বাঙালি হল গিয়ে ১০০ শতাংশ আন্তর্জাতিক, উদার, সংস্কৃতিবান, ধর্মনিরপেক্ষ। একথা সব্বাই জানে। তাই বাংলার রাজধানীতে, খোদ কলকাতায় গরিষ্ঠাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে না, তাই আমাদের শহর কলকাতার উল্লেখযোগ্য স্কুল-কলেজের পঠন পাঠনের ভাষা ইংরিজি, তাই দুই বাঙালি শুদ্ধতার কেয়ার না করেই অবলীলাক্রমে ইংরিজিতে কথা বলেন। শহর কলকাতার ৯০ শতাংশ দোকানের হোর্ডিং ইংরিজিতে, স্টার হোটেল আর রেস্তরাঁর নাম ইংরিজিতে কিন্তু তার মধ্যেই এক দ্বীপের মতো জেগে থাকা নন্দন চত্বরে বাঙালির চেতনা চর্চা চলে টোয়েন্টি ফোর ইনটু সেভেন। আজ বাইশে শ্রাবণ, ভাগ্যিস শিক্ষামন্ত্রী সাতসকালে জোড়াসাঁকো গিয়েছিলেন, না হলে তাও বাঙালির বিস্মরণে চলে যেত নিশ্চিত। শহুরে বাঙালির ৯০ জন বাংলা মাসের নাম বলতে পারবেন না, যে প্রজন্ম পারবেন, তাঁদের একজন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে, গান গাইছেন। আজকের জেন নেক্সটদের কাছে শ্রাবণ কোনও মানেই রাখে না। সে হেন বাংলায় নয়া শিক্ষানীতি নাকি পাশ হয়ে গেল, মানে মন্ত্রিসভায় পাশ হল, এবারে তা বিধানসভায় আসবে, কে রোখে তাকে? কার সাধ্য? কারণ শাসকদলের কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো আছে। কিন্তু খসড়া রিপোর্টটি পাশ হওয়ার পরেই মন্ত্রীমশাই কিছু বলেছেন। তারপর আজ সকালে দৈনিক খবরের কাগজে এবং সংবাদমাধ্যমে যা যা ছাপা হয়েছে তা পরস্পর বিরোধী বললে কম বলা হয়। কেউ বলছেন দুটো ভাষা পড়তে হবে, কেউ বলছেন তিনটে, কেউ বলছেন বাংলা আবশ্যিক, মানে পড়তেই হবে, কেউ বলছেন কই না তো। এসবের মাঝেই সাতসকালে মন্ত্রীমশাই ওই যে বাইশে শ্রাবণের আনুষ্ঠানিকতায় হাজির, সেখানেই সংবাদমাধ্যমকে তিনি যা বললেন তাই আপনাদের শোনাই।
আমাদের সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে এবং মন্ত্রীমশাইয়ের কথা থেকে যা বোঝা গেল তা হল, রাজ্যের নয়া শিক্ষানীতির খসড়াতে বলা আছে ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর পর্যন্ত একটি ছাত্র দুটি ভাষা শিখবে। কোন দুটি ভাষা? একটি তার মাতৃভাষা, অন্যটি তার ইচ্ছে মতন দ্বিতীয় ভাষা। মানে কী দাঁড়াল? একটি বাঙালি ছেলে ক্লাস ওয়ানে তার মাতৃভাষা শিখবে? সেটা কি কম্পালসারি? না, তা নয়। তাহলে? স্কুলে কি বাংলা আবশ্যিক করে দেওয়া হল? না তাও নয়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্রথম ভাষা ইংরিজি না মাতৃভাষা? কোনটা? মন্ত্রীর কথা শুনে বোঝা গেল? এক্কেবারেই না। এবার দ্বিতীয় ভাষার কথায় আসা যাক। সেটা কি ইংরিজি? মানে দ্বিতীয় ভাষাও কি আবশ্যিক? না তাও নয়। এরপরে পঞ্চম শ্রেণি থেকে আবার তৃতীয় ভাষা শেখানো হবে। কোন ভাষা? হিন্দি? উর্দু? আমাদের গ্রামবাংলার কোন প্রাথমিক স্কুলে তৃতীয় ভাষার শিক্ষক আছেন? তাহলে তৃতীয় ভাষা কি ৬০-৭০-৮০ হাজার, দেড় লক্ষ, দু’ লক্ষ মাইনে দেওয়া স্কুলেই থাকবে? সেখানে বাচ্চারা ফ্রেঞ্চ শিখবে, জার্মান শিখবে?
আরও পড়ুন: Aajke | কংগ্রেস আর বাম জনপ্রতিনিধিরা স্বেচ্ছায় যোগ দিচ্ছেন তৃণমূলে?
আমাদের দুর্ভাগ্য সেই কবে থেকে আমাদের রাজ্যে ভাষা শিক্ষানীতি নিয়ে আজও কোনও একটা নির্দিষ্ট যুক্তিনিষ্ঠ নীতি এল না যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। বাম সরকার এসেছিল, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ ইত্যাদি স্লোগান উঠল, মোড়ে মোড়ে ছাত্রনেতারা ওই মাতৃদুগ্ধ থুড়ি মাতৃভাষা নিয়ে কত বক্তিমে করলেন, তারপর একদিন টুপ করে তা খসে পড়ল। আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রথম ভাষা বাংলাই নেয়, এক্কেবারে হিন্দি জনবহুল এলাকাতে হিন্দি, নেপালি জনবহুল এলাকাতে নেপালি ভাষা আর কোথাও কোথাও সাঁওতালি ভাষা। পরের ভাষাটা ইংরিজি, বামফ্রন্ট নাক মুলে কান মুলে সেই দু’ নম্বর ভাষাটাকে ভোটের দিকে তাকিয়েই চালু করেছিল, ভাষা শিক্ষা কতটা হয়েছে জানি না, কিন্তু ভোট মেলেনি। এবং আরও বড় সমস্যা হল প্রাইভেট স্কুল, ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় ভাষানীতি বলে যে কিছু থাকা উচিত থাকতে পারে, তা ভাবনার মধ্যেই আসেনি। আজ এতদিন পরে আবার নয়া শিক্ষানীতির খসড়া পাস হল, এবং সঙ্গে সঙ্গে বিভ্রান্তি চারদিকে। মন্ত্রীমশাই তো বলে খালাস যে কিছু সংবাদমাধ্যম বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, কে যে ছড়াচ্ছে না তাও তো বোঝা দায়। কারণ উপর থেকে আদেশ না পেলে এমনকী মন্ত্রীমশাইও তো আগমার্কা সত্যটা বোঝাতে অপারগ। অতএব যতক্ষণ না সেই রিপোর্টের পুরোটা হাতে আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ বিভ্রান্তি কাটার নয়। মন্ত্রীমশাই সংক্ষেপে যা বলেছেন, তাতেও তো বিভ্রান্তি বেড়েছে বই কমেনি। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে দুটো প্রশ্ন রেখেছিলাম, এক) প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রদের তিনটে ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা কি আমাদের গ্রামবাংলার স্কুলে আছে? দুই) পশ্চিমবাংলার প্রাথমিক স্কুলে বাংলা পড়ানোটা কি আবশ্যিক হওয়া উচিত নয়? শুনুন তাঁরা কী বলেছেন।
প্রবাসী বাঙালিরা জানেন, বাংলার বাইরে প্রতিটি রাজ্যে সে রাজ্যের মাতৃভাষা শিক্ষা প্রাথমিক স্তরে আবশ্যিক, অন্তত সরকারি স্কুলে এমনটাই নিয়ম। যার ফলে প্রবাসী বাঙালিদের ছেলেমেয়েরাও সে রাজ্যের ভাষা শিখে ফেলে বা শিখতে বাধ্য হয় আর এ রাজ্যে ২৫টা বসন্ত কাটানোর পরেও একজন আবাঙালি নিজে কেবল নয়, তাঁর সন্তানেরাও বাংলা ভাষা বলতে পারেন না। তাঁদের ওই চোলায় চোলায় বাজবে জোয়ের ভেরি হয়ে থাকে আমাদের আ মরি বাংলা ভাষা। কিন্তু আমাদের গর্ব হল আমরা ১০০ শতাংশ আন্তর্জাতিক, উদার এবং সংস্কৃতিবান।