প্রেক্ষিত ছাড়া কোনও আলোচনা করা যায় না, উচিত নয়, কিন্তু মানুষ অনেক সময়েই এমন আলোচনা করে। প্রেক্ষিত ছাড়া বলতে কী বোঝাচ্ছি? ধরুন রাজস্থানের মরুভূমিতে জল নেই, আবার চাঁদেও জল নেই, এই দুটোকে কি তুলনা করা যায়। রাজস্থান পৃথিবীর এক অংশ, ভৌগোলিক কারণে বৃষ্টিপাত হয় না। পৃথিবীর এক ভাগ স্থল, তিন ভাগ জল, কিন্তু রাজস্থানের মরুভূমিতে জল নেই আর চাঁদ একটা উপগ্রহ, সেখানে কোথাও জল নেই, অন্তত এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু জল নেই বলে এ দুটোর তুলনা কি চলে? পঞ্চায়েতের সদস্য, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য, জেলা পরিষদের সদস্য, এমএলএ, এমপি, সবাই নির্বাচিত প্রতিনিধি, কিন্তু এদের নিয়ে কোনও তুলনা হয় নাকি? যারা প্রেক্ষিত ছাড়া তুলনায় নামেন তাঁরা হয় পাগল নয় শয়তান। আমরা সেই শয়তানি এই বাংলায় দেখছি। প্রথমে হাওড়া পাঁচলা, পরে মালদা নিয়ে কিছু কথা তোলা হচ্ছে। হাওড়ার পাঁচলাতে রাজ্যের ডিজি নিগৃহীত মহিলাকে থানায় এসে অভিযোগ দায়ের করতে বলার পরেও তিনি আসেননি, সিসিটিভি ফুটেজে নিগ্রহের কোনও ছবি পাওয়া যায়নি। ওদিকে মালদার ঘটনা গুরুতর, সেখানে দুই মহিলাকে নিগৃহীত করা হয়েছে, হেনস্থা করা হয়েছে, পরিধানের বস্ত্র ধরে টানাটানি হয়েছে, ছবি তাই বলছে, তারচেয়েও খারাপ যেটা সেটা হল তাঁদেরকে অন্যায়, মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু তারপরে সেসব সামনে এসেছে, সরকার ওই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন, অভিযুক্তদের গ্রেফতারও করা হয়েছে। অন্যদিকে মণিপুরের জাতিদাঙ্গা, যেখানে দেড়শোর বেশি মানুষ মারা গেছে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় শ’ খানেক মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন, ৬০ হাজার মানুষ ঘরছাড়া, সেই মণিপুরকে মালদার সঙ্গে তুলনা করছে বিজেপি, শুভেন্দু, লকেট, দিলীপ। সেটাই বিষয় আজকে, মালদা আর মণিপুর।
মালদা থেকে মণিপুরের ইম্ফল ১১৬০ কিলোমিটার দূরে। আজ তিন মাস ধরে মণিপুর জ্বলছে, মাত্র গতকালও মণিপুরে বাস জ্বালানো হয়েছে, যে বাসে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আধা সামরিক বাহিনীদের। মানে অবস্থাটা বুঝুন, দেশের অসামরিক বাহিনীকে থামিয়ে বাস থেকে নামিয়ে বাস পোড়ানো হচ্ছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীর ৮০ বছর বয়সি বিধবা স্ত্রীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, কার্গিলের দেশের হয়ে লড়েছেন জওয়ান তাঁর স্ত্রীকে নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়েছে, ধর্ষণ করানো হয়েছে। শুভেন্দু অধিকারী মালদা মালদা বলে চিৎকার করছেন, লকেট পাঁচলার মিথ্যে অভিযোগ নিয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | বিজেপি লোকসভায় বাংলায় ৩৫টা আসন পাবে?
আসলে মানবিকতা বোধ থাকলে সম্ভবত বিজেপিতে প্রবেশ নিষেধ, মানবিকতার যাবতীয় ধারণাকে কাঁধ থেকে নামানোর পরেই বিজেপির অন্দর মহলে প্রবেশের ছাড়পত্র মেলে। এই এনারাই তো সন্তানসম্ভবা মায়ের পেট চিরে, ভ্রুণ শিশুকে ত্রিশূলে গেঁথে উল্লাস করেছিলেন গুজরাতে, এনারাই তো জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিলেন বৃদ্ধ প্রাক্তন সাংসদ এহসান জাফরিকে গুলবার্গ সোসাইটির বাড়িতে। এরাই তো বিলিকিস বানোর বাবা, ভাই, কাকাকে খুন করে তার সন্তানকে আছাড় মেরে খুন করার পরে বিলকিসকে ধর্ষণ করেছিল। সেদিন ১১০০ মানুষকে খুন করা হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি, আজ মণিপুরে ১৫০ মানুষ খুন হয়েছেন, রাজ্য সরকারে সেই বিজেপি, মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং, তিনিও কোনও কথা বলছেন না, আর মোদিজি ৭৮ দিন পরে ৩৬ সেকেন্ড খরচ করেছেন ওই ভাইরাল ভিডিও নিয়ে তারই মধ্যে জুড়ে দিয়েছেন রাজস্থান, ছত্তিশগড়ের কথা, বাংলার কথা। মণিপুরের জাতি দাঙ্গার সঙ্গে তুলনা মালদার। আমরা আমাদের দর্শকদের সামনে এই প্রশ্নই রেখেছিলাম, মালদার দু’জন মহিলার নিগ্রহের সঙ্গে মণিপুরের জাতি দাঙ্গার কোনও তুলনা করা যায়? যাঁরা এই তুলনা করছেন তাঁরা কি আসলে মণিপুরের থেকে আমাদের নজর ঘোরানোর চেষ্টা করছেন?
ভারতের ইতিহাসে যে ক’টা বর্বর জাতি বা ধর্মের ভিত্তিতে দাঙ্গা হয়েছে, তার মধ্যে মণিপুরের এই জাতি দাঙ্গা অন্যতম। অসমের নেলী, ২০০২-এর গুজরাত, দিল্লির শিখ গণহত্যা, কাশ্মীরে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণদের হত্যা এবং ঘরছাড়া করার সঙ্গে মণিপুরের জাতি দাঙ্গা মনে থেকে যাবে। সমস্যা হল, এই ধরনের জাতি দাঙ্গা একটা সময়ে থামে বটে কিন্তু তার দাগ থেকে যায়, তার আগুন থেকে যায়, সুপ্ত আগেয়গিরির মতো তা জ্বলতে থাকে, আমার বাবাকে খুন করা হয়েছে। আমার মা ধর্ষিতা হয়েছিল, আমার ভাইয়ের লাশ দেখেছিলামের মতো কথাগুলো এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম বয়ে নিয়ে বেড়ায়, তারপর সময় সুযোগ জুড়ে আবার সামনে এসে হাজির হয়। অন্যদিকে সাধারণভাবেই পুরুষতান্ত্রিক সমজে মহিলাদের যৌন নিপীড়ন, নির্যাতন চলতে থাকে, সেগুলোর বিরুদ্ধেও লাগাতার বলতে হয়, সেগুলো কমেওছে, কিন্তু দূর হয়ে যায়নি, অত সহজে যাবেও না। কিন্তু সেই নির্যাতনের পরেই যদি আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যদি দোষীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে এই নারী নির্যাতন কমে। কিন্তু শয়তানি করে কেউ যদি কোনও এক বিচ্ছিন্ন নারী নির্যাতনকে জাতি দাঙ্গার সঙ্গে তুলনা করে জলঘোলা করতে চায় তাহলে তাকে চিহ্নিত করুন, সে মানুষ নয়, সে শয়তান, সেটা স্পষ্ট করে বলুন।