নরেন্দ্র মোদি গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশে ভোট প্রচারের শুরুয়াতে, প্রোগ্রামের নামটিও জব্বর, মেরা বুথ মজবুত। কিন্তু যেভাবে মধ্যপ্রদেশে ধড়াধড় উইকেট পড়ে যাচ্ছে তাতে বুথ মজবুত রাখা তো দূরস্থান, বিধানসভাই হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে। তো সেই মধ্যপ্রদেশে এই মেরা বুথ মজবুতের অনুষ্ঠান দেখা ছিল সারা দেশেই কারিয়াকর্তাদের কাছে বাধ্যতামূলক। এমন বাধ্যতামূলক অনুষ্ঠান বিজেপিতে অনেক হয়, কাজেই যে যেখানে ছিলেন সেখানেই ওই মেরা বুথ মজবুতের ক্লাসে হাজিরা দিয়েছিলেন। শোনা গেছে এ রাজ্যের সুকান্ত, শুভেন্দুও এই ক্লাসে হাজিরা দিয়েছেন। মোদিজি ম্যাজিক জানেন, গুরুদেব লোক, নিশ্চয়ই কিছু না কিছু তো টোটকা দেবেন যা দিয়ে বুথ মজবুত করা যাবে এবং একবার বুথ মজবুত হলেই কেল্লা ফতে, শুভেন্দুর চোখের সামনে ঝুলছিল মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি। দোষ নেবেন না, কুঁজোরও মাঝে মধ্যে চিৎ হয়ে শোওয়ার ইচ্ছে তো করেই। কিন্তু মাস্টারমশাই হঠাৎই সিলেবাসের বাইরে, তিনি পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়েছেন, সারদা দুর্নীতিতে ঢুকে পড়লেন, আমাদের খোকাবাবুর তো মাথা টনটন, বুক ধকধক, অভ্যেসবশত যদি সাহেব নারদায় ঢুকে পড়েন? তাহলে এই নির্বাচনের বাজারে বুথে কেন পাড়ায় পাড়ায় ধস নামবে। তো মোদিজি কি এত কাচ্চা খিলাড়ি? তিনি নারদা কাটিয়ে গরু, শিক্ষা আর কয়লাতে ঢুকে পড়লেন, আমাদের কাঁথির খোকাবাবু প্রাণে ধড় বা ধড়ে প্রাণ খুঁজে পেলেন। তো যাই হোক এই আমার বুথ মজবুত ইত্যাদি বলার পরে বিজেপি দফতরে বুথের হিসেব নিয়ে বসে পড়েছেন লোকজন, কিন্তু হিসেব মিলছে না, সেটাই বিষয় আজকে, বিজেপির বুথ মজবুত?
আসলে এ রাজ্যে বিজেপির উত্থান তৃণমূলের কিছু দলত্যাগীদের নিয়ে, এবং সেই উত্থানের আরেক কারণ ছিল মোদি হাইপ, সঙ্গে কড়া ডোজের হিন্দুত্ব এবং ২০১৯-এর পুলওয়ামা ঘটনার পরে দেশজোড়া দেশপ্রেমের জোরালো হাওয়া। বামপন্থীদের দেখুন, সেই কবে ভুল হোক আর ঠিক হোক, পাড়ায় পাড়ায় মিছিল ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, তারপরে তেভাগার আন্দোলন, মাস্টারমশাইদের আন্দোলন, বাসভাড়া ট্রামভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, প্রতিটা পাড়ায় প্রতিটা মহল্লায় বামেদের সংগঠন আছে, সেই তথাকথিত বাম জমানা চলে যেতে ভয় পেয়ে কিছু লোক বসে গেছেন। কিছু লোক বিজেপিতে আশ্রয় নিয়েছেন কিন্তু তাঁরা গ্রামে আছেন, বামেদের হাল একটু ফিরলেই তাঁরা ফিরবেন, ফিরছেন, হাল ধরবেন, ধরছেন। তৃণমূলেরও তাই, কংগ্রেসের সমস্ত সংগঠনটাই তাদের দখলে, তার ওপরে এখন আইপ্যাকের ছোঁওয়া, অনেক বেশি গোছানো। কিন্তু বিজেপির? রামমোহন ডিরোজিও বিদ্যাসাগর রবিঠাকুর নজরুলের বাংলায় তাদের আদর্শের ভিত্তিভূমি কখনওই গড়ে ওঠেনি। শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে ফজলুল হকের সঙ্গে মিলিজুলি সরকার হয়েছিল, কিন্তু তার শিকড় মাটিতে প্রবেশের আগেই তা শুকিয়ে গেছে। আমাদের বাংলায় তীব্র হিন্দু আবেগ তৈরি করা ভারি শক্ত, ওধারে রামমোহন বিদ্যাসাগর রবিঠাকুর তো এধারে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ। রামকৃষ্ণ বলছেন যত মত তত পথ, গর্বিত হিন্দু বিবেকানন্দ ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছেন। গোপাল পাঁঠার সাঙ্গপাঙ্গদের সাহসে কুলোয়নি রামকৃষ্ণ বা বিবেকানন্দের নাম নিয়ে হিন্দু দাঙ্গা শুরু করার। ওদিকে আবার চৈতন্য, কিংবা হরিচাঁদ কালাচাঁদ, সে তো ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ানো।
