দেশের আর বিদেশের বেশ কয়েকটা সমাজ বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা সমীক্ষা করে, জানিয়েছে, আমাদের প্রধান সেবকের জনপ্রিয়তা কমছে। এ ধরণের সমীক্ষা হতেই থাকে, দেশের মধ্যে বা দেশের বাইরের বিরাট বিরাট সংস্থা এধরণের সমীক্ষা করে, বহু টাকা খরচ করে। কেন করে? কারণ দেশ বিদেশের বড়বড় শিল্পপতিদের, বিলিওনিয়ার, ট্রিলিওনিয়ার, বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের এই খবর দরকার, বিশ্ব জুড়ে যে ঘোড় দৌড় হচ্ছে, তার বাজি তো আমি আপনি হরিদাস পাল ধরি না, সে সব ঘোড়াদের হদিস রাখলে রাফাল থেকে বোফর্স বিমানের বরাত পাওয়া যায়, বুলেট ট্রেন বা ভাইরাস ভ্যাক্সিনের টেন্ডার হাতের মুঠোয় থাকে, তাই এসব সমীক্ষা হতে থাকে, কোন ঘোড়া কতদিন টিঁকবে, এই ঘোড়ার পর কোন ঘোড়া আসবে, তার রং কি, সাদা না কালো না বাদামী, তার প্রিয় খাদ্য কি? এ সব কিছুরই হদিশ, সুলুক সন্ধান চলতেই থাকে, আমি আপনি ভাবি আমাদের ভোটে পালটে গেলো সরকার, এরপর সারে জঁহা সে অচ্ছা। সে গুড়ে বালি, ইতিহাস বিজ্ঞান, অঙ্ক, জটিলতর অঙ্ক কষা হচ্ছে অন্য কোনওখানে। সেখানে সব্বাই এক, তারা মিলে মিশে ভাগ বাটোয়ারা করেছে পৃথিবীটাকে, তাদের কারো ভাগ্যে পৃথিবীর ১২ শতাংশ, কারোর ৮, কারোর সাড়ে চার শতাংশ, তারা সেখান থেকে আহরণ করে কোটি কোটি টাকা, তারা বিশ্বের পুঁজির ভাগেদার, মালিক। তাদের জানতে হয় ট্রাম্প বা বলসেনারো বা পুটিন কিম্বা মোদীর আয়ু কতদিন, তাদের জানতে হয়, এরা সরে যাবার পরে কোন খাঞ্জা খাঁ আসছে। যারা আসতে পারে তাদের মধ্যে বেয়াড়া কোনটা, দালাল বা লোভী কোনটা? সেটাও জানতে হয়, ওনারা জানেন। যুগটা এখন লগ্নি পুঁজির, তারা কেবল টাকা লগ্নি করবেন, বদলে মুনাফা চাই। যে পুঁজিপতিরা শিল্প করতো, ইস্পাত, থেকে বস্ত্র, সিমেন্ট থেকে সার, তারা এখন দ্বিতীয় স্তরে, তাদের ওপরে এই লগ্নি পুঁজির মালিকরা জুড়ে বসেছে। তারা চায় এক পৃথিবী, একই চাহিদা, একই শাসন, এক প্রোডাক্ট, এক বাজার। তারা চায় সবটাই চলুক তাদের নির্দেশে।
তো যে কথা বলছিলাম, এই এদের জন্যই সারা বছর সমীক্ষা চলতে থাকে, সেই সমীক্ষা বলছে আমাদের চৌকিদারের, নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা কমছে, অনেকটাই কমেছে।
সেই বার্তা রটি গেছে ক্রমে, এবং তাই শুনে বিরোধীদের ভারি আনন্দ, এবার তাহলে মোদী যুগের অবসান, মোদীর পতন। আজ আলোচনা এই নিয়েই।
