দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপি নেতা, বিজেপি মুখপত্র এবং মিডিয়া প্রচার দেখলে মনে হয় যেন দেশে বিজেপি ছাড়া আর আছেটা কী? খানিকটা মুন্ডু ছাড়া খাবটা কী-র মতোই। বিজেপিকে হারানো যাবে না, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, অব কি বার ফির মোদি সরকার। সুলভ শৌচালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট মোদিজির সহাস্য মুখ আর বিকাশের বিজ্ঞাপন। খবরের কাগজ থেকে টিভি চ্যানেল, বিজেপিকে হারানোর জন্য বিরোধীদের জোট হবে কি হবে না, যদি হয়, তাতেও কী? মোদিজির তুলনায় আরেকটা চেহরা কোথায়? তারপর বিজেপির নির্বাচনী প্রচার আর মেশিনারি নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ মিথ। যার বটমলাইন হল ভারতবর্ষে এই মুহূর্তে বিজেপির কোনও বিকল্পই নাকি নেই। তাহলে আসুন এই মিথ নিয়েই কিছু তথ্য আপনাদের সামনে রাখা যাক, তারপর আলোচনা করা যাক যে দেশে বিজেপির শক্তি কতটা? বিজেপি কি বাড়ছে? না কি কমছে? এবং এই আলোচনার সূত্রপাত অবশ্যই ১৯৮৪-র বিজেপি থেকে, যখন সংসদে বিজেপির দু’ জন সাংসদ। না, অনেকেই ভাবছেন লালকৃষ্ণ আদবানি আর অটলবিহারী বাজপেয়ীর কথা কিন্তু লালকৃষ্ণ আদবানি ১৯৮৪তে রাজ্যসভা সদস্য, লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়াননি আর অটলবিহারী বাজপেয়ী গোয়ালিয়র থেকে দাড়িয়েছিলেন কিন্তু মাধব রাও সিন্ধিয়ার কাছে হেরেছিলেন বললেও ভুল হবে হেরে ভূত হয়েছিলেন। কারণ সেবার মাধব রাও সিন্ধিয়া ৬৬ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিলেন, বাজপেয়ীজি পেয়েছিলেন ২৮ শতাংশ ভোট। তাহলে ওই দু’জন কারা? একজন অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গা রেড্ডি, গতবছর মারা গিয়েছেন। অন্যজন গুজরাতের মেহসানা থেকে জিতেছিলেন অমৃতলাল কালীদাস প্যাটেল, এখন ৯১ বছর বয়স।
১৯৮৪তে বিজেপি ভোট পেয়েছিল ৭.৪ শতাংশ। এরপর ১৯৮৯তে ৮৫টা আসন। এরপর সেই বিখ্যাত রামরথ যাত্রা, দাঙ্গা এবং ১৯৯১-এ বিজেপি ১২০র ২০.১ শতাংশ ভোট। ১৯৯৬তেই বিজেপি সংসদে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল, ১৬১টা আসন নিয়ে সরকার বানানোর চেষ্টা এবং ১৩ দিনের সরকারের পতন। এরপর ১৯৯৮, এনডিএ তৈরি হল বিজেপির ১৮২ জন নিয়েই সরকার চলল ১৩ মাস। আবার নির্বাচন ১৯৯৯, এবারেও বিজেপি সেই ১৮২ কিন্তু এবারে শরিক অনেক, এনডিএ-র হাতে ২৭০, অতএব এনডিএ-র সরকার, অটলবিহারীর সরকার। পাঁচ বছর চলল কিন্তু পাঁচ বছর পরে ২০০৪-এ নির্বাচনে হেরে গেল। বিজেপি পেল ১৩৮টা আসন আর ২২ শতাংশ ভোট, ওদিকে মাত্র ১৪৫টা আসন আর ২৬ শতাংশ ভোট নিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার, বামেদের সমর্থনে। এরপর ২০০৯, বিজেপি পেল ১১৬টা আসন, ভোট কমে দাঁড়াল ১৮.৮ শতাংশে। কংগ্রেস ২০৬, ইউপিএ আবার ক্ষমতায় এল। এই পর্যন্ত যে অগ্রগতি তা দুটো কথা পরিষ্কার করে দেয়। এক বিজেপির হিন্দুত্ব, রাম জন্মভূমি, বাবরি মসজিদ ইত্যাদি তাকে বেশ কিছুটা এগিয়েছিল বটে কিন্তু তা সরকার করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। অতএব বিজেপিকে ফার্নান্ডেজ ইত্যাদির মতো সোশ্যালিস্টদের সাহায্য নিয়ে বিকাশ, উন্নয়ন ইত্যদির কথা বলেই ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। ক্ষমতায় আসার পরে একটা কথাও রাম মন্দির, ৩৭০ ধারা, গো-হত্যা, তালাক ইত্যদি নিয়ে বলেননি, বরং পাঁচ বছরের রাজত্বের পরে ইন্ডিয়া শাইনিং স্লোগান নিয়ে নির্বাচনে নেমেছিল, হেরেছিল। এবং কংগ্রেসের চরম অপদার্থতা, দেশজুড়ে আন্না হাজারের আন্দোলন, কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভূরি ভূরি অভিযোগ, বামেদের বিজেপির শক্তিকে বুঝে উঠতে না পারা, এইরকম মূল কিছু কারণেই ২০১৪তে নরেন্দ্র মোদি উঠে আসছেন। গুজরাতে নাকি বিরাট উন্নয়ন হয়েছে, কালা ধন ওয়াপস লায়েঙ্গে, দো কড়োর নৌকরি, না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা ইত্যাদি আমাদের মনে আছে, তারসঙ্গেই গুজরাতের হিন্দু হৃদয় সম্রাট, মিয়া মুশররফকে বক্তৃতায় এনে ফেলছেন, সব মিলিয়ে এক জোরালো ককটেল, কিন্তু সে ককটেলে হিন্দুত্ব কম আর জঙ্গি জাতীয়তাবাদ আরও কম। মূল ইস্যু দুর্নীতি, নারী সুরক্ষা, লোকপাল বিল, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ফান্দে পড়িয়া বিজেপি কান্দে
এরপরেই ২০১৭তে উত্তরপ্রদেশে আরও জঙ্গি হিন্দুত্বের মুখ যোগী আদিত্যনাথের সরকার, বিজেপির ক্লিন সুইপ। বিজেপি লড়েছিল ৪০৩টে আসনের মধ্যে ৩৮৪টাতে, জিতেছিল একাই ৩১২টা আসন। সে ধাক্কা বিরোধীদের শুইয়ে দিয়েছিল। দেশেও বাড়ছে বিজেপি, রাজ্যেও বাড়ছে বিজেপি। কিন্তু প্রথমে ডিমনিটাইজেশন, তারপরে জিএসটি দেশের অর্থনীতিকে এক বিরাট বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়, বেকারত্ব আর মূল্যবৃদ্ধি চরমে ওঠে। কিন্তু ওই ২০১৮তে দেশের ৭১ শতাংশ ভূমিতে সরকার চালাচ্ছে বিজেপি। উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, কর্নাটক, অসম, ত্রিপুরা সব জায়গাতেই বিজেপি বা শরিক দলের সাহায্যে বিজেপি সরকার চালাচ্ছে। কিন্তু এই সময় থেকেই ক্ষয় শুরু হল, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে হেরে গেল বিজেপি। এরই মধ্যে এল ২০১৯, সমীক্ষা বলছে বিজেপি ২২০-২৩০ এর বেশি পাবে না। এরই মধ্যে পুলওয়ামার ঘটনা, ৪০ জন সেনার মৃত্যু, হতেই পারত এক চূড়ান্ত সরকারি ব্যর্থতার উদাহরণ। কিন্তু সেটাই বিজেপি, মোদি–শাহ নিয়ে গেলেন নিজেদের দিকে। ঘর মে ঘুসকর মারেঙ্গে, সার্জিকাল স্ট্রাইক, দেশজুড়ে শহীদ সেনাদের নিয়ে আবেগ, ২০১৯-এর নির্বাচনকে বিজেপির দিকে নিয়ে গেল। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ে হেরে যাওয়ার ছ’ মাসের মধ্যে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ক্লিন সুইপ করল। পলিটিকাল অ্যানালিস্টরা নতুন তত্ত্ব এনে হজির করল, রাজ্যের ভোট আলাদা, মোদিজির প্রধানমন্ত্রিত্বের ভোট আলাদা। অথচ সেদিন ওই পুলওয়ামার ঘটনা না ঘটলে বিজেপি সরকারই তৈরি করতে পারত না। সেই বিজেপি ৩০৩ পেল, স্লোগান উঠল, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।
এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনে জিতেছে মোদিজি? আরএসএস–বিজেপি? না, বরং আজ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য জয় আবার উত্তরপ্রদেশ, আবার গুজরাত এবং অসম। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশে যোগীর আসন ৫৭টা কমেছে, সমাজবাদী দলের আসন ৬৪টা বেড়েছে, অখিলেশের ভোট বেড়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি, যোগীজির ভোট কমেনি, দেড় শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশে এক মেরুকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে, আপাতত সেখানে লড়াই বিজেপি আর সমাজবাদী দলের। অসমেও কি বিরাট জয়? না, বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ ৭৫ আর কংগ্রেসের নেতৃত্বে মহাজোট ৫০টা আসন পেয়েছে। এবং ওই ২০১৯ থেকে বিজেপি দিল্লিতে হেরেছে, বাংলায় হেরেছে, হিমাচলপ্রদেশে হেরেছে। ঠিক এই মুহূর্তে বিজেপির অবস্থা কেমন? দল ভেঙে সরকার চালাচ্ছে দুটো বড় রাজ্যে, মহারাষ্ট্রে আর মধ্যপ্রদেশে যেখানে ভোট হলেই তারা