চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে, যে রাজকোষ পাহারা দেওয়ার কথা ছিল চৌকিদারের। যে চৌকিদার প্রত্যেক জনসভায় চিৎকার করে বলেছিলেন, না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা। সেই চৌকিদারের আমলে আজ হাতে দেশের ক্রম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বলছে এক ডজন চুরির গল্প। এর আগে আমরা এই চুরির কিছু অংশ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, আজ পুরো রিপোর্ট থেকে এক ডজন চুরির ঘটনা আপনাদের জন্য হাজির করছি। এতদিন ধরে আলোচনা হত মোদি সরকারের সাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে, আলোচনা হত বিকাশের, উন্নয়নের এক মডেল নিয়ে, যা বড়লোকেদের আরও বড়লোক তৈরি করছে, গরিবদের আরও গরিব। আলোচনা হত বিভিন্ন জনবিরোধী নীতি নিয়ে, ডিমনিটাইজেশন নিয়ে। আলোচনা কেবল নয়, দেশ দেখেছে বিক্ষোভ, রাস্তায় মানুষের প্রতিবাদ, সিএএ এনআরসি নিয়ে বা কৃষি বিল নিয়ে। দুর্নীতি বলতে স্বজনপোষণের কথাই এসেছে, কীভাবে অমিত শাহের ছেলের সম্পত্তি বাড়ে ১৭৬ গুণ, কীভাবে দেশের মোট আয় হু হু করে যখন কমছে সেই করোনার সময়েও আদানি আম্বানি গোষ্ঠীর সম্পদ বেড়েছে রকেট গতিতে। এসব নিয়ে আলোচনা হতো বইকী, বোঝাই যাচ্ছিল চৌকিদার চুরি নয় ডাকাতি করছে কিন্তু সরাসরি প্রমাণ ছিল না মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারের আর্থিক দুর্নীতি কীভাবে বোঝা যায়? কোনও না কোনওভাবে সেই দুর্নীতির সূত্র হাজির হয় সিএজি রিপোর্টে। দেশজুড়ে যে অডিট হয়, হিসেবপত্রের জাঁচ পড়তাল হয় সেই রিপোর্টে বেরিয়ে আসে। কিন্তু গত ৮ বছর সেই রিপোর্টে মামুলি কিছু অভিযোগ থাকলেও বড় দুর্নীতি, বড় স্ক্যামের কথা পাওয়া যায়নি। এবার সেই সিএজি রিপোর্টে ভূরি ভূরি দুর্নীতির ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। কেবল দুর্নীতিই নয়, আরও অনেক বিষয় সামনে এসেছে যা বুঝিয়ে দেয় যে মোদিজি বা তাঁর দলের যাবতীয় কাজকর্ম তা কেবল দেশের আপার কাস্টের জন্য, বড়লোকেদের জন্য, বাকিটা কেবল নৌটঙ্কি।
এবং দেখুন ১৪ অগাস্ট এই সিএজি রিপোর্ট সংসদে এসে গেছে, সাংবাদিকরা পেয়েছেন, অথচ দেশের বড় মিডিয়াতে তা নিয়ে কোনও আলোচনা নেই। নেই কারণ তারা সোল্ড, মেরুদণ্ড বিক্রি হয়ে গেছে, ক্ষমতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে তারা পারে না। নরম মাটিতে আঁচড় কেটেই তাদের সন্ধে কাটে। থাক ওদের কথা, আসুন একে একে মোদি সরকারের এক ডজন দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা করা যাক প্রায় ১১০০-র মতো টোল ট্যাক্স রয়েছে আমাদের দেশে। ঝাঁ চকচকে রাস্তা হয়েছে কিন্তু তা দিয়ে যেতে গেলে গ্যাঁটের কড়িও খরচ করতে হবে। এই টোল ট্যাক্সের দেখরেখ করে ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অফ ইন্ডিয়া। তাদের নিয়ম অনুযায়ী যদি কোনও রাস্তায় কাজ চলে, ডাইভারসন থাকে, তাহলে সেখানে টোল ট্যাক্সের মাত্র ২৫ শতাংশ নেওয়া যাবে। সিএজি দেশের ৫টা রাজ্য, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, কেরল, তেলঙ্গানার ৪১টা টোল প্লাজাতে অডিট চালিয়ে দেখেছে, মাত্র ৫টা টোল প্লাজায় ১৩২.০৫ কোটি টাকা বেশি নেওয়া হয়েছে, মানে মানুষের পকেট থেকে বেশি পয়সা বেরিয়ে গেছে। মাত্র ৪১টার অডিট হয়েছে, মোট ১১০০-র অডিট হলে টাকাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভাবুন। এই টাকা যাচ্ছে কোথায়? চৌকিদার চোর হ্যায়। ঘোটালা নম্বর দুই, ২০১৬-তে মোদিজি স্লোগান দিয়েছিলেন, উড়ে দেশ কি আম নাগরিক। আজ দেশের ৮৪ কোটি মানুষ সরকারের দেওয়া রেশনের ফ্রি চাল গম ডালের জন্য বসে থাকেন, তাঁদের একজনও কি প্লেনে চড়া দূরস্থান, এয়ারপোর্টও দেখেছেন? থাক সে কথা, সেদিন মোদিজি উড়ান বলে এক প্রকল্প চালু করেছিলেন, দেশের ছোট ছোট শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার জন্য ডোমেস্টিক এয়ারলাইন্স-এর কথা বলেছিলেন। তাঁর এই ঘোষণার পরে স্বাভাবিকভাবেই বণিকসভার সদস্যরা উচ্ছ্বসিত ছিলেন, তাঁদের এবং তাঁদের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সময় বাঁচবে। সে যাই হোক, ৭৭৪টা এমন ছোট এয়ারপোর্ট এবং ডোমেস্টিক রুট চালু করার কথা হল।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ২০২৪-এ নরেন্দ্র মোদির সামনে তিনটে বিপদ, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব আর জোট
সিএজি রিপোর্ট বলছে, তার মধ্যে ৪০৩টেতে কাজ শেষ হয়েছে, সেই ৪০৩-এর মধ্যে ১১২টাতে উড়ান শুরু হয়নি। কাদেরকে এই কাজ দেওয়া হল? কেন কাজ শেষ হল না? দেরি হওয়ার ফলে কাজের খরচ বাড়বে এবং সবচেয়ে বড় কথা এর মধ্যে ক’টা রুটে লাভ হচ্ছে? নাকি কেবল স্লোগানবাজি হচ্ছে? নাকি তার আড়ালে আরও বড় কোনও দুর্নীতি চলছে? কারণ এয়ারপোর্টের নাম করে বিশাল জমি অধিগ্রহণ কিন্তু আগেই হয়ে গেছে, সেসব অধিগৃহীত জমির দিকে শকুনের নজর আছে অনেকের, সে শকুনেরা কারা তা নতুন করে বলতে হবে না। চৌকিদার চোর হয়। তিন নম্বর স্ক্যামে আসুন, আগেই একবার বলেছি যে ভারতয়ালা প্রজেক্ট-এ প্রতি কিলোমিটারের খরচ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে, দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়েতে তো ১৮.২০ কোটি টাকা প্রতি কিলোমিটারের বদলে ২৫০.৭৭ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে, এই খরচের অনুমোদন দেয় ক্যাবিনেট কমিটি অফ ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স, যার মাথায় স্বয়ং মোদিজি। নতুন তথ্য এল, দিল্লি ভদোদরা এক্সপ্রেসের কাজ শুরু হয়ে শেষের দিকে, কেবল সিভিল কন্সট্রাকশনের জন্য ৩২৮৩৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে গুজরাটের ভদোদরাকে দিল্লির সঙ্গে জোড়ার জন্য, কিন্তু এই খরচ ওই ক্যাবিনেট কমিটি অনুমোদন করেনি। তাহলে কী করে খরচ হল? নাকি গুজরাটের কোনও খরচে কোনও আইনই কাজে লাগে না? চৌকিদার চোর হ্যায়। চার নম্বর ঘাপলা, রেল দফতর ২০২১-২২ এর মধ্যে ২৩৮৮৫.৪৭ কোটি টাকা তাদের বাজেট বরাদ্দের বাইরে অনুমোদন ছাড়াই খরচ করেছে, ৩০/৪০/৫০ কোটি নয়, ২৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। কেন করল? কোন খাতে করল? দায়ী রেলকর্তাকে জেলে পোরা হয়েছে? না হয়নি। চৌকিদার চোর হ্যায়। ৫ নম্বর ঘোটালা খাদি গ্রামোদ্যোগ নিয়ে, এটা ক্ষুদ্র, ছোট আর মাঝারি শিল্প দফতরের অধীনে চলে, মোদি সরকার খাদি গ্রামোদ্যোগকে শুকিয়ে মারার চেষ্টা বহুদিন ধরেই চালাচ্ছেন, এখন দেখা যাচ্ছে খাদি গ্রামোদ্যোগের ৮০ শতাংশ ইউনিট কাজই করছে না, বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, মাত্র ২০ শতাংশ কাজ করছে। কেন? বন্ধ হয়ে থাকা ইউনিটগুলো নিয়ে কী ভাবনাচিন্তা চলছে? অসমর্থিত সূত্রের খবর ওগুলো বেচে দেওয়া হবে? কাদের বেচা হবে? কে কিনবে? দালালি কারা পাবে? কত দামে বেচা হবে? চৌকিদার চোর হ্যায়।
৬ নম্বর ঘাপলার খবর এসেছে ট্যুরিজম দফতর থেকে, মোদি আমলের নতুন স্কিম স্বদেশ দর্শন, তাতে ৫০০ কোটি খরচের কথা ছিল, খরচ হয়েছে আটগুণ বেশি, ৪০০০ কোটি টাকা। এদিকে ১০০০ কোটি টাকার বেশি খরচ করতে হলে ক্যাবিনেট কমিটির অনুমোদন লাগে, এখানে সেই অনুমোদন নেওয়া হয়নি। কেন নেওয়া হয়নি? কোথায় সেই টাকা খরচ হল? চৌকিদার চোর হ্যায়। এবার চলুন ৭ নম্বর দুর্নীতির তথ্যে, এখানে দুর্নীতির সঙ্গে বিজেপির ভণ্ডামি মিশে গেছে। যে কোনও অঞ্চলের বড় প্রকল্পের ৮.৩ শতাংশ সিডিউল কাস্টদের জন্য আর ৪.৫ শতাংশ সিডিউল ট্রাইবদের জন্য খরচ করার কথা, এরফলে এসসি, এসটি ভুক্ত মানুষজনের সামূহিক বিকাশ হয়। চা বাগানে আমাদের টি বোর্ড অফ ইন্ডিয়া এসসিদের জন্য খরচ করেছে মাত্র ৩.২৯ শতাংশ আর সিডিউল ট্রাইবদের জন্য খরচ করেছে ২.৬৩ শতাংশ। এদিকে মুখে ওই এসসি, এসটি ভোটের জন্য কত গালভরা কথা বলেন আমাদের মোদিজি, কিন্তু কাজের বেলায় তাঁর সরকারের দফতর এসসি, এসটিদের টাকা মেরে দিচ্ছে। মার্চ ২০২১ এর মধ্যে ১৫টা বড় চা বাগান বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে ১২০৩৯ জন স্থায়ী কর্মী আর ৪৪৮০ জন অস্থায়ী কর্মী তাদের চাকরি খুইয়েছেন। চৌকিদার চোর হ্যায়। ৮ নম্বর ঘোটালা মিনিস্ট্রি অফ কমিউনিকেশনের অন্তর্ভুক্ত ডিপার্টমেন্ট অফ পোস্টকে নিয়ে যাদের আমাদের দেশের হেরিটেজ প্রপার্টিগুলো দেখার কথা। সিএজি রিপোর্ট বলছে এই হেরিটেজ প্রপার্টিগুলো দেখার না আছে কোনও পরিকল্পনা না আছে ব্যবস্থাপনা, যার অভাবে এগুলো পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। কেন? ভেঙে পড়লে প্রাইম এলাকায় থাকা এই প্রপার্টির জায়গায় স্কাইস্ক্র্যাপার তোলা হবে বলে? কার স্বার্থে এটা হচ্ছে? চৌকিদার চোর হ্যায়। ৯ নম্বরে সিএজি আবার উল্লেখ করেছে রেল দফতরের কথা, রেলের কাজের জন্য খরচ আর মোট আয়কে ধরে অপারেটিং রেশিও বার করা হয়, এক জমানায় রেল প্রচুর লাভ করত, অপারেটিং রেশিও ছিল ৮৩ শতাংশ। মানে ১০০ টাকা রোজগারে ৮৩ টাকা খরচ, মোদিজির আমলে তা কমতে শুরু করেছিল। ২০২১–২২-এ সিএজি জানাচ্ছে, অপারেটিং রেশিও ১০৭.৩৯ শতাংশ, মানে ১০০ টাকা রোজগার, ১০৭.৩৯ টাকা খরচ। এরপর খরচ বেশি হচ্ছে বলে পুরো রেলকে বেচে দেওয়া হবে, যেভাবে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সকে বেচে দেওয়া হল। সেটাই আসল পরিকল্পনা, কারণ সেই বেচার মধ্যে বিরাট ঘাপলা থাকবে। চৌকিদার চোর হ্যায়।
১০ নম্বর দুর্নীতির কথা আগেও বলেছি, মোদিজির সাধের আয়ুষ্মান ভারতের কথা, নতুন তথ্য যা পেলাম তা খুব মজার, ২.২৫ লক্ষ রোগীর সার্জারির খরচ তোলা হয়েছে, সার্জারির দিন যা পাওয়া যাচ্ছে, সেই দিনের আগেই সেই রোগীদের ডিসচার্জ করে দেওয়া হয়েছিল। মধ্যপ্রদেশ আর মহারাষ্ট্রে বিরাট ঘাপলা হয়েছে। চৌকিদার চোর হ্যায়। ১১ নম্বর দুর্নীতির কথাও আগে আলোচনা করেছি, শিশুকল্যাণ বিভাগ থেকে বৃদ্ধা, বিধবা আর বিকলাঙ্গদের পেনশন দেওয়ার টাকাতে মোদিজির সহাস্য মুখ ছাপা হয়েছে, স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। চৌকিদার চোর হ্যায়। তালিকার ১২ নম্বরে দূদুর্নীতির শিকড় অনেক গভীরে। সিএজি বলছে, দেশ জুড়ে এই ডিজিটাল অগ্রগতির সময়ে কাস্টমস ডিউটির ফর্ম ফিল আপ এখনও ম্যানুয়ালি হচ্ছে, এক্সপোর্ট বাড়ছে, ইমপোর্ট তো বেশি ছিলই। সিএজির কথায় স্পষ্ট যে এই ম্যানুয়াল ফর্ম ফিল আপ-এর পিছনে বিরাট চক্র কাজ করছে, এবং কিছু বেনিয়ারা কোটি কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। হ্যাঁ, এতগুলো দূর্নীতির অভিযোগ আসার পরে একজন ইডি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যায়নি, নীতিন গড়করি বা স্মৃতি ইরানি বা মনসুখ মালব্য বা রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের বাড়িতে ইডি, সিবিআই যায়নি। তাদের গ্রেফতার করে জেলে পোরেনি, জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা একটা কথার কথা ছিল, চৌকিদার চোর হ্যায়।