ধরুন ইন্দিরা গান্ধী, জরুরি অবস্থা জারি করলেন, সারা দেশ উত্তাল হল, মানুষ প্রতিবাদ করলেন, ১৯৭৭ এ ভোট হল, ইন্দিরা গান্ধী সাফ। কেমন সাফ? হাওড়া থেকে যে ট্রেন দিল্লি যায় সেই রুটের বাঁধারে ডান ধারে কোনও আসন কংগ্রেস পায়নি। ইন্দিরা গান্ধী নিজে হেরেছিলেন, সঞ্জয় গান্ধী হেরেছিল। গোহারান হার। মাত্র ৩ বছর পর ইন্দিরা ফিরে এলেন, বিরোধীদের ছত্রভঙ্গ করে বিরাট জয়। যে নিম্নবিত্ত গরীব সংখ্যালঘু মানুষজন ভদ্র লোকেদের গণতন্ত্র ইত্যাদি কথা শুনে ভোট দিয়েছিল, তাঁরা আবার রিটার্নড টু দ্য প্যাভিলিয়ন। এক্কেবারে উলটো উদাহরণ ধরুন বামফ্রন্ট সরকার, ৩৪ বছর রাজত্বে, সরকার বদলালো, ১০ বছরের মাথায় ফেরা তো দূরস্থান, এই বাংলার লোকসভা, বিধানসভায় শূন্য। রাস্তায় রেড ভলেন্টিয়ার্সরা রয়েছেন, মানুষের সমর্থন নেই। যাঁরা সেদিন বামফ্রন্টকে ভোট দিতেন, তাদের এক বিশাল অংশ ২০১১ তৃণমূলকে ভোট দিল। ইউপিএ দুই, দুর্নীতি, অকর্মণ্য, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা সরকার, হেরে গেলো ২০১৪ তে, এখনও পর্যন্ত এতটুকু রিভাইভালের সঙ্কেত নেই, ইঙ্গিত নেই। কংগ্রেস এমনকি কেরলও হেরেছে।
এই জনপ্রিয়তা হয় কোথা থেকে? কিভাবে তার ক্ষয় হয়, কি ভাবে তা ফিরে আসে? আসলে জনপ্রিয়তা হল আজকের দুনিয়ায় সেলস আর মার্কেটিং ম্যানেজারদের ভাষায় ব্র্যান্ড ভ্যালু। কংগ্রেস একটা ব্র্যান্ড, রাহুল আর একটা ব্র্যান্ড। মোদী একটা ব্র্যান্ড, বিজেপি একটা ব্র্যান্ড। বুদ্ধ ভট্টাচার্য একটা ব্র্যান্ড আবার সিপিএম একটা ব্র্যান্ড। মমতা একটা ব্র্যান্ড, তৃণমূল আর একটা ব্র্যান্ড। ঠিক এই মুহূর্তে বিজেপি আর তৃণমূলের আলাদা করে ব্র্যান্ড ভ্যালু বড্ড কম, ব্র্যান্ডটা হল মমতা না হলে মোদী। মারুতি না হলে মাহিন্দ্রার মতন। অন্যদিকে বুদ্ধ ভট্টাচার্যের ব্র্যান্ড ভ্যালু শূন্য বা তার কাছাকাছি, তার থেকে বেশি ভ্যালু সিপিএমের আছে। কেরলে আবার হিসেবটা উলটো, সেখানে ব্র্যান্ড পিনারাই বিজয়ন, ব্র্যান্ড সিপিএমকে ছাপিয়ে পার করে গেছে। কংগ্রেসের ব্র্যান্ড ভ্যালু আছে, রাহুল গান্ধীর নেই। তো এই ব্র্যান্ড ভ্যালুর হিসেব তিনটে বৃত্ত দিয়ে করা যায়। প্রথম বৃত্ত হল এই ব্র্যান্এর কোর, মানে এক্কেবারে সলিড লয়ালটি, পূর্ণ বশ্যতাও বলা যায়। চোখের সামনে যদি দেখি সব্বাই চলে গেছে, তনুও আমি মোদীকেই ভোট দেব, মমতাকেই ভোট দেবো, অখিলেশ বা মায়াবতিকেই ভোট দেবো। এই প্রথম বৃত্ত যত বড় হবে, ব্র্যান্ড লয়ালটি তত বেশি। এরপর দ্বিতীয় বৃত্ত, পেরিফেরিয়াল অডিয়েন্স। ভোট দেবো কিন্তু