হারবে। তারা এককভাবে ক্ষমতায় আছে মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, অসম, গোয়া, নাগাল্যান্ড আর মণিপুরে। শরিকদের সাহায্যে ক্ষমতায় আছে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, মেঘালয়ে। বিরোধীদের হাতে আছে বাংলা, বিহার, ওড়িশা, মিজোরাম, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, কেরল, হিমাচলপ্রদেশ, দিল্লি, পঞ্জাব। ৭১ শতাংশ ভূমিতে সরকার চালাত যারা তাদের সরকার চলছে দেশের ৪৩ শতাংশ ভূমিতে আর সেখানে থাকেন দেশের ৪৪ শতাংশ মানুষ। সামনে চার রাজ্যের ভোট, যাবতীয় সম্ভাবনা আর সমীক্ষা বলছে ৪টের ৪টেতেই হারবে বিজেপি, তেলঙ্গানাতে তিন নম্বর জায়গায় থাকবে তারা। এই মুহূর্তে মহারাষ্ট্রের নির্বাচন হলেও তারা সেখানে হারবে। সেই অর্থে তাদের হাতে ২০২৪-এর নির্বাচনের সময় থাকবে গুজরাত, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, অসম, গোয়া, নাগাল্যান্ড আর মণিপুর, মেঘালয়।
বাকি রাজ্যগুলোতে হারের কারণ কী? এইসব রাজ্যের মানুষ বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন না কেন? এই জন্যে যে যাঁরা বিজেপি বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী আছেন তাঁরা উন্নয়নের গঙ্গা বইয়ে দিচ্ছেন, বিকাশের সাত ঘোড়ার রথ চলছে সেখানে? না। মানুষ বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, উগ্র হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে যে দলকে বিজেপির বিরুদ্ধে শক্তিশালী মনে করেছে, তাদেরকে ভোট দিয়েছে, সেটা কর্নাটকে কংগ্রেস, কেরলে সিপিএম, বাংলায় তৃণমূল বা পঞ্জাবে আপ। কাজেই দেশজুড়ে বিজেপি এক বিরাট বিপর্যয়ের মুখে হাবুডুবু খাচ্ছে, দিশাহীন। ধরুন না এই বাংলায় সংগঠন গড়ে তুলতে হবে, ১০০০টা সভা চাই, এ বাংলায় বিজেপির তিন মুখকে সেসব সভা ভাগ করে দেওয়া হল, অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা প্রমুখ নাকি মাসে দু’বার তিন বার করে আসবেন। যেই পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণা হল, সেই মুহূর্তে সব নাকি নাকচ, এখন রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোট সামলানোর দায় রাজ্য নেতৃত্বের। কেবল বাংলায়? মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহান আর জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া গোষ্ঠীর আকচাকচিতেই নাকি কমলনাথ বেরিয়ে যাবে, বলছে বিজেপির লোকজন। রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে পাকা ঘুঁটি কেচিয়ে দেওয়ার সব আয়োজন করেই রেখেছেন আবার তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী মুখ করা হলে সতীশ পুনিয়া বা সি পি জোশি একই কাজ নিপুণভাবেই করে দেখাবেন। বিজেপি এই মুহূর্তে এক পেপার টাইগার, কাগুজে বাঘ, যাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের, নিত্য নতুন মিথ তৈরি করে চলেছেন ওনারা, কিন্তু সে সব মিথকে উড়িয়ে দিয়েই বিজেপি এগিয়ে যচ্ছে তার ডেসটিনির দিকে। তার আদত হিন্দুত্ব আর জঙ্গি জাতীয়তাবাদের ভোট ২৫-২৬ শতাংশ, সেটাই তার ডেসটিনি। আর একবার ওই ২৫-২৬ শতাংশে পৌঁছলে সেখান থেকে নির্মম পতন বিজেপির জন্য অপেক্ষা করে আছে। কারণ যে আদর্শ আর নিষ্ঠা নিয়ে ২ থেকে ৮৫ তে গিয়েছিল বিজেপি, সেই আদর্শ, ত্যাগ, নিষ্ঠা ইত্যাদির সবটাই আজ বুদবুদের মতো উড়ে গেছে। আরএসএস থেকে বিজেপি সামলানোর দায়িত্বে থাকা বি এল সন্তোষের নামেও উঠছে কর্নাটকে দলের টিকিট বিতরণের দুর্নীতির অভিযোগ, অন্য পরে কা কথা। বিজেপি কমছে, কত তাড়াতাড়ি কমবে, তা নিয়ে বরং আলোচনা হতেই পারে।