যেমনটা রভিশ কুমার কিছুদিন আগে বলেছেন, এবং যেমনটা তাঁর বহু আগে আমাদের ঠাকুর, রবি ঠাকুর বলেছেন, শেঠকে পাস বহত পয়সা হ্যায়, তাই দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে মানানসই করার জন্য, বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে। শূলে চড়ানো, জেলে পাঠানো, মুণ্ডুটা ঘ্যাঁচ করে কেটে ফেলার চেয়ে অনেক আধুনিক পদ্ধতি হল বিরোধীদেরই কিনে নেওয়া, বিরোধিতা করছে এমন চ্যানেলকে কিনে নেওয়া। অতএব বাজারে থাকিবে কিছু ঢ্যাঁড়া পেটানোর দল, তারা দিন রাত্রি রাজার হয়ে ঢ্যাঁড়া পিটাইবে। শোনো শোনো শোনো রাজামশাই জাগেনি এখনও, জাগিলে পরে, মণ্ডামিঠাই পড়িবে ঝরে, তার আগে খানিক সবুর করো, না হলে খিদের জ্বালায় মরো। কিন্তু করো যদি রাজার বিরোধিতা, নিশ্চিত খসে যাবে মুণ্ডখানা, জেনো তা। দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো কিংবা বাকি কলতলার ঝগড়া হোক, তাতে আমোদগেঁড়ে মানুষজনেদের মনোরঞ্জনও হয়, কিন্তু সিরিয়াস বিরোধিতা, প্রভু সহ্য করেন না আর ভগবান তো সেই কবেই নিদ্রা গিয়েছেন। তো বিরোধিতা করলেই নেমে আসে রাজরোষ, আজ থেকে নয়, সেই কবে থেকেই, কিন্তু আপাতত গণতান্ত্রিক মহিমা জুড়ে গেছে সেই রাজরোষে। সে এখন আর হঠাৎ করে নেমে আসে না, ধাপে ধাপে নামে। বিরোধিতার প্রথম ধাপ হল এক অলিখিত কিন্তু পরিষ্কার বোধগম্য প্রেমপত্র, এক চিঠি, আনবে কে? কেন? তার জন্যই তো আছে ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স, এনআইএ। এঁরা আসবেন, চিঠি দেবেন। চিটঠি আয়ি হ্যায় আয়ি হ্যায় চিটঠি আয়ি হ্যায়। ওই চিঠিতেই লেখা থাকবে, সামলে যাও বাছা, শুধরে যাও, ওখানেই লেখা থাকবে,
বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না
ভর পেট নাও খাই, রাজকর দেওয়া চাই
যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান
জানার কোনও শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই
যে কয় পেটে খেলে পিঠে সয়, তার কথা ঠিক নয়
যে করে খনিতে শ্রম, যেন তারে ডরে যম
অনাহারে নাহি ক্ষেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ
ধন্য শ্রমিকের দান, হীরকের রাজা ভগবান
যদি সামলে গেলেন তো ভালো, না হলে জেল, হাজত, বেল মিলবে না, বেল মানে জামিন কিংবা সাজামুকুব তো গণধর্ষণে অভিযুক্তদের জন্য। বিরোধিতার সাজা তো স্ট্যান স্বামীর মতো জেলে পচে মরা। তো হয়েছে কী, কলকাতা টিভিটাকে ঠিক বশে আনা যাচ্ছে না, চিঠির পর চিঠি আসছে, যতবার বলতে বলছে, হীরকের রাজা ভগবান, ততবার আমরা বলছি দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান, এবং কী আশ্চর্য মানুষ শুনছে, আর শুনছে বলেই আবার প্রেমপত্র, আবার চিটঠি আয়ি হ্যায়, আয়ি হ্যায় চিটঠি আয়ি হ্যায়। তো গতকাল তেনারা আবার এসেছিলেন, মঙ্গলবার সাতসকালেই তেনারা হাজির, আমাদের চ্যানেল এডিটর কৌস্তুভ রায়ের বাড়িতে। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা মা, দিদা আছে। আছে তো আছে, ভয় পাওয়াতে হলে তো এভাবেই আসা উচিত। গৃহ পরিচারিকাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। গন্ডায় গন্ডায় একে ফর্টি সেভেনধারী কড়া জংলা পোশাক আর ভারী জুতো পরে হাজির জুজুর দল, সেরেফ ভয় দেখাতে, সো যা নহি তো গব্বর আয়ে গা, মান যা, নহি তো ইডি আয়েগা। যেন কোনও ভয়ঙ্কর অপরাধী, খুনি, টেররিস্টকে ধরতে এসেছে, এমন এক ভাব করে সারা পাড়া কাঁপিয়ে তেনারা সাতসকালে ঢুকলেন। চ্যানেল এডিটর হিসেবে সাংবাদিকদের যঙ্গে কথা বলা, যোগাযোগ রাখা একজন চ্যানেল এডিটরের অধিকার। অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি তো সেই কবেই গেছে গড়ের মাঠে ঘাস খেতে, ঘরের সব্বাইকে আটক রেখে আবার সেই পুরনো নাটক, আশি দিন আগেকার সেই নৌটঙ্কির পুনরাবৃত্তি। ইসকো লাও, উসকো বুলাও। যাঁদের ইচ্ছেয় এই হানাদারি তাদের মহলে চোখ চকচক, এবারে পোরা হবে জেলে, টাচ মি নট খোকাবাবু বলেছিলেন ২১ তারিখ ঘটবে, এটা বোধহয় তারই ট্রেলার। কী আনন্দ আকাশে বাতাশে, একদা বাম, ইদানীং রাম এক চ্যানেল কর্তা ২৮ বার ফোন করেছেন, গ্রেফতার হল, তাহলে হেডলাইন হবে, অধৈর্য হয়ে পড়ছেন তিনি, হেডলাইন গ্রাফিক্স সব রেডি, মমতা ঘনিষ্ট চ্যানেল সম্পাদক গ্রেফতার, তাঁর বাড়ি থেকে পাওয়া গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বেলা গড়াতেই বোঝা গেল, তাঁরা কেবল চিঠি দিতেই এসেছিলেন, এক কুঁচো কাগজ বা এক টাকারও হদিশ না পেয়ে কোনও সিজার ছাড়াই তেনারা ফিরবেন, তবুও নাটকের দৈর্ঘ্য বজায় রাখতেই কৌস্তুভ রায়কে নিয়ে যাওয়া হল রাজভবনের সামনে হেড অফিসে, সেখানেও হুমকি ধমকি দিয়ে বিফল মনোরথ ইডি অফিসারেরা ফিরলেন দিল্লি। হ্যাঁ ওনারা, ওনাদের সঙ্গে এই দেহরক্ষী, সিআরপিএফ জওয়ান সব্বাই এসেছিলেন দিল্লি থেকে উড়ে, মোদি–শাহ কিংবা আরএসএস-বিজেপির পয়সায় নয়, আমার আপনার ট্যাক্সের বেশ কিছুটা টাকা নষ্ট করে তেনারা ফিরে গেলেন নিজ নিকেতনে। এবং নষ্ট হল একজন ব্যবসায়ী, একজন চ্যানেল এডিটরের একটা গোটা কর্মদিবস, সারাটা দিন আতঙ্কে কাটালেন তিনজন বৃদ্ধ মানুষ, আপাতত রাষ্ট্রীয় ডালকুত্তাদের ভয়ে দিন কাটে মানুষের। কেন বলছি ভয় দেখানো? আসুন সেটাও আলোচনা করা যাক। ধরুন জরুরি অবস্থা, ৭৫ থেকে ৭৭, দু’ বছর সময় জুড়ে বিরোধী নেতাদের ধরপাকড় করা হয়েছিল, কোনও লুকোছুপি ছিল না, ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট বলেইছিলেন বিরোধীরা দেশকে দুর্বল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, অন্তর্ঘাত চালাচ্ছেন, তাই তাদেরকে জেলে পোরা হচ্ছে। কিন্তু হিসেব বলছে এমনকী অনেক, অনেক কংগ্রেসি নেতাও জেলে গেছেন, একটু বিরোধিতা করেছেন কি জেলে গেছেন। জরুরি অবস্থা শেষ হয়েছে, তাঁরা ছাড়া পেয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন, এমএলএ এমপি হয়েছেন। কিন্তু গত ৭-৮ বছর ধরে যা চলছে, তা এক অঘোষিত জরুরি অবস্থার চেয়েও বেশি কিছু। ইডি, সিবিআই, অন্যান্য ভিজিলেন্স সংস্থা রেড চালাচ্ছে, তার ৯৫ শতাংশই বিরোধী দলের, বিরোধী মতের। হিসেব আমার নয়, হিসেব সরকারের, তাঁরাই সংসদে এই হিসেব দিয়েছেন। এই ইডি, যারা মঙ্গলবার সাতসকালে কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে এল, তারা গত ২০১৪ থেকে ২০২২-এর মধ্যে রেড করেছে ৩০১০টা, চার্জশিট দিয়েছে ৮৮৮টা আর দোষী সাব্যস্ত হয়েছে ২৩ জন। ইউনিয়ন ফিনান্স মিনিস্টার অফ স্টেট, পঙ্কজ চৌধুরি, শিবসেনা এমপি প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীর প্রশ্নের উত্তরে রাজ্যসভায় এই খবর জানালেন। যদি পরীক্ষার হিসেবে ১০০তে নম্বর দেওয়া হত, তাহলে ইডি পেত একশোতে দশমিক ৭৬, পুরো একও নয়। স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হত, রাস্টিকেট করা হত। কিন্তু ওনাদের চাকরি বজায় আছে, ওনারা আমার আপনার ট্যাক্সের পয়সায় মাইনে পাচ্ছেন, কারণ এই রেড তো তাঁরা করছেন না, এই রেড করানো হচ্ছে মোদি–শাহের নির্দেশে, এই রেড বেআইনি টাকা উদ্ধারের জন্য করা হচ্ছে না, এই রেড চালানো হচ্ছে স্রেফ ভয় দেখাতে। গতকাল সেই ভয় দেখানোর নৌটঙ্কিই আমরা আবার দেখলাম, তাঁরা দেখে গেলেন, আমাদের, কলকাতা টিভির, চ্যানেল সম্পাদকের, চ্যানেল সাংবাদিকদের রিড় কি হাড্ডি, মেরুদণ্ড সুঠাম, সতেজ আর বিকাউ নয়, ফিরে গিয়ে সেই কথাই আপাতত জানাবেন তাঁদের প্রভুদের, টিকাউ কিন্তু বিকাউ নয় এমন মেরুদণ্ড কম আছে দেশে, কিন্তু আছে, এখনও আছে। এটা কেবল মোদি–শাহের উদ্দেশে বলা নয়, যে কোনও শাসকদের জন্যই বলে রাখা, প্রয়োজনে মানুষের স্বার্থে আমরা যে কারওর বিরোধিতা করতে পারি, চতুর্থ স্তম্ভের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে আমরা মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আসলে বিজেপির কংগ্রেসিকরণ শুরু হয়ে গেছে, সবটাই হাই কমান্ড, সবটাই মোদি শাহ। তো ওনারা ঠিক করেছেন, রাজনীতি নয়, ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স আর ভিজিল্যান্স দিয়েই শাসন চালাবেন, আরও বেশি সক্রিয় হলে এনআইএ আছে, ইউএপিএ আছে, আর্বান নকশাল বলে সোজা জেলে পুরে দাও। এই অঘোষিত জরুরি অবস্থার শাসনে অগাস্টের ১ তারিখ থেকেই যদি হিসেব নেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে মহারাষ্ট্রে জুলাইয়ের শেষ দিনে গ্রেফতার সঞ্জয় রাউত, রেড অব্যাহত মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায়, এরপর তৃণমূল মন্ত্রী নেতাদের বাড়িতে রেড চালানো হল, তারপর কলকাতা টিভি, তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের দফতর, যেদিন কলকাতা টিভির রেড উঠে গ্যালো, সেদিনই সকালবেলায় আম আদমি পার্টির মন্ত্রী, নেতা মণীশ সিসোদিয়ার বাড়ি, তারপর বুধবার তেজস্বী যাদব সমেত আরজেডি নেতাদের বাড়ি, একই সঙ্গে ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সোরেনের ঘনিষ্ঠ মানুষজনের বাড়িতে রেড চলল। কোনওটায় সামনে ইডি, কোনওটায় ইনকাম ট্যাক্স, কোনওটায় সিবিআই, পেছনে কিন্তু দুটি মানুষ মোদি–শাহ। উদ্দেশ্য কী? কালো টাকা উদ্ধার? ফাইট এইগেন্সট করাপশন? ঘণ্টা। বিএস ইয়েদুরিয়াপ্পার বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা বেআইনি রোজগারের অভিযোগ আছে, বেআইনিভাবে খনি ইজারা দেওয়ার অভিযোগ আছে। কেউ রেড করবে? হিমন্ত বিশ্বশর্মা সারদা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত, ইডি যাবে রেড করতে? শুভেন্দু অধিকারী, চোখের সামনে টাকা নিয়েছেন, ভিডিও আছে, সিবিআই যাবে জেরা করতে? এই খোঁজা সিবিআই, ইডি, আইটি আটকেছে গুজরাতের ওই নীরব মোদি, মেহুল চোকসি সমেত ৩৬ জন ব্যবসায়ীকে? যারা লক্ষ কোটি টাকা মেরে চলে গেছে বিদেশে? কেউ গেছে নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদির বাড়িতে রেড করতে, কারণ যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে এই ভদ্রলোক ওই নীরব মোদি বা মেহুল চোকসিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। যদি না যায়, তাহলে কেবল কৌস্তুভ রায়ের চ্যানেলের কর্মচারী বা সাংবাদিককে ডেকে এনে ৩০-৪০-৬০ ঘণ্টা আটকে রেখে জেরা করা হবে কেন? না খাউঙ্গা না খিলাউঙ্গার বাওয়ালি দেওয়ার পরে দেশের ১ লক্ষ ৮৮ হাজার কোটি টাকা নিয়ে পগার পার এই ব্যবসায়ীরা, তাহলে এদের কে খাওয়াল? তাকে একটা প্রশ্ন করার ধক আছে ওই ইডি কর্তাদের? আইটি কর্তাদের? নরম মাটি পেলেই আঁচড়াতে ইচ্ছে হয় তাই না? আমাদের দফতরে ইনকাম ট্যাক্স রেড যে টাকার হিসেব বা হদিশ পেতে হয়নি তা তো সবাই জানে, যেটা জানে না তা হল এই রেড চলাকালীন অমানবিক ব্যবহার, টর্চারের কথা। যা গতকালও হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের এই বিশ্বাসঘাতকদের গণতান্ত্রিক রীতি নীতি মেনে বাঁচিয়ে রাখাটাই কি তাহলে ভুল ছিল? গান্ধী হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল মাথা ওই সাভারকারকে সেদিন ফাঁসি দিলে আজ দেশকে এই দিন দেখতে হত না। গণতন্ত্রকে, সংবিধানকে ভেঙে মুচড়ে ফেলে এক সামরিক শাসনের আওতায় আনা হচ্ছে। আসলে এই ইডি, ইনকাম ট্যাক্স রেড ভয় দেখানোর এক ব্যবস্থা, কলকাতা টিভি, চতুর্থ স্তম্ভ অনুষ্ঠান বন্ধ করার প্রচ্ছন্ন হুমকি। আমরা তাকে আগেও রুখে দিতে পেরেছি, এবারেও তারা ফিরে গেছে, কিন্তু কতদিন পারা যাবে জানা নেই, কারণ প্রতি পদক্ষেপেই বুঝতে পেরেছি, তারা যে কোনও জিনিস, টাকা, দলিল, কাগজ এমনকী অস্ত্রশস্ত্রও রেখে দিতে পারেন, প্ল্যান্ট করতে পারেন, তারপর তার ছবি হুক্কাহুয়ার দলের কাছে পাঠিয়ে রাখতে পারে, যাদের শিরদাঁড়াই নেই অথচ দাবি করেন চোখে চোখ রেখে কথা বলার। তবুও আমরা লড়ছি, লড়ব, স্বাধীন দেশের সংবিধানের জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য, শেষ পর্যন্ত লড়ব। সঙ্গে থাকুন।