ক্যান্ডিডেট পছন্দ না হলে মোদীর ক্যান্ডিডেটকে না দিয়ে মমতার ক্যান্ডিডেটকেও দিতে পারি। মানে কমিটমেন্ট আছে, কমিটেড নয়। এই অংশও কাজে দেয়। তারপরের বৃত্ত হল এরিয়া অফ ইন্ডিফারেন্স, ঠিক আছে মোদীকেই দেবো কিন্তু যা গরম পড়েছে, থাক আর ভোট দিতে যাবো না, ইচ্ছে করছে না। মমতাকেই দেবো কিন্তু যা খেয়েছি, ঘুম আসছে, এবার থাক। মানে বুঝলেন? ওই মধ্যের বৃত্তটাই খেলা নির্ধারণ করে। মোদী না মমতা, ইলিশ না চিংড়ি, কংগ্রেস না বিজেপি, ফরহ্যান্স না কলগেট, ওই ওরাই নির্ধারণ করে। যতক্ষণ না ওই কোর ভোটাররা বিগড়োচ্ছে, ততক্ষণ আপনি নিশ্চিন্ত, এত বাজনা বাজানোর পর সলিড সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে, মহিলাদের ভোট নিয়ে, ক্লাবের সেই হুল্লোড়বাজদের ভোট নিয়ে মমতা ২১৩। সেই কোর ভোটার বেরিয়ে গেছে, গৃহত্যাগ করেছে বলা যায়, তাই সিপিএম কমতে কমতে শূন্য। কী বলছেন? জেএন ইউ? কী বলছেন টুম্পা সোনা? তাতে সেই ভোটারদের কিচ্ছু যায় আসে না বলেই বামেরা শূন্য। বিজেপির কোর ভোটারে, সারা দেশে হাত পড়েছে? তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু, মোদীজির ব্র্যান্ড ভ্যালু কমছে, বেশ, কিন্তু সেটা কারা? কোন ভোট সরে যাচ্ছে? কেন সরছে? মোদীজর কোর ভোটার হল মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত হিন্দু মানুষজন। তাঁরা দু’হাত তুলে ভোট দিয়েছেন। মধ্য আর উত্তর ভারতে এমন কি গরীব হিন্দু মানুষেরাও মোদীজির কোর ভোটার। বিরাট হিন্দু সমাজ তাঁকে হিন্দু রিভাইভ্লিজমের অন্যতম মুখ মনে করেন। মন্দির ওঁহি বনায়েঙ্গে হল এঁদের শ্লোগান, উগ্র জাতীয়তাবাদ এঁদের অস্ত্র। মোদীজি সেটাকেই উসকে দেন, রামমন্দির হল দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন, ঘরমে ঘুসকর মারেঙ্গে, সার্জিকাল স্ট্রাইক হল মোদীজির অস্ত্র। মোদীজির যে কোনও বিরোধিতাকে এই কোর ভোটাররা দেশের বিরোধীতা বলে মনে করেন, দেশদ্রোহীতা বলেই মনে করেন।
এবার সমস্যা হল মোদীজির এই কোর ভোটার, বিশেষ করে মধ্য ভারত উত্তর ভারত, বিহার, গুজরাট, ইউ পি, এম পি, হরিয়ানা অঞ্চলের বিরাট কোর ভোটারের প্রত্যেকের, প্রত্যেকের কেউ না কেউ করোনায় মারা গেছেন, অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করেছেন, ডাক্তার বিছানা, ওষুধ পাননি। এই বিরাট সমর্থকের দল অবাক হয়ে দেখছে, তাদের মসীহা ব্যস্ত বাংলার ভোট কুড়োতে, তাঁরা দেখেছে তাঁদের দেবতা তাঁদের সঙ্গে নেই। এরসঙ্গে যুক্ত হচ্ছে লকডাