পুলিশ জানিয়েছিল সংবাদমাধ্যমকে, সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল আমাদের, আমরা জেনেছিলাম খুংখার কিছু মাওবাদী ধরা পড়েছে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জমানায়। কেউ ধরা পড়েছেন বাম জমানায়, কেউ ধরা পড়েছেন তৃণমূলের জমানায়। সরকার পালটে গেলেই তো পুলিশ পালটায় না, সিআইডি পালটায় না, সিস্টেমও বদলায় না, কাজেই গ্রেফতার হতেই থাকে। আমরা জেনেছিলাম নাকি দু’ হাতে গুলি ছুড়তে পারে, বোমা তৈরি করতে পারে এক যুবক, নাম মধুসূদন মণ্ডল, সে অস্ত্রশস্ত্র সমেত ধরা পড়েছে আমতলার কাছে বিষ্ণুপুর থেকে। আদালতে যখন আনা হয়েছিল তাঁকে, তিনি চিৎকার করে জানিয়েছিলেন, যেদিন বলা হচ্ছে তাঁর দু’দিন আগেই নাকি তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল হলদিয়ার মঞ্জুশ্রী থেকে। বলা হয়েছিল, তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেছে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র, পাওয়া গেছে মাওয়িস্ট লিটারেচার, আমরা সেই রোমহর্ষক কাহানি শুনেছি, আঁতকে আঁতকে উঠেছি, জঙ্গলে নয়, ঘরের উঠোনেই মাওবাদী। সে ২০১১-র ঘটনা, রাজ্যে তখন কমিউনিস্ট সরকার। একে একে আরও কয়েকজনের নাম এল, রাধেশ্যাম দাস, সিদ্ধার্থ মণ্ডল, সঞ্জয় মণ্ডল, এরাও নাকি বাঘা বাঘা মাওবাদী। শোনা গেল মাওরা নাকি কলকাতায় শক্তপোক্ত ডেরা বেঁধেছে, সংগঠন জমাট বাঁধার আগেই ভাণ্ডাফোড়, সাংঘাতিক কর্মঠ এবং বুদ্ধিমান পুলিশ অফিসারেরা ধরে ফেলেছে ষড়যন্ত্রকারীদের।
বামেরা গেল, এল তৃণমূল, পুলিশ বদলাল কি? না, নোনাডাঙা বস্তি উচ্ছেদের আন্দোলনের প্রকাশ্য জমায়েতে থেকে গ্রেফতার করা হল দেবলীনা চক্রবর্তীকে, সে নাকি মাতঙ্গিনী মহিলা সমিতির মাথা, গাঁয়ে গঞ্জে মহিলাদের বন্দুক চালানোর ট্রেনিং দেয়। গুচ্ছের মাওবাদী ধরা পড়ল, খোকা ঘুমোল, পাড়া জুড়োল। তাদের কারও কারও ঘর থেকে পাওয়া গেছে মাওয়িস্ট লিটারেচার। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ঘর থেকে বই পেলেই তাকে গ্রেফতার করতে হবে, এর চেয়ে হাস্যকর আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আরও হাস্যকর পুলিশের দল এসব লোক হাসানো কাজ আজ থেকে নয়, ব্রিটিশ জমানা থেকে করে আসছে, ঘরে শরৎচন্দের লেখা ‘পথের দাবী’ পেলেও গ্রেফতার করা হত। বন্দেমাতরম পত্রিকা পেলে তো ফাঁসিতে ঝোলানোর কথা বলত সরকারি উকিলেরা। তো আজকের পুলিশ তো ওই তাদেরই উত্তরাধিকারী, তারা একই কাজ করে চলেছে। খোকা ঘুমনোর এতদিন পরে গতকাল মানে মঙ্গলবার জানা গেল, এই কোট আনকোট খুংখার মাওবাদীরা কেউই মাওবাদী নন, এঁদের কাছ থেকে কোনও রাইফেল, রিভালবার পাওয়া যায়নি। এঁরা কোথাও বোমা মেরেছেন, মানুষ খুন করেছেন, তেমন প্রমাণ নেই। বিচারক বললেন এনাদের বেকসুর খালাস দেওয়া হচ্ছে। এঁদের অনেকেই ৪-৫-৮-১০ বছর জেলে খেটেছেন, বেলে বাইরে থাকার সময় পাড়ার লোকে আঙুল তুলেছে, ওই যায় মাওবাদী, চাকরি গেছে, চাকরি জোটেনি, পড়াশুনো নষ্ট হয়েছে, জেলে থাকতে থাকতে শরীরে বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন অসুখ। গতকাল তাঁদের জানানো হল ভাইসকল আপনারা নির্দোষ। মজার কথা হল এদিনেই মানে ওই মঙ্গলবারেই আরেকটা রায় এসেছে, সেও মজাদার রায়।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: ভিন্দ্রানওয়ালার ভূতকে আবার জাগানো হচ্ছে
জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনার কথা আমরা সবাই জানি, অভিযোগের তির ছিল মাওবাদীদের দিকে, আর সে জমানায় আদিবাসী মানেই তো মাওবাদী, ব্যস। টপাটপ আদিবাসী ধরো, জেলে ভরো। আর এ তো কোটি টাকার মালিক পার্থ, সুবীরেশ বা মানিক নয় যে দশটা উকিল মাঠে নেমে পড়বে, গ্রেফতার হয়েছে তাই জানতেই দিনদশেক, তারপর গরু বেচে, হাল বেচে, জমি বেচে উকিলবাবু ধরো। অনেকের পক্ষে তাও সম্ভব হয়নি, জেলেই পচেছে, বিনা বিচারে, না হয়েছে চার্জশিট, না এসেছে প্রমাণ, জেলেই কাটাচ্ছিল টুডু, মাহাতো, মুন্ডাদের দল। এখানে আবার যে সে পুলিশ নয়, খোদ সিবিআই, যারা নাকি সব জানে, যারা নাকি সব মিথ্যে বের করে আনতে পারে। তাদের অভিযোগেই কেউ ১০ কেউ ১১ বছর জেলে ছিল, গতকাল বিচারক বললেন, এতবছর ধরে সামান্যতম প্রমাণও জোগাড় করা যায়নি, এদেরকে তাহলে জেলে রাখা হবে কেন? ১১ জনের জামিনের আদেশ দিয়েছেন বিচারক। আমি কম বেশি নিশ্চিত, এনারা বেকসুর খালাস পাবেন আরও কিছুদিন পরে। কোন বিচারের ওপর মানুষ ভরসা রাখবে? কেনই বা রাখবে? এ গেল বিচারের এক ধরন যেখানে বিচারের নামে প্রহসন আজ থেকে নয় আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে। অন্য আরেক বিচারের ধারাবাহিক নৌটঙ্কি আমরা দেখেই যাচ্ছি। যা এর আগে দেখা যায়নি।
বিচারপতিরা খুব কম কথা বলতেন, রায় দিতেন, সে সব গুরুত্বপূর্ণ রায়, পরবর্তী ক্ষেত্রে হয়ে থাকত এক নির্দেশিকা। রায়ের কপি পড়ে বোঝা যেত তাঁদের প্রজ্ঞা, তাঁদের জ্ঞান। অবরে সবরে তাঁদের দেখা যেত কিছু সেমিনারে, কিছু আলোচনায় যেখানে তাঁরা তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দিতেন। এখন খেলাটা এক্কেবারে আলাদা। এটা খুব সাম্প্রতিক ব্যাপার। বিচারপতিরা পাড়ার মোড়ের বল্টে দা, পিকলুদা, চণ্ডীমণ্ডপের আসরে বসে থাকা নব মোড়ল, কার্তিক জানাদের মতো মন্তব্য করছেন, গ্যালারি গরম করা সে সব মন্তব্য তারপরের দিনেই খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী পাড়ার মোড়ের ছেনোদার মতো হাততালি দিয়ে ডায়ালগ বলছেন, সরকারের পক্ষে রায় দেওয়া বিচারক রিটায়ার করার মাসখানেকের মধ্যে নয়া দায়িত্ব পাচ্ছেন, রাজ্যসভার সাংসদ মনোনীত হচ্ছেন, সে দেশের লোয়ার কোর্টের বিচারপতিরা আলপটকা মন্তব্য করবেন এটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কার সম্পর্কে বলছেন? একজন মেয়র, একজন মুখ্যমন্ত্রী, একজন মন্ত্রী, যাঁরা মানুষের ভোটে নির্বাচিত, লক্ষ লক্ষ মানুষের সমর্থন নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদেরকে অনায়াসে অপমান করছেন, অসন্মানসূচক কথা বলছেন, কেন? যে বিচারব্যবস্থায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন হেনস্তার শিকার, হাজার হাজার মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না, হাজার হাজার মানুষ বিনা বিচারে জেলে পচে মরছেন, সেই বিচার ব্যবস্থায় একজন বিচারকের এই হঠাৎ গ্যালারি গরম করার কারণটা কী? পেছনের কারণটাই বা কী? হঠাৎ জুডিসিয়ারি থেকে করা মন্তব্যে ভেসে যাচ্ছে খবরের কাগজ, সংবাদমাধ্যম। আজ বিচারক নাম না করে বললেন, আসল মাথাকে ঘাড় ধরে টেনে আনব, কাল বললেন পনির মসালায় পনির নেই পরশু কার লন্ডনে বাড়ি আছে, আবার পরের দিন শহরের মহানাগরিকের জন্য চোখা চোখা শব্দ। এগুলো বিচারের কোন অঙ্গ?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: বিরোধী ঐক্য এক মরীচিকা
বর্ষীয়ান আইনজীবী অরুণাভ ঘোষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিচারকরা এত মন্তব্য করছেন কেন? তিনি বললেন, “নিজেদের বিচার বুদ্ধির ওপর যথেষ্ট ভরসা নেই বলে, বিচারকরা রায় দিতে পারেন, বিচারের বাইরে এরকম মন্তব্য করেন না কারণ এ ধরনের বক্তব্যের পালটা বক্তব্য এলে তাঁর কিছু করার থাকে না। এ মন্তব্য কাম্য নয়।” চলে যান জাজেস কোর্ট, চলে যান আলিপুর ক্রিমিনাল কোর্ট, চলে যান যে কোনও জেলা কোর্টে, দেখবেন অসহায় মানুষজনের লম্বা লাইন, হতাশ মুখ, ভয়, অপমান তাদের শরীর জুড়ে, ৬০-৭০ কিলোমিটার দূর থেকে এসে শুনেছেন আজ জাজ সাহেব নেই, বিচারের বদলে একটা তারিখ নিয়ে ফিরেছেন। স্কুলের হেড মাস্টার ধর্ষণের অভিযোগে ১৮ বছর জেলে থাকার পরে নিরপরাধ ঘোষিত হয়ে ঘরে ফিরছেন, কাঁদছেন, ছেলেমেয়ে ছেড়ে কবেই চলে গেছে, স্ত্রী মারা গেছে সেই কবে, আর কটা দিনই বা বাঁচবেন, জেলেই কাটাতে পারলে ভালো হত। শুনেছি এমন কথাও। ১৪০০ টাকার টেবিল ফ্যান চুরির দায়ে জেলেই কেটে গেছে ৮ বছর, এখনও নাকি বিচার চলছে, এ কাহিনিও শুনেছি। প্রতি মুহূর্তে এইসব মানুষদের দেখলে মনে হয় এঁরাও তো সংবিধানের সেই উই দ্য পিপল, ছেলে জেলে আছে তিন বছর, বৃদ্ধ বাবা-মা আদালতে এসেছেন, ছেলের জন্মদিন, একবার দেখতে। উকিলকে টাকা দেবার সামর্থ্য নেই, কাঠগড়ার পেছনে জালের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছেলে তাদের। সেই বিচার ব্যবস্থার কিছু মানুষ যখন গ্যালারি গরম করতে মাঠে নামেন, তখন বোঝাই যায়, সময় এসেছে বিচার ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন করার, সেখানেও ঘুণপোকা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ৩০-৪০-৫০ বছর আগেও মানুষ বলতেন বিচার চাইতে আদালতে যাব, এখন একান্ত নিরুপায় না হলে বিচার চাইতে কেউ আদালতে যায় না। আর বিচার ব্যবস্থার এই বিচ্ছিন্নতা যত বাড়বে, মানুষের বিচার নিজের হাতে নেবার প্রবণতাও ততটাই বাড়বে, এটা স্বাভাবিক নিয়ম। আমরা কি তাহলে ক্রমশ সেই অরাজকতার দিকে চলেছি? মাত্র গতকাল মামলা থেকে খালাস পাওয়া মধুসূদন থেকে দেবলীনার ৪-৫-৭-৮ বছর চলে গেছে জেলের চার দেওয়ালের ভেতরে, আজ যদি তারা তাদের হারিয়ে যাওয়া, উবে যাওয়া বছরগুলো তারা ফেরত চায়? সেই বাচাল বিচারক কী উত্তর দেবেন? একবারও কি বলবেন, সামান্য হলেও তিনিও দায়ী? হুজুর, একবার সেই কথাটা আপনার মুখ থেকে শুনতে চায়, মধুসূদন, সিদ্ধার্থ, সঞ্জয়, দেবলীনারা। হুজুরের কানে গেছে কথাটা?