মুম্বই: হারমোনিয়াম বাজছে৷ গান শোনা যাচ্ছে৷ কিন্তু সম্রাজ্ঞীর অনুপস্থিতিতে আজ সব কিছুই ফ্যাকাসে৷ ঠিক যেমনটা দিনের শেষে মন্দিরের দরজা বন্ধের পর দেবতাকে আর দেখা যায় না৷ আর দেখা যাবে না সুরের দেবীকে৷ আরব সাগরের তীরে শিবাজি পার্কের কৃত্রিম মঞ্চের জ্বলন্ত আগুনে বিলীন হয়ে গেলেন সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর (Melody Queen Lata Mangeshkar)৷
তখন ঘড়ির কাঁটা ৭টা টপকেছে৷ গান স্যালুট হয়ে গিয়েছে৷ আগুন জ্বলল৷ মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করছেন অনেকেই৷ তালিকায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা৷ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব৷ বলিউডের অসংখ্য মানুষ৷ সস্ত্রীক সচিন তেন্ডুলকর। শাহরুখ খান, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে, রাজ ঠাকরে, শরদ পাওয়ার, শ্রদ্ধা কপূর, কে নেই!
শিবাজি পার্কের একদিক থেকে তখনও হাওয়া বইছে৷ গাছগুলো নতজানু হয়ে যেন ঈশ্বরকে শেষ বিদায় জানাচ্ছে৷ সূর্য নেমে গিয়েছে অনেকটাই৷ রাতের অন্ধকার যখন হাতছানি দিচ্ছে ঠিক তখনই পার্কের মাঝে তৈরি হওয়া মঞ্চটা জ্বলে উঠল৷ মঞ্চ ঘেরা লাল গালিচা। সাক্ষী হয়ে রইল চিরবিদায়ের।
লড়াইটা শুরু হয়েছিল প্রায় মাস খানেক আগে৷ খবর ছড়িয়েছিল তাঁর অসুস্থতার৷ তড়িঘড়ি মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় লতাকে৷ তারপর থেকে লড়াই শুরু৷ মাঝে করোনা আক্রান্ত হওয়া লতা মঙ্গেশকর অনেকটাই সুস্থ হয়েছিলেন৷ আশা জেগেছিল৷ আবার কি ‘ওয়াতেন’-এর মানুষগুলোর জন্য গাইবেন তিনি? ঠিক এমন সময় অশনি সঙ্কেত৷ শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি৷ আইসিইউতে স্থানান্তর৷ মনে কু ডাকা যেন শুরু হয়ে গেল৷
আরও পড়ুন: Lata Mangeshkar: স্বাধীনতার ৫০ বছরে সংসদে লতা গেয়েছিলেন ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’
রবিবার সকাল তখন ৮টা ১২৷ খবরটা ছড়িয়ে পড়ল৷ প্রয়াত হয়েছেন লতা মঙ্গেশকর৷ বাধ্যর্ক্যজনিত একাধিক সমস্যা ছিল৷ লড়াইটা আর টানতে পারলেন না৷ যাঁর গান নেহরুর চোখে জল এনেছিল সেই লতা আজ বিলীন হয়ে গেলেন৷ রেখে গেলেন তাঁর সৃষ্টি৷
Nation Bids Adieu to Lata Didi… Her mortal remains merged into Panchtatva pic.twitter.com/Iyd3pF00cg
— PB-SHABD (@PBSHABD) February 6, 2022
পরিবারের তরফে জানানো হয়েছিল, শিবাজি পার্কে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে৷ সেই মত শুরু হয় তোড়জোর৷ কঠোর নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয় গোটা পার্ক৷ শুরু হয় মঞ্চ তৈরি৷ সাদা রঙের মঞ্চে সারি সারি দেওয়া কাঠ৷ সেখানেই শেষবারের মত শোবেন লতাজি৷ ঘড়ি বলছে তখন ৪টে বেজে গিয়েছে৷ প্রভুকুঞ্জ থেকে রওনা দিল৷ তুঁতেপাড়ের শাড়িতে মোড়া দেহটা। হেঁটে নয়৷ জাতীয় পতাকায় ঢেকে, সেনা সদস্যের কাঁধে চড়ে৷ ৯০ ঊর্ধ্ব মানুষটার মুখ যেন বলে দিচ্ছিল, ‘এবার আমি একটু বিশ্রাম চাই৷ আমার কথা তোমরা মনে রেখো৷’ কফিন ঢুকল গাড়িতে৷ হাজারো মালা হাজারো ফুলে মুড়ে থাকা গাড়িটা এগিয়ে চলল৷ মুম্বইয়ের রাজপথ ধরে৷ সামনে তখন পুলিসের বাতি লাগানো গাড়ি৷ রাস্তা ফাঁকা করার বার্তা দিচ্ছে৷ কিছু নিরাপত্তা রক্ষী সঙ্গে হাঁটছেন৷ দূর থেকে লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ করছেন৷ ছেলে-মেয়ে, যুবক-যুবতী, তরুণ থেকে বয়স্ক- সবাই মিশে গিয়েছেন ভিড়ে৷ কেউ মোবাইলে ছবি তুলছেন, কেউ বা ক্যামেরায়৷ একটি বারের জন্য বন্দি করে রাখার আকুতি৷
আরও পড়ুন: Modi Uddhav: ভাঙল রাজনৈতিক বেড়াজাল, লতার বিদায়মঞ্চে পাশাপাশি মোদি-উদ্ধব
গাড়ি এগিয়ে চলল৷ শিবাজি পার্কের দিকে৷ নামলেন তিনি৷ আবারও কাঁধে চড়ে৷ শেষবারের জন্য শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী-সহ অন্যান্যরা৷ জানানো হল শ্রদ্ধা৷ তৈরি হওয়া চন্দন কাঠের বিছানায় শোয়ানো হল সুর সম্রাজ্ঞীকে৷ ক্রমেই যেন ভারী হয়ে এল বহুতল বেষ্টিত শিবাজি পার্কের আকাশ৷ বহুতলগুলো যেন নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে৷ সাত দশকের বেশি সময় এই বাড়িগুলোতেই কখনও না কখনও তিনি বিরাজ করেছেন৷ আজ সর্বত্র এক নীরবতা৷ সূর্য অস্ত গেল৷ আগুন জ্বলল৷ ঠিক যেমনটা বাগদেবীর বিসর্জনের দিন বিলীন হলেন সঙ্গীতের সরস্বতী৷
শিবাজি পার্কে তৈরি হওয়া প্যান্ডেলে হাসিমুখে জ্বলজ্বল করছে লতা মঙ্গেশকরের ছবিটা৷ যেন নিজের শেষ মুহূর্তটা নিজেই প্রত্যক্ষ করছেন৷
আর বলছেন, ‘মেরি আওয়াজ শুনো’…
চিতার আগুনে আমাকে পোড়াতে পারবে… গান কে পোড়াতে পারবে না…