শুনেছিলাম বিজেমূল, এবার শুনলাম বিজেন্ডিয়া। বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক’দিনের মধ্যেই এই শব্দবন্ধ ছড়িয়ে যাবে সবখানে। এক্কেবারে পাড়ার, গ্রামের কর্মী সমর্থকদের মুখে শোনা যাবে বিজেন্ডিয়া, বিজেন্ডিয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ জানিয়েছেন, হ্যাঁ, জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্য আমরা করেছি, বিজেপিকে হটানোর জন্য ঐক্য, সেখানে সিপিএমও আছে, আমাদের তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলায় কংগ্রেস বা সিপিএম যেভাবে তৃণমূলের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিজেপির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, বিজেপিকে সুবিধে করে দিচ্ছে, তাতে করে অন্তত এ বাংলায় কংগ্রেস বা সিপিএম এর সঙ্গে কোনও আঁতাঁত সম্ভব নয়। তাই উনি মঞ্চ থেকে বিজেন্ডিয়া বলে চিহ্নিত করলেন কংগ্রেস, সিপিএমকে, যা ক’ দিনের মধ্যে শহুরে টিভির কলতলার ঝগড়ার অন্যতম ব্যবহৃত শব্দ হয়ে দাঁড়াবে, এতে কোনও সন্দেহই নেই। মমতা ওটাই চান, জেনেবুঝেই তিনি এই শব্দবন্ধ বাংলা বাজারে ছাড়লেন। উনি খুব ভালো করেই জানেন যে বাম-কংগ্রেস জোট হলে তৃণমূল ৩২-৩৩টা আসন পাবে, বিজেপি ৯-১০টা, কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হলে তৃণমূল ওই ৩২/৩৩ টা, কংগ্রেস ৩টে আর বিজেপি ৬টা। কাজেই ওঁর হারানোর কিছুই নেই। উনি বল রাহুল গান্ধীর কোর্টে ফেলে দিয়েছেন, নির্বাচন পর্যন্ত পুরোদস্তুর ইন্ডিয়া জোটের পক্ষে থাকবেন, তারপর রাজনীতি যে কোনও দিকে বাঁক নিতেই পারে। অতএব আপাতত যে ক’দিনের সাময়িক যুদ্ধবিরতি ছিল, তার ইতি। রাজ্যে তিন যুযুধান পক্ষ লড়ে যাবে, দেশজুড়ে যে জোটের কথা হোক না কেন, বাংলায় জোট হবে না, অন্তত মমতা এই ধারণাটা তৈরি করতে চাইছেন। সেটাই বিষয় আজকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজেন্ডিয়া।
আমাদের বাংলার রাজনীতি আপাতত তৃণমূল বিজেপি বাইনারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হতে বাধ্য। তার কারণ বাংলায় জোট হোক বা না হোক, দেশজুড়ে একটা জোট হয়েছে, মানুষ সেই জোটের কথা জানেন, জানেন সেই জোটের বৈঠকে বাদাম ভাগাভাগি করে খেয়েছেন রাহুল মমতা। জানেন কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি হাজির ছিলেন সেই বৈঠকে। এ রাজ্যে যত বিরোধিতা পারেন করুন, দলের সমর্থকদের কাছেই তা বোধগম্য হচ্ছে না, দলের সমর্থকরা প্রশ্ন করছেন, এখানে মমতাকে ফ্যাসিস্ট বলার পরে সীতারাম যদি তাঁর সঙ্গেই বৈঠকে হাত তুলে ছবি তোলান, তাহলে মানুষকে কী বলব? একই কথা কংগ্রেসের সম্পর্কেও, যে মুসলমান ভোটারদের ছোট হলেও একটা অংশ কংগ্রেসমুখো হচ্ছিলেন তাঁরাও দেখলেন উপরে সমঝোতা হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: Aajke | মুখ সামলে কমরেড সেলিম
হ্যাঁ, উপরের এই সমঝোতাকে ভাঙতেও দেবেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি জানেন ইন্ডিয়া জোট তাঁর বিজেপি বিরোধিতাকে প্রমাণ করার সবথেকে ভালো জায়গা, অতএব তিনি ইন্ডিয়া জোটে থাকবেন আর এখানে কংগ্রেস বা সিপিএমকে বিজেন্ডিয়া বলবেন। বিজেপি বিরোধিতার জন্যই তাঁর বিজেপি বিরোধী ভোট, সংখ্যালঘু ভোট ইনট্যাক্ট থাকবে, এরসঙ্গে জুড়বে ডাইরেক্ট বেনিফিশিয়ারিদের ভোট আর তৃণমূলের কোর ভোট, একটা শক্তপোক্ত ভোটব্যাঙ্ক। এবার হাইকমান্ডের চাপে অধীর-মান্নান-প্রদীপরা এল তো এল, না এল তো না এল। রাজ্য কংগ্রেসের বিরোধিতার কোনও মূল্যই নেই। কারণ হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ এলেই তাঁরা দল বেঁধে কালীঘাটে যাবেন। সাংবাদিকদের ডেকে ইন্ডিয়া জোটের আদর্শের কথা বলবেন, ৮টা আসন চাইবেন, তিনটে কি চারটে নিয়ে ঘরে ফিরে যাবেন। কিন্তু সিপিএম? তাদের পক্ষে জোটে যাওয়া সম্ভব নয়, দল উঠে যাবে। কেবল বামেরা দাঁড়ালে ভোট পার্সেন্টেজ আবার কমে ৬-৭ শতাংশ, তার বেশি হবে না। কাজেই তাঁরা কী করবেন, কী বলবেন তা ঠিক করে উঠতে পারছেন না। আজ গণশক্তির প্রথম পাতা খুলে দেখুন, বলা হয়েছে মমতা জানিয়ে দিলেন এ রাজ্যে তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই লড়বেন। প্রতিবেদন পড়ে মনে হবে বেঙ্গালুরুতে একসঙ্গে নির্বাচনে লড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মমতা সেই সিদ্ধান্ত মানছেন না, তা ওঁরা কেরলে কার বিরুদ্ধে লড়বেন? বিজেপির? সেকথা জিজ্ঞেস করা যাবে না কারণ ওটা তো কৌশল। বাংলায় তো নীতির প্রশ্ন, সিপিএম-এর নীতি আর কৌশল এতবার এদিক ওদিকে ঘোরে যে তাদের এই দুটো শব্দের মধ্যে দোদুল্যমানতা প্রথমে অবাক করত, পরে হতাশ করেছে, এখন তা হাস্যকর। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএম আর কংগ্রেসকে বিজেন্ডিয়া বলেছেন, আপনারা কি সত্যি মনে করেন এই বাংলায় বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস মিলে তৃণমূলের বিরোধিতা করছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সামনেই ধূপগুড়ির নির্বাচন, সেখানেও এই একই ছবি সামনে আসবে। বিজেপি বিরোধী প্রত্যেকটা দলকেই বুঝতে হবে মানুষ যদি এই জোটকে মন থেকে মেনে না নেয়, তাহলে সারা দেশেই তার প্রভাব পড়বে। কেরলে লড়াই হবে, বাংলায় লড়াই হবে, ইউপিতে লড়াই হবে, পঞ্জাব বা দিল্লিতে জোটের মধ্যেই লড়াই হবে আর মানুষের কাছে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীও জোটের অ্যাকসেপটেন্স বাড়বে, গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে, এমনটা কিন্তু হবে না। নির্বাচনী পাটিগণিতে মমতার ক্ষতি নেই, কংগ্রেসের ভালো-মন্দ তো কংগ্রেস বোঝে বলে মনেই হয় না আর বামেদের ভালো-মন্দের পরিভাষাই পাল্টে গিয়েছে। ধূপগুড়ির নির্বাচন একটা সংকেত দেবে বলেই আমাদের ধারণা, ওই বিজেন্ডিয়ার তত্ত্বের প্রথম প্রয়োগ ওখানেই হবে, আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া তো অন্য কোনও গতি নেই।