ভগৎ সিং ফাঁসিকাঠে চড়ছেন, সঙ্গে শুকদেব, রাজগুরু, প্রেম ধবন-এর লেখা গান গাইছেন, মেরা রং দে বসন্তি চোলা মায়ে রং দে বসন্তি চোলা, আমায় বাসন্তী রং-এর পোশাকটা দাও মা, আমার বাসন্তী রং-এর পোশাকটা দাও। সেই বাসন্তি রং, গেরুয়া রং যা ত্যাগের প্রতীক, এক যৌবনের অগ্রদূত নিশ্চিত মৃত্যুর আগে এর থেকে ভাল কীই বা আর গাইতে পারত। আমাদের পূর্ব বাংলা থেকে পঞ্জাব পর্যন্ত যা বাসন্তী রং, সেই রংই গুজরাত মহারাষ্ট্রে নেমে হয়েছে ভাগওয়া হয়েছে কেশরী হয়েছে, বহু বহু পরে তা প্রতিবাদী ধর্মের হাত ধরে গেরুয়া হয়েছে। আদি মুনি, ঋষি ব্রাহ্মণদের পোশাক ছিল সাদা, হ্যাঁ সফেদ, দুগ্ধ ফেনিল সাদা, দুধের ফেনার মতো সাদা। চারটে বেদে কোথাও গেরুয়া রঙের উল্লেখ নেই। বহু পরে মূলত ব্রাহ্মণ্য বিরোধী প্রতিবাদী ধর্মের নেতারা গেরুয়া পরতে শুরু করেন, ক্রমশঃ তা সাধু-সন্ন্যাসীদের বসন হয়ে দাঁড়ায়। গেরুয়া বা গিরে মাটিতে ছাপানো পোশাকের রংকেই গেরুয়া বলা হত, সেই গেরুয়া আদতে অত্যন্ত আধুনিক এক রং। এখন সেই রংয়ের ঠিকেদারি নিয়েছে কিছু অর্বাচীন অশক্ষিতের দল, আর অর্বাচীন অশিক্ষিতের হাতে মুক্তোর মালাও ছিঁড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলার জন্য, বাঁদরের হাতে মুক্তোর মালা পড়লে যা হয়। সেই ঠিকেদারেরা নাকি হিন্দু, আর তাদের পবিত্র রঙ নাকি গেরুয়া, তাই নিয়েই দেশ জুড়ে রংবাজি করে বেড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: কেবল ঘোষণার সরকার, ঘোষণাতেই শেষ?
শাহরুখ কেন খালি গায়ে, দীপিকা পাড়ুকোন কেন গেরুয়া রং-এর বিকিনি পরে গান গাইছে, দেশ জুড়ে ওই হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত ঠেকেদারেরা ছবি ব্যান করার ফতোয়া জারি করেছে। এই প্রথমও নয়, যখন তখন হিন্দু ধর্মের নামে ফিল্ম ব্যান করার, বয়কট করার ফতোয়া জারি শুরু হয়েছে গত ক’ বছর জুড়ে। এবং তাকিয়ে দেখুন সব বিষয়ে ঘন্টাখানেক বক্তৃতা দিয়ে ফেলেন যিনি, সেই নরেন্দ্র মোদি একটা কথাও বলছেন না, দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশের মধ্যে কতগুলো অশিক্ষিত জানোয়ারদের ফতোয়া দেয়ার বিরুদ্ধে কোনও কথা না বলার মানে হল এই হুলিগানিজম-এ তেনার সায় আছে, নিশ্চয়ই আছে, কারণ এই ছোট ছোট বিভেদের মশলা দিয়েই তো মোদি – শাহ, বিজেপি – আরএসএস-এর রাজনৈতিক দর্শন তৈরি হয়েছে। এনাদের কল্যাণে গাঁদা এখন হিন্দুদের ফুল, রজনীগন্ধা মুসলমানেদের, নারকেল আজ হিন্দুদের ফল আর খেজুর মুসলমানদের, এরাই ঠিক করে দেয় সবুজ হল মুসলমানদের রং আর গেরুয়া হল হিন্দুদের, অতএব গেরুয়া বিকিনি পরে নাচা যাবে না, ওনাদের স্মৃতি ইরান ওই গেরুয়া বিকিনি পরেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে সুন্দরী পুরস্কার নিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সে তো কংগ্রেস জামানায়, অন্তত তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি, পুরনো হিন্দি ছবিগুলোতে ডাকাতেরা আসত গেরুয়া ফেট্টি পরে জয় ভবানী বলে, কেউ তো প্রশ্ন করেনি। করেনি কারণ সেই প্রশ্ন বিভাজন তৈরি করে ভোট এনে দিত না। এখন করছে কারণ বিভাজনের রাজনীতিই ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করে দিচ্ছে, সেই জন্যই হিন্দু ব্রাহ্মণ ধর্ষকরা বেমালুম ছাড়া পেয়ে যায় জেল থেকে কারণ তারা সংস্কারি মানুষ, ডবল মজা হল যিনি এই কথা বুক বাজিয়ে বললেন তিনিও নির্বাচনে জিতলেন বিপুল ভোটে। কাজেই আকাশের বিভাজন হোক, বিভাজন হোক নদী জঙ্গলের, বিভাজিত হোক আমাদের পাহাড় পর্বত, ভেঙে দেওয়া হোক জলাশয়ের বর্ণপরিচয়, একই নিয়ম ধরে কিছু রং হবে হিন্দু, কিছু মুসলমান, রঙ চিনে চিনে কোতল হবে মানুষ, এটাই তো রাজনীতি। এই রং এর পেছনে লুকিয়ে থাকা সত্যিটা আসুন দেখে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: একটা আত্মহত্যা, বেকারত্ব আর ছাঁটাইয়ের গল্প
আলো না থাকলে সমস্ত রং কালো, বিশাল নীলা আশমান রাতে কালো ঘুরঘুট্টি, অমাবস্যায় কালো আপনার প্রেমিকার মুখ। আবার রং-এর না থাকাই হল সাদা, কোনও রংই নেই, আলো আছে, তাহলে তা সাদা দেখাবে, সেটাই সাদা রঙ। বাকি সব হল আরজিবি, রেড, গ্রিন, ব্লু। লাল সবুজ আর নীল। পৃথিবীর বাকি সব রং এই তিন রংয়েরই পারমুটেশন, কম্বিনেশন বা একটা বা দুটোর অ্যাবসেন্স, না থাকা। হলুদ হল নীল বাদে লাল আর সবুজ এক পরিমাণে মেশানো। আর বেগুনি? বেগুনি তে সবুজ থাকবেই না, লাল থাকবে ৫৬.১%, নীল থাকবে ১০০%, মিশিয়ে নিন, হয়ে যাবে বেগুনি। আর গেরুয়া? যা নিয়ে এত বাওয়ালি, তাতে কোনও রঙ আছে? আমাদের পতাকায় যে রং আছে তা কমলা, স্যাফ্রন, কেশরী, অনেকে গেরুয়াও বলবেন, তো সেই রঙ এ ২৫৫ ভাগ লাল, ১৫৩ ভাগ সবুজ আর ৫১ ভাগ নীল আছে। রঙ এর ফারাক যারা করে তাদের মূর্খ ছাড়া কিই বা বলা যাবে বলুন তো? আবার ওই গেরুয়াও কি এক রকম? না, গিরে মাটিতে ছোপানো কাপড়ের আর জি বি এক্কেবারে আলাদা, রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের গেরুয়া আলাদা, ইস্কনের গেরুয়া আলাদা, মমতার সামনে অরিজিৎ গাইলেন রঙ দে তু মোহে গেরুয়া, অমনি ছাগলের তিন নম্বর সন্তানদের কী লাফালাফি, গেরুয়া, গেরুয়া। আরে বাবা রাঁঝে কি দিল সে ইয়ে দুয়া, রং দে তু মোহে গেরুয়া, ভালবাসার কথা হচ্ছে, বিশুদ্ধ ভালবাসার কথা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে হোক আর মোহন ভাগবতের সামনেই হোক, সমস্যাটা কোথায়? আসলে এই ছবি বেরিয়েছিল ২০১৫ তে, ১৮ ডিসেম্বরে, তখনও এই ছাগলের তৃতীয় সন্তানেরা হাজির হয়নি মাঝমাঠে, তারা তখনও সাইড লাইনে ছিল, এখন এই গান গাইলে পাঠানের মতোই দিলওয়ালেও কেস খেয়ে যেত, ফতোয়া দেওয়া হত ছবি ব্যান করার।
আসল কারণটা কী?
আসল কারণ হল সর্বত্র এক ধর্ম জিগির তুলে রাখতে হবে, সর্বত্র হিন্দু আর মুসলমান বিভাজন দরকার, দরকার নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক বাড়ানোর জন্য, দেশের ৭৮.৯% হিন্দু, কিন্তু আর এস এস – বিজেপির দুঃখ হল এখনও মাত্র দেশের ৪০% হিন্দু বিজেপিকে ভোট দেয়, বিজেপি চায় এক তীব্র ইসলাম বিদ্বেষী হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ক, যা দেশের হিন্দু জনসংখ্যার অন্তত ৮০/৮৫% হবে, তার মানে মোট ভোটের ৫৬ থেকে ৬০%, এই বিভাজনে মানুষকে একবার আনলে বিজেপির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং মৌরসিপাট্টা বজায় থাকবে। বিরোধীরা যাই করুক না কেন, মূলবৃদ্ধি যেখানেই যাক না কেন, বেকারত্ব যত বাড়ুক না কেন, অর্থনীতি যে তলানিতেই ঠেকুক না কেন বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। সেই জন্যই তারা দলীয় কর্মসূচিতে, সরকারি স্তরে, বিভিন্ন বিল এবং সরকারি পদক্ষেপে, বিভিন্ন উগ্র হিন্দু সংগঠনের কর্মসূচির মাধ্যমে এই বিভাজন বিষকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, লক্ষ্য ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা, আর কিচ্ছু নয়। স্যাফ্রন নিয়ে আরও কিছু কথা, আমাদের ভাগওয়া রঙ বা কেশরী হল ডিপ স্যাফ্রন, তার আর জি বি একটু আলাদা, লাল ২৪৪, সবুজ ১৯৬ আর নীল ৯৮, হিসেব করে মেলালেই হয়ে যাবে সেই গাঢ় স্যাফ্রন যাকে এই ধর্মের ঠেকেদারেরা গেরুয়া বলে, তো এই স্যফ্রন রঙটাই বা এল কোথা থেকে? মজার কথা হল সেটাও এসেছে ইরান থেকে, মানে সেই পারস্য, হিন্দিতেও সবুজ কথাটা ব্যবহার করা হয়, সেই সবুজ শব্দটাও কিন্তু ফারসি, আবার সফেদ শব্দটাও ফারসি। মানে কী দাঁড়াল? আআদের জাতীয় পতাকার তিনটে রঙ, সফেদ, যা আসলে কোনও রঙ নয়, রঙ না থাকার ফলে যে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পড়ে তা হল সফেদ, কিন্তু শব্দটা ফারসি। গেরুয়া বা ডিপ স্যাফ্রন, যে স্যাফ্রন রং টাই এসেছে পারস্য থেকে আর সবুজ, শব্দটা ফারসি আর ইসলাম ধর্মের প্রতীক। এই কারণেই যখন আমাদের সংবিধান প্রণেতারা দেশের জাতীয় পতাকার রং বেছে নিলেন, ত্যাগ শান্তি আর অগ্রগতির রং স্যাফ্রন, সফেদ আর সবুজ তখন সব থেকে বিরোধিতা করেছিল এই আর এস এস, এই ছাগলের তৃতীয় সন্তানদের প্রকৃত পথপ্রদর্শক। আর এস এস পত্রিকা অর্গানাইজার-এ স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন আর এস এস এর গুরু গোলওয়ালকর লিখছেন, “The people who have come to power by the kick of fate may give in our hands the Tricolour but it will never be respected and owned by Hindus. The word three is in itself an evil, and a flag having three colours will certainly produce a very bad psychological effect and is injurious to a country.” অর্থাৎ যারা ভাগ্যের জোরে আজ ক্ষমতায় এসেছে, তারা আমাদের হাতে এই ত্রিবর্ণ পতাকা তুলে দিয়েছে, কিন্তু এই ত্রিবর্ণ পতাকাকে কোনওদিনও কোনও হিন্দু সন্মান করবে না। তিন শব্দটাই অশুভ, আর সেই তিন রং এর পতাকা দেশের ওপর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব ফেলবে, দেশের পক্ষে তা ক্ষতিকর। তো এই গোলওয়ালকরকে নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদি গুরু বলে, সেই মোদিজি ত্রিবর্ণ পতাকা তোলেন দিল্লির লাল কেল্লায়, হিপোক্রেসি কা ভি কোই সীমা হোতী হ্যায়, বলে হাসা ছাড়া আমাদের আপাতত আর কীই বা উপায় আছে বলুন?