জলসাঘরের সেই জমিদারকে মনে আছে? সেই জমিদার যার সহায় সম্বল সব গেছে, থাকার মধ্যে আছে একটা প্রায় ভেঙে পড়া মহল আর জমিদারের মেজাজ, ব্যস। ঠিক সেরকম ছিল কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা, তার আদত ব্যবহারিক দিকগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উবে গিয়েছিল, পড়ে যা ছিল তা হল কতগুলো খেতাব আর এক বিশেষ মর্যাদা, তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন অরুণাচল প্রদেশে যাওয়া, কারণ সেখানে যেতে হলে ইনার লাইন পারমিট নিয়ে যেতে হবে যে কোনও মানুষকে, অনুমতি আছে শুধু অরুণাচলের বাসিন্দাদের, জমি কেনার ব্যাপারে সারা দেশ জুড়েই এমন আইন কানুন আছে, যেখানে চাইলেই আপনি জমি কিনতে পারবেন না, আপনি উত্তর পূর্বাঞ্চল কেন, এই বাংলারও আদিবাসীদের জমি আইনত কিনতে পারবেন না, কাশ্মীরেও সেই নিয়ম ছিল। তো যাইহোক সাত সকালে সংসদে বিল পাস করিয়ে, ধারা ৩৭০, আর্টিকল ৩৭০ তুলে নেওয়া হল, কেবল তাই নয়, কাশ্মীরকে দুটো টুকরো করা হল, তার রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করা হল, তাকে আন্দামান লাক্ষাদ্বীপের মত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়া হল।
প্রথমে অনেকেই বুঝতে পারেননি, ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়া তো হল, কিন্তু রাজ্যের মর্যাদা কাড়ার কারণ কী? এখন বোঝা যাচ্ছে। আসছি সে কথায়, কিন্তু এইসব করার জন্য, জম্মু কাশ্মীর জুড়ে এক কারাগার তৈরি করা হল, প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের জেলে পোরা হল, ইন্টারনেট বন্ধ করা হল, নিউজ পেপার ইত্যাদির ওপর চাপ তৈরি করা হল, সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হল না, ভারতবর্ষের অন্য প্রান্ত থেকে রাজনৈতিক দলের নেতাদের ঢুকতে দেওয়া হল না, সব মিলিয়ে এক জবরদস্ত জরুরি অবস্থা। আর তা যে খুব একটা নতুন কিছু তাও তো নয়, কাশ্মীর দীর্ঘ দিন ধরে অবরুদ্ধ, কাশ্মীরী মানুষজনের অভিযোগ তাঁরা এক মিলিটারি শাসনে বসবাস করেন, কাজেই এই অবস্থা তাঁদের কাছে নতুন কিছু নয়। বছর দেড়েক পর রাজনৈতিক দলের নেতাদের জেল থেকে ছাড়া হল, যাদের ঘরেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তাঁদেরও ছেড়ে দেওয়া হল। তাঁদের নিজেদের মধ্যে যে খুব সদ্ভাব ছিল, তা তো নয়, কিছুদিন আগেই ন্যাশনাল কনফারেন্সের ফারুক আবদুল্লা, ওমর আবদুল্লা, পি ডি পির মেহেবুবা মুফতির বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়েছেন, সিপিআইএমের ইউসুফ তারিগামি, এই দুই দলের বিরুদ্ধেই লড়েছেন। কিন্তু শত্রুর শত্রু আমার মিত্র ফরমুলা মেনে, কাশ্মীরে বিজেপি ছাড়া প্রত্যেকটি দল আলোচনায় বসলেন, বসলেন গুপকর বলে এক এলাকায়, শ্রীনগরের পশ এলাকা, সেখানে সরকারি দফতর, বড় বড় নেতাদের বাড়ি, তো সেখানে মিটিং হল, কংগ্রেস ও প্রথমে ছিল, তারা একটা ঘোষণাপত্র বা ডিক্লারেশন জারি করলো, বলা হল গুপকর ডিক্লারেশন, সেই ডিক্লারেশনকে ঘিরে তৈরি হল এক মঞ্চ, পিপলস অ্যালায়েন্স ফর গুপকর ডিক্লারেশন, এসবই স্বাভাবিক। ধরুন ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেছেন, বিরোধী নেতাদের জেলে পুরেছেন, জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হল, বিরোধী নেতারা এক জায়গায় জড় হল, জনতা দল তৈরি হল, এসব তো রাজনীতিতে হয়েই থাকে। কিন্তু এরপর যা হল, সেটা আর এস এস – বিজেপির বৈশিষ্ট। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ওই গুপকর গ্যাংরা কাশ্মীরে অশান্তি তৈরি করতে চায়, ব্যস। সম্বিত পাত্র থেকে অর্ণব গোস্বামী, গুপকর গ্যাং, গুপকর গ্যাং বলে চিৎকার শুরু করে দিল। দেশের মানুষের সমস্যা অনেক, তাঁরা গুপকর ডিক্লারেশন কি তা জানে না, কিন্তু গুপকর গ্যাং কথাটা টিভিতে বারবার শুনে তাঁদের মনে হয়, খুব বাজে লোক, ডাকাত বা চোরেরা বোধহয় কোনও গ্যাং বানিয়েছে, এ জিনিষ আগেও হয়েছে, হঠাৎ কিছু ছাত্র নেতা, উমর খালিদ, কানহাইয়া কুমারকে ওই অমিত শাহ, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টুকরে টুকরে গ্যাং বলা শুরু করলেন, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্বিত পাত্র আর অর্ণব গোস্বামী, ব্যস, চালু হয়ে গেলো টুকরে টুকরে গ্যাং, এরা নাকি দেশটাকে টুকরো টুকরো করতে চায়, এক ভদ্রলোক স্বরাষ্ট্র দফতরেই এক আরটিআই করে প্রশ্ন পাঠালেন, এই টুকরে টুকরে গ্যাংয়ে কারা আছে? এরা কারা? উত্তর এল এরকম কোনও গ্যাংয়ের কথা তাঁদের জানা নেই, ওদিকে সেই দফতরের মাথায় বসে থাকা মোটাভাই অমিত শাহ বলছেন, টুকরে টুকরে গ্যাং দেশটাকে টুকরো করার চক্রান্ত চালাচ্ছে, বুঝুন।
৭৭ এ জরুরি অবস্থা উঠে গেলো, জনতা দল তৈরি হচ্ছে, শুনেছেন কোনও দিন এরকম ভাষা, এই সংস্কৃতি আরএসএস – বিজেপির। তো সেই গুপকর গ্যাং, যারা নাকি কাশ্মীরে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়, তাঁদেরকে বৈঠকে ডাকলেন প্রধানমন্ত্রী, কেন? কাশ্মীরে সাধারণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু করার জন্য। কিছুদিন আগেই কাশ্মীরে, ডিস্ট্রিক্ট ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের নির্বাচন হয়ে গেছে, কাশ্মীর শ্রীনগর ভ্যালির ১৪০ টা আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৩ টে আসন। আসলে, তড়িঘড়ি করে ডিডিসি নির্বাচন ঘোষণার মূলেও ছিল এক প্ল্যানিং, অমিত শাহ ভেবেছিলেন, কাশ্মীরের রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্বাচন বয়কট করবে, পিডিপি তেমন কথা বলছিল, বয়কট করলে ওনারা মেজরিটি পাবেন, এবং এই ডিডিসির হাতে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ থাকে, তা দিয়ে নতুন খেলা শুরু করা যাবে, বিরোধীরা সে ফাঁদে পা দেয়নি, এবার আরেক নতুন প্ল্যানিং, সেই গুপকর গ্যাংকে ডাকা হল, আচ্ছা বৈঠকে অমিত শাহকে কেউ প্রশ্ন করলেন যে, আপনি গুপকর গ্যাং বলছিলেন কেন? কোন ভিত্তিতে? না সৌজন্যবশত কেউ সে প্রশ্ন করে নি, তারাও বৈঠকে চেয়েছে কাশ্মীরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হোক, আরএসএস – বিজেপি আজ নয়, খুলে দেখুন জনসংঘের কর্মসূচি, সেই ১৯৫২ সালেও তাদের দাবি ওই ৩৭০ এর বিলোপ, তারা সেই কাজ করেছে, বৈঠকেও জানিয়ে দিল যে ৩৭০ ধারা ফেরত দেওয়া হবে না, কিন্তু ডিলিমিটেশনের কাজ শেষ হলেই রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে, অবশ্যই কাশ্মীর থেকে লাদাখ বরাবরের জন্যই আলাদা করে দেওয়া হয়েছে, বৈঠকে সবাই যে যার মত বললেন, চা বিস্কুট খেলেন, কোনও সিদ্ধান্ত ঘোষণা হল না, বিজেপি সেদিনই জানিয়ে দিল, ৩৭০ ধারা ভুলে যান, ওটা অতীত, হ্যাঁ। নির্বাচন হবে, রাজ্যের মর্যাদাও দেওয়া হবে, সে নিয়ে আলোচনাও চলছে, সে আলোচনার কিছুটা রাজনৈতিক মহলে জানাজানিও হয়ে গেছে, সম্ভবত রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হলেও পুলিশ বা স্বরাষ্ট্র দফতর রাজ্যের হাতে থাকবে না, খানিকটা দিল্লির মত আধা সরকার, সম্বিত পাত্র, অর্ণব গোস্বামী সে সব কথা নিয়ে আলোচনাও করলেন, ওমর আবদুল্লা বললেন রাজ্যের মর্যাদা ফেরত দিতে হবে, মেহেবুবা মুফতি বললেন, ৩৭০ ধারা ফেরত দিতে হবে, সিপিএমের ইউসুফ তারিগামিও ৩৭০ ধারা ফেরত চাইছেন, অর্ণব অট্টহাস্য করছেন, ৩৭০ ধারা নাকি অতীত, রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে, সেটাই এখন বড় ব্যাপার, বোঝা গেলো রাজ্য কেন ভাঙা হয়েছিল, লাদাখ স্ট্রাটেজিক এরিয়া বলে তাকে আলাদা করা হল, আর কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা দেবার চুক্তিতে ৩৭০ ধারা কেড়ে নেওয়া হল, এবং পুলিশি ক্ষমতা না থাকার ফলে, সে সরকার কেজরিওয়ালের সরকারের মত দিল্লি মুখাপেক্ষি হয়ে বসে থাকবে, সবচেয়ে বড় কথা হল ডিলিমিটেশন কবে শেষ হবে, সেটাও জানানো হয়নি। তাহলে এই বৈঠকটা কেন?
প্রথমত কাশ্মীর নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে চাপ বাড়ছিল, আমেরিকার চাপ, জি সেভেন বৈঠকের চাপ ইত্যাদি ক্রমশ ভারতবর্ষকে রাজনৈতিকভাবে একঘরে করার এক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, মোদি সরকার বুঝতে পারছিলেন বিলক্ষণ যে কিছু একটা করতেই হবে, ওদিকে দিন ঘনিয়ে আসছে, ২০২৪ আর তিন বছর, এদিকে করোনা মৃত্যু, ভ্যাক্সিনেশন আর অর্থনৈতিক বিপর্যয় কুরে কুরে খাচ্ছে জনপ্রিয়তা, রাজ্যে রাজ্যে বিরোধীরা মাথাচাড়া দিচ্ছে, বাংলা তামিলনাড়ু হাতের বাইরে, ত্রিপুরাতে অন্য সুর, উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েত ভোটে বিপর্যয়, কৃষক আন্দোলন। সব মিলিয়ে ছবিটা খুব সুখকর নয়, এটা নরেন্দ্র মোদি বুঝতে পারছেন, তাই এই বৈঠক ডাকা, অনেক ভেবে চিন্তে ভাল দাবার চাল, বৈঠকের ঘোষণা ও আহ্বান প্রকাশ্যে, বিরোধীরা না এলে বলা হত, আমরা আলোচনা চাইছি, ওনারা চান না, আন্তর্জাতিক মহলেও খবরটা যেত যে, সরকার আলোচনা চায়, বিরোধীরা চায় না। বিরোধীরা সে সুযোগ না দিয়েই এলেন, কিন্তু আগে ডিলিমিটেশন হবে তারপর নির্বাচন, তারপর রাজ্যের মর্যাদা, সে মর্যাদা কেমন তা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন ঝুলে রইল, পুলিশ কার হাতে থাকবে, রাজ্য সরকারের পরিধি কী হবে, কোনও আলোচনাই নেই, আলোচনা থেকে বেরিয়ে এসে বিরোধীরা বুঝতে পারছেন, আলোচনায় হাজির করানোটাই ছিল সরকারের উদ্দেশ্য, সে উদ্দ্যেশ্যে সরকার সফল, আর কাশ্মীরের মানুষ যে তিমিরে সে তিমিরে, ৫ আগস্ট ২০১৯ তুলে নেওয়া হল ৩৭০ ধারা, রাজ্য ভাঙা হল, একটা নতুন শিল্পও কি গড়ে উঠেছে? ভারতবর্ষের কোনও শিল্পপতি কি জমি কিনেছেন? একজনও কাশ্মীরী ব্রাহ্মণকে কি পুনর্বাসন দেওয়া গেছে? কাশ্মীরের মানুষ কি ভাল আছেন? ইনফিল্টারেশন, ঘুসপেট, উগ্রপন্থীদের কার্যকলাপ কি কমেছে? না একটা প্রশ্নেরও উত্তর নেই, কেবল রাজনীতি হচ্ছে, কাশ্মীরের মানুষ শুধু দেখে যাচ্ছেন, ৪৭ সাল থেকে তাঁদের জীবন নিয়ে, তাঁদের বাঁচা মরা নিয়ে অবিরাম দাবা খেলা, পাকিস্তান, ভারত আর আজাদ কাশ্মীরের মধ্যেই তাঁদের স্বপ্নের তিলে তিলে মরতে দেখছেন তাঁরা, ডাল লেকে শিকারা ঘুরছে ট্যুরিস্ট নেই, হাউসবোটগুলোতে আলোও জ্বলে না, লাল চৌক বা ডাল লেকের ধারে কাশ্মীরি ওয়াজঁয়ানের গন্ধ নেই, কেবল বুটের শব্দ, কেবল আতঙ্ক, কেবল বারুদের গন্ধ।