কাজেই আদর্শগতভাবে বিজেপি এখানে জমি পায়নি সেই জনসঙ্ঘের দিন থেকেই। হিন্দু মহাসভার এন সি চ্যাটার্জির ঘর থেকে উঠে এসেছেন কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তীতে তপন শিকদার বা রাহুল সিনহার যেটুকু বাড়বাড়ন্ত তাও ওই মমতার সমর্থন পেয়ে। কাজেই না, বিজেপি কখনওই পাড়ায় পাড়ায় মহল্লা মহল্লায় তাদের বাসা বাঁধতে পারেনি, এখানে আরএসএস-এর বহু শাখা ইত্যাদিও আদতে এক মিথ, তার বেশিরভাগটাই ফোলানো ফাঁপানো। যার ফলে বিজেপির বুথ মজবুত হওয়ার কোনও ঐতিহাসিক উপাদান এই বাংলায় ছিল না। ২০১৯-এর বাড়বাড়ন্ত এবং তাকে ধরেই ২০২১-এর ৭৭ ইত্যাদি আসলে খানিক হাওয়া, খানিক প্রচার, খানিক বামেদের পিছু হটা আর খানিক তৃণমূলের সমর্থনের ফলাফল। কিন্তু আজ যখন তিন দল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তখন বিজেপিকে অসহায় দেখাচ্ছে, তাদের নেতারা সেই ফাইনাল পরীক্ষার আগে পরীক্ষা বাতিলের স্বপ্ন দেখা ফেল্টুস ছাত্র, যাদের স্বপ্ন কোনওদিনও পূরণ হয় না। তাঁরা এখনও স্বপ্ন দেখেন হাইকোর্ট বা রাজভবনের নির্দেশে নির্বাচন বাতিল হয়ে যাবে। বিজেপির রাজ্য নেতারা যেটা বুঝতেই পারছেন না তা হল, বুথ ভিত্তিক মজবুত সংগঠন না গড়ে তুলতে পারলে বার বার হারতে হবে, কারণ এ রাজ্যে বিজেপির নিজের ভোট কিন্তু ওই ১১-১২ শতাংশ থেকে বেড়েছে, কিন্তু তা কখনওই ১৬-১৭ শতাংশ ছাড়ায়নি। আর বাংলার মতো রাজ্যে যেখানে ৮০-৮২ শতাংশ ভোট পড়ে সেখানে ওই ১৭ শতাংশ ভোট নিয়ে আর যাই হোক জেতা যায় না। আমরা মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তৃণমূল, বাম আর বিজেপি এই তিন দলকে সংগঠনের ভিত্তিতে, মজবুত বুথের ভিত্তিতে এক, দুই, তিনের মধ্যে কোথায় রাখবেন? শুনুন মানুষ কী বলেছেন।
শোনা যাচ্ছে আগামী লোকসভার নির্বাচনে বিজেপি গতবারে হেরে গেছে এমন ১৪০টা আসনে এবার জেতার জন্য একটা তালিকা বানিয়ে দলের কিছু নেতাদের উপরে সেই আসনগুলোতে জেতার দায়িত্ব দিয়েছে এবং সেই ১৪০টা আসনের একটাও নাকি এ রাজ্যে নেই। আপাতত এ রাজ্যে বিজেপি গতবারে যে ১৮টা আসন জিতেছিল সেগুলো জিততে পারলেই অনেক হবে বলে মনে করছে, পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল হাতে এলে এ নিয়ে পাকা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু ওই আমার বুথ মজবুত করার সময় সম্ভবত পার হয়ে গেছে। প্রচুর উৎসাহী মানুষজন জড়ো হয়েছিলেন দলের পাশে, টালিগঞ্জের সেসব সেলিব্রিটিরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, রূপা গাঙ্গুলি মন দিয়ে সিরিয়াল করছেন, লেখক কবি নাট্যকার জোটেইনি বললেও ভালো হয়, এবং বিজেপির বুথ এ রাজ্যে বেশ নড়বড়ে হয়েই রয়ে গেছে। আমার বুথ মজবুত এখনও নিছক কথার কথা।