১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি। সেদিন পাকিস্তানের (Pakistan) তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে এক ভাষণে ঘোষণা করেন, উর্দুই (Urdu) পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা (State Language) হবে। যার অর্থ হল, বাংলাভাষী পূর্ব পাকিস্তানেরও সরকারি ভাষা হবে উর্দু।
খাজা নাজিমুদ্দিনের এ বক্তব্যের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (University of Dhaka), ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ঢাকার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট ডাকা হয় এবং সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের একটি প্রতিবাদসভা হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান (East Pakistan) মুসলিম ছাত্র লিগের খালেক নওয়াজ খান। মিছিলের শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।
যুব লিগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি পালিত হল। মিছিলবিরোধী পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লিগের সদস্যরা যাতে কোনও সুযোগ না পায়, তার জন্য যুব লিগ ও প্রগতিশীল ছাত্ররা বেশ তৎপর ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যখন শুরু হল, তখন দাবি ছিল, উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তস্নাত পরিণতির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃত হয়েছে বটে, তবে সেই পরাধীন পাকিস্তান থেকে এখনও পৃথিবীর কোনও কোনায় বাংলা ভাষার অবস্থার কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। বিশেষত যে মর্যাদা বাংলার পাওয়ার কথা, তা সে পায়নি। ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছরে দাঁড়িয়েও এটাই সত্য।
ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়াজ উঠেছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। মূলত এর মধ্যেই নিহিত ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা। একুশে ফেব্রুয়ারির (Ekushe February) দিন কয়েকজন এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় উপস্থিত হলেন। সবার মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা। তবে বোঝা যায়নি, সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় এবং গেটের বাইরে পুলিশ টহল দিচ্ছে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিল যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। কিন্তু ছাত্রসমাজ তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিল, ১৪৪ ধারা ভেঙে রাস্তায় নামবে তারা।
১০ জন করে একেকটি দল যখন বেরতে থাকল, তখন মেডিক্যাল কলেজ অবধি পৌঁছানোর আগেই পুলিশ তাদের ট্রাকে করে তুলে নিয়ে যাওয়া শুরু করল। পরে দলে দলে ছাত্রছাত্রীদের রাস্তায় দেখে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে শুরু করল পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সে সময় একটি পুকুর ছিল। সেখান থেকে রুমাল ভিজিয়ে চোখে লাগাচ্ছিলেন পড়ুয়ারা। চূড়ান্ত খারাপ সংবাদটি জানা গেল দুপুরে। ছাত্রদের উপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনায় ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকে স্লোগান, ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুরু হয়। এভাবেই পার হল ১৯৫২-এর রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারি। ২৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে হরতাল পালিত হয়।
এই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন ছিল না, এটা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রথম অভ্যুত্থান। সেদিন পুলিশ যেভাবে ছাত্রদের ওপর গুলি ছুড়েছিল, একাত্তরে (1971 War) এসে সেটাই গণহত্যার রূপ নেয়। ‘৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার জাতীয়তাবাদী পরিবর্তনের বার্তা দিয়েছিল। কেননা, এই একুশে ফেব্রুয়ারিই বাঙালির সমস্ত ঐক্য ও সংহতির ভিত্তি।
তথ্য: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরি