মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুম্বই চলে গেলেন ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে অংশ নিতে, অভিষেক গিয়েছেন? যাবেন? জানা নেই। কিন্তু আর কি কেউ যাবেন এই বাংলা থেকে ওই মুম্বইয়ের বৈঠকে? না। এন ও, নো। কারণ এ বাংলায় ইন্ডিয়া জোট নিয়ে অন্য কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। রাত পোহালে মহম্মদ সেলিম এবং কংগ্রেস রাজ্য সভাপতি অধীর চৌধুরীর ধূপগুড়িতে উপনির্বাচনে প্রচারে যাওয়ার কথা আছে। ১০০টা শব্দের ২০টা শব্দ বিজেপির জন্য, আর ৮০টা শব্দ তৃণমূলের জন্য রাখা থাকবে, একথা বলাই বাহুল্য। কারণ এ রাজ্যে ওঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল দল। পাটনা, বেঙ্গালুরুর বৈঠকে নরেন্দ্র মোদির সরকার বিভিন্ন এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীদের হেনস্থা করছে, এর বিরুদ্ধে বহু কথা বলা হয়েছে, সাংবাদিক সম্মেলনে এই কথা বলেছেন ইন্ডিয়া জোটের নেতারা। অন্যদিকে মহম্মদ সেলিমের দল সিজিও কমপ্লেক্স অভিযান করবেন বলে চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইডিকে, দাবি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। নেহাত বিজেপি নেতৃত্বের এমনিতেই এক জনবিচ্ছিন্ন চেহারা, তার উপর তাদের তিন নেতার মধ্যে মুখ দেখাদেখিও নেই, না হলে কেবল এ রাজ্যের সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বা কংগ্রেস সভাপতি সক্কালে উঠে যা বলছেন সেইগুলোই মাথায় রেখে আওড়ে গেলেই অর্ধেক কাজ হয়ে যেত। কিন্তু এটাকে আদর্শগত কোনও অবস্থান ভাবলে বড্ড ভুল করবেন, এই বিরোধিতার সঙ্গে আদর্শ ইত্যাদির বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, এক কণাও নেই। এই বিরোধিতার পিছনে আছে ধান্দামূলক বস্তুবাদ, আবার এই কথার মানে এরকম নয় যে কমরেড সেলিম এবং অধীরবাবুর ধান্দা এক ও অভিন্ন, না তাও নয়। অধীরবাবু মাথান্যাড়া কৌস্তুভ বাগচী নন, তিনি দীর্ঘ সময় বাঁয়ে ডাঁয়ে খেলে এতদিনের রাজনৈতিক জীবন পার করেছেন, কংগ্রেসি রাজনীতির প্রথম পাঠ থেকে সহজ পাঠ ওঁর পড়া আছে। আবার এটাও ভাবার কারণ নেই যে মহম্মদ সেলিম অধীরবাবুর সঙ্গে এক দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রাজ্যের ক্ষমতা দখলের জন্য এসব করছেন, না তাও নয়। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, ইন্ডিয়া জোট, এ বাংলায় মুখ থুবড়ে পড়বে।
ইন্ডিয়া জোটের সবথেকে বড় ফল্ট লাইন দুটো জায়গায়, প্রথমটা হল আপ-এর সঙ্গে, পঞ্জাবে, দিল্লিতে, কিছুটা হলেও গুজরাতে। কংগ্রেস আর আপ-এর কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট। কোনও আদর্শের ব্যাপার আছে না কি? বিলকুল নেই, আপ মূলত কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবেই বেড়ে উঠেছে, কাজেই এই রাজ্যগুলোতে জোট হলে সিট শেয়ারিং কত কততে হবে, এটাই হল আদত কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট, গোলমালের আসল কারণ। সেই ফর্মুলা বের হয়ে গেলেই ঝামেলা খতম। ভাই তুই তিনটে আমি চারটে, হ্যাঁ হলে কাল থেকেই কংগ্রেস আপ মাঠে নেমে যাবে। কেন? কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে আজ দুটো শিবির, মোদ্দা ভাগাভাগি ধর্ম নিরপেক্ষতা, সংবিধানকে নিয়েই। কাজেই শিবিরের মধ্যে সংখ্যা ছাড়া আর লড়াইয়ের কিছু নেই। সারা দেশেই নেই, যদি এই মোদ্দা আদর্শের কারণেই হত তাহলে কেরলে কংগ্রেস-সিপিএম লড়াই হত না, সংসদীয় রাজনীতিতে সংখ্যার লড়াই আছে, কেরলে সেই কারণেই কংগ্রেস সিপিএম লড়ছে, আদর্শ মার্কসবাদ, লেনিনবাদ ইত্যাদি গেছে গড়ের মাঠে ঘাস কাটতে।
আরও পড়ুন: Aajke | অভিষেককে ইডি গ্রেফতার করতে পারে?
বাংলার ছবিটা কিঞ্চিৎ আলাদা। অধীরবাবু জানেন চাপ দিয়ে তিনের জায়গায় চার হলেও হতে পারে, লক্ষ্য নিজের আসন, এবং অন্তত আরও তিনটে। হাইকমান্ড বললে দুটো আসনেও অধীরবাবু হেঁ হেঁ করে মেনে নিয়ে মাঠে নামবেন। কিন্তু সিপিএম? কমরেড সেলিম? মমতা বিরোধিতার, একমাত্র মমতা বিরোধিতার জায়গা থেকেই দলকে সংগঠিত করা, কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে ২০২৬-এ অন্তত একটা সেফ সিটের ব্যবস্থা করা, আর কিচ্ছু নয়। ২০২৪-এ এই সেলিমকেই আমরা দেখেছিলাম অধীর চৌধুরীর ভাষণের মধ্যেই আব্বাসকে নিয়ে আদেখলেপনা করতে, সেদিন অধীর তাঁর ভাষণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেদিন কমরেড সেলিমের নজর ছিল ফুরফুরা শরিফের লাগোয়া চণ্ডীতলা আসনে আব্বাসের সমর্থন, এবং অন্তত এমএলএ হতে পারা। এখনও তাই। না সংসদীয় রাজনীতি, না সংসদ বহির্ভূত রাজনীতি, কোনওটাই মহম্মদ সেলিমের আয়ত্তের বিষয় নয়, উনি আগ্রহীও নন। বাম রাজনীতির স্বর্ণযুগে সোনার চামচ মুখে নিয়ে ওঁদের রাজনৈতিক জীবন শুরু, ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরে লক্ষ্য ছিল রাজ্য সম্পাদকের পদ, এবার যে কোনওভাবে এক আধটা আসন চাই। তাই প্রত্যেক ইস্যুতে নির্লজ্জভাবে তাঁদের প্রত্যেক কথা মিলে যাচ্ছে রাজ্যের বিরোধী দলনেতার সঙ্গে। এবং এই নির্বুদ্ধিতার ফল আবার পেতে হবে সামনের ২০২৪-এর নির্বাচনে, আবার ৪/৫/৬ শতাংশ ভোটে এসে ঠেকবে তাঁদের সমর্থন। আসনের আসা তো কেউই করছে না, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার সামর্থ্যও তাঁদের নেই। কিন্তু সমস্যা হল তাঁদের করা প্রত্যেক বিরোধিতা কিছুটা হলেও বিজেপির ভোটকে বাড়াবে, এমনিতেই বিজেপির সমর্থন কমেছে, বামেদের এক বিরাট ভোট যা বিজেপির দিকে গিয়েছিল তা ফিরছিল, কিন্তু সেই ভোট এই নির্বিচার বিরোধিতার ফলেই আবার যাবে বিজেপির দিকে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাদের রাজ্যে ইন্ডিয়া জোটের কি কোনও ভবিষ্যৎ আছে? নাকি এখানে তৃণমূল, বিজেপি আর বাম কংগ্রেসের মধ্যেই লড়াই হবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
এ রাজ্যের বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র তৃণমূলের স্বার্থ আছে জড়িয়ে এই ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে। মমতা জানেন বিজেপি বিরোধিতার তকমাটা ওই জোটের নেত্রী হিসেবে তিনিই পাবেন, এবং সেই তকমাই তাঁকে এনে দেবে এই রাজ্যের সংখ্যালঘুদের সমর্থন। অধীর বা সেলিমের সে দায় নেই, কাজেই অধীর যদি জোটের কথা বলেন, জানবেন তিনি কেবল হাইকমান্ডের নির্দেশ মেনে চলছেন আর সেলিম? না, ওঁদের এই বাংলায় কিছুদিন পরে যেটুকু অস্তিত্ব আছে তাও থাকবে না, মুছে যাওয়াটাই তাঁদের ভবিষ্যৎ। ইন্ডিয়া জোট এই বাংলায় তাই এক সোনার পাথরবাটি মাত্র।