন কী বলেছিলেন? https://youtu.be/qObQujgptfg (00:54) সেদিন আপনিই বলেছিলেন আধার কার্ড দিয়ে আসলে দেশের সুরক্ষা নষ্ট করা হচ্ছে, ওরা আধার কার্ড আনলে বিলা, আর আপনি আনলে লীলা? এরপরে ভাষণে জিএসটি নিয়ে বললেন, বিরোধীরা নাকি জিএসটি আনতে দিচ্ছে না। আদানির দুর্নীতিতে আপনার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন, আপনি জিএসটির কথা বলছেন https://youtu.be/spgDpctQnLw (1:16:56–1:17:11)। আপনি বলছেন বিরোধীরা জিএসটির বিরোধিতা করেছে, বেশ তাহলে আপনাকে শোনাই আপনারই পুরনো ভাষণ। https://youtu.be/RLqVORhK46Y (51–1:11)। আপনি সেদিন বলেছিলেন আগে আইটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে আর ক্ষমতায় এসেই ২০১৭ জুলাই মাসে জিএসটি লাগু করলেন। আজকের তথ্য হল, রাজ্যের পাওনা ৬০ হাজার কোটি টাকা বাকি আছে জিএসটি বাবদ। এখনও জিএসটির ৫-৬টা আলাদা স্ল্যাব, এখনও জিএসটি নিয়ে জটিলতা কাটেনি বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে, আপনার, আপনাদের অবিমৃশ্যকারিতার জন্য, অথচ আপনি বিরোধীদের দোষ দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: এই প্রথম রাহুল গান্ধীকে উপেক্ষা করতে পারলেন না নরেন্দ্র মোদি
আদানি–মোদি সরকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার জবাবে এরপর আপনি তুললেন হ্যাল, হিন্দুস্থান এরোন্যাটিকস লিমিটেড-এর প্রশ্ন, হ্যাল নাকি আপনার আমলেই বেড়ে উঠেছে, বললেন সদনে দাঁড়িয়ে। https://youtu.be/spgDpctQnLw (1:17:11–1:17:36)। আচ্ছা মোদিজি, এই হ্যাল কবে প্রতিষ্ঠিত? ইংরেজদের হিন্দুস্থান এরোক্রাফটস লিমিটেড ১ অক্টোবর ১৯৬৪তে হিন্দুস্থান এরোনটিক্স লিমিটেড হল। এরা মিগ ফাইটার প্লেন তৈরি করেছে, হ্যাল তেজস, হ্যাল ধ্রুব তৈরি করেছে, এয়ারবাস বোয়িং তৈরি করেছে, আর মোদিজি হ্যাল হেলিকপ্টার তৈরি করছে বলে তাল ঠুকছেন। ও মোদিজি, মিগ ২১, বোয়িং, এয়ারবাস ইত্যাদি হেলিকপ্টারের চেয়ে অনেক বড়, এগুলো আপনি যখন হাফ প্যান্ট পরে শাখায় হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর শপথ নিচ্ছেন, তখন হ্যাল বানিয়ে ফেলেছে, এরপরেও র্যাফায়েলের বরাত হ্যাল পায়নি, পেয়েছে আদানি। প্রশ্ন তো সেখানেই, সেই প্রশ্নের জবাব দিন। জবাব না দিয়ে মোদিজি চলে গেলেন কাশ্মীর, আবার অর্ধসত্য, যা নাকি মিথ্যের চেয়েও সাংঘাতিক, তাই নিয়ে গণতন্ত্রের পীঠস্থানে মানুষকে ভুল বোঝানোর জন্যই মোদিজি ব্যবহার করে থাকেন। তিনি নাটকীয়ভাবে জানালেন, শ্রীনগরে সিনেমা হল খুলে গেছে, হাউসফুল চলছে, শুনুন কী বললেন। https://youtu.be/spgDpctQnLw (1:23:15–1:23:24) তাই নাকি? তাহলে শুনুন সত্যিটা কী। শ্রীনগরে ৬টা সিনেমা হল ছিল, ৬টাই বন্ধ, কোনওটা মল হয়ে গেছে, কোনওটা হাসপাতাল। অত্যন্ত হাই সিকিউরিটি জোন সোনওয়ারে এক কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ একটা ছোট মাল্টিপ্লেক্স খুলেছেন, সেখানেও মানুষ যাচ্ছিল না, ক’দিন আগে সেখানে পাঠান লাগানোর পরে কিছু মানুষ যাচ্ছেন, কিন্তু হাউসফুল? ওটা মোদিজির কষ্টকল্পনা। আমাদের জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিনিধি নাসির যা পাঠিয়েছে সেটা দেখে নিন।
এরপর মোদিজি যা করলেন তা হল এক তামাশা, তিনি গান্ধীর কথা বললেন, বললেন বিরোধীরা নাকি গান্ধীর কথাও মেনে চলেন না। https://youtu.be/spgDpctQnLw (1:26:28–1:26:52)। আসুন মোদিজি, সেই ইতিহাসটা একটু মনে করা যাক। স্বাধীনতার ক’দিন আগে, ৪৭-এর আগস্ট মাসেই একই প্লেনে পাশাপাশি বসে দিল্লি এসেছেন তিনজন, বিনায়ক দামোদরদাস সাভারকর, নাথুরাম ভিনায়ক গডসে, নারায়ণ দত্রাত্রেয় আপ্তে। কয়েকমাস পরেই ৪৮-এর ১৮ জানুয়ারি, আবার অনশনে গান্ধীজি। দিল্লির মসজিদ, মুসলমান বাড়ি ঘরদোর দখল করেছিল হিন্দু, শিখ উদ্বাস্তুরা, তিনি বলেছিলেন দাঙ্গা থামাতে হবে, জবরদখল ছাড়তে হবে। বিরক্ত প্যাটেল, বিরক্ত নেহরু, আবার গান্ধীর অনশন, সব্বাই মিলে সই করে লিখেদিলেন, আর দাঙ্গা হবে না, দাঙ্গা থামল, জবরদখলকারীরা সরে গেল। হিন্দু শিখ উদ্বাস্তুরা বিড়লা হাউসের সামনে এসে স্লোগান দিল, গান্ধী তুমি বরং মরো, আমাদের আমাদের মতো থাকতে দাও, গান্ধী একলা। জানালেন ২ ফেব্রুয়ারির পরে পাকিস্তান যাব, আবার প্যাটেল আর নেহরুর মাথায় হাত, এই সময়ে গান্ধীজি করাচি যাবেন? ওদিকে গান্ধীহত্যার ষড়যন্ত্র শেষ, একটা চেষ্টা হল ২০ জানুয়ারি, ধরা পড়ল মদনলাল পাহওয়া, অনেক কিছুই বলল। যা বলল তা দিয়ে সাভারকর, নাথুরাম গডসে, গোপাল গডসে, নারায়ণ আপ্তে, দিগম্বর বাগড়ে, বিষ্ণু রামচন্দ্র কারকারে, শঙ্কর কিস্তিয়া সবকটাকেই গ্রেফতার করাই যায়। কেন জানা নেই, তদন্তই হল না। গডসে, আপ্তে আবার সাভারকরের বাড়িতে গেল, সাভারকরেরই নির্দেশে সেখান থেকে গোয়ালিয়র, সেখান থেকে গোয়ালিয়রে দত্রাত্রেয় সদাশিব পরচুরের বাড়িতে। জোগাড় হল ইতালিয়ান বেরেত্তা পিস্তল, গডসে আর আপ্তে চলে এল দিল্লি। নিউ এজ, কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকায় লেখা হল গান্ধীকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। পুলিশ, আইবির একজনও জানার চেষ্টাই করল না কারা ষড়যন্ত্র করছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: বিরোধী ঐক্য, রত্ন মণি মাণিক্য
গান্ধিজী তখনও একলাই শেষ চেষ্টা করছেন, দেশ বিভাজন হয়েছে হোক, তিক্ততা মিটে যাক, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ফিরে আসুক, তারপর দেখা যাবে। একলাই বলে যাচ্ছেন, একলা চলো রে। ৩০ তারিখ নাথুরাম গডসে খুন করল, তিনটে গুলি বুকে নিয়ে তখনও একলাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তারপরেই বল্লভভাই প্যাটেল, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গান্ধীহত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে আরএসএসকে ব্যান করলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে চিঠি লিখে জানালেন, আরএসএস গান্ধীহত্যার পরে মিষ্টি বিতরণ করেছে। সেই আর এসএস-এর প্রচারক নরেন্দ্র মোদি আজ দেশকে, দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে গান্ধী পড়াচ্ছেন। এতটুকু লজ্জা নেই, চিরটা কাল গান্ধীর বিরোধিতা করে বেড়ে ওঠা উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠনের প্রচারক আজ জ্ঞান দিচ্ছেন, দেশবাসীকে সেটা শুনতে হবে? মিডিয়া আর শঠ ধূর্ত ক্রোনি ক্যাপিটালের তৈরি এক নেতা অনায়াসে বলে গেলেন আমাকে টিভি, খবরের কাগজ তৈরি করেনি- https://youtu.be/spgDpctQnLw (53:52–54:55)। এবার শুনুন সত্যিটা, গত সাত বছরে এই মোদি সরকার ৬৪৯১ কোটি টাকা কেবল বিজ্ঞাপনে খরচ করেছে, মোদিজির সহাস্য মুখ আজ প্রত্যেক মোড়ে, ভ্যাক্সিনের সার্টিফিকেট থেকে খাবারের প্যাকেটে। সেই বিজ্ঞাপন থেকেই তৈরি হয়েছে এক ইমেজ, উনি দাঁড়ালেই চিৎকার মোদি মোদি, এবার জবাবে যখন বিরোধীরা আদানি বলতে শুরু করলেন, তখন দৃশ্যতই মোদিজিকে বিব্রত দেখাল। কিন্তু তখনও মোদিজি বুক ঠুকে বলে চলেছেন তাঁর নতুন লক্ষ্যের কথা, স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্তিতে দেশ কীভাবে এগিয়ে যাবে তার কথা, যে কথার মধ্যেই কেবল ভুয়ো প্রতিশ্রুতিই নয়, এখন দুর্নীতির বড় অভিযোগও থেকেই গেল।
আবার কাকা হাথরসির কথা মনে পড়ল, ওনার কবিতার কথা মনে পড়ল।
সত্তা কি খুমারি সে আজাদি সো রহি হ্যায়,
হরতাল কিঁউ হ্যায় ইসকি পড়তাল হো রহি হ্যায়
লেকর কে কর্জ খাও ইয়হ ফর্জ হ্যায় হমারা
সারে জঁহা সে আচ্ছা হ্যায় ইন্ডিয়া হমারা
চোরো ওয় ঘুসখোরো পর নোট বরসতে হ্যায়
ইমান কে মুসাফির রাশন কো তরসতে হ্যায়
ভোটার সে ভোট লেকর উয়ে কর গয়ে কিনারা
সারে জঁহা সে আচ্ছা হ্যায় ইন্ডিয়া হমারা
জব অন্তরাত্মা কা মিলত হ্যায় হুকম কাকা
তব রাষ্ট্রীয় পুঁজি পর উয়ে ডালতে হ্যায় ডাকা
ইনকাম বহত হি কম হ্যায়, হোতা নহি গুজারা
সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হ্যায় ইন্ডিয়া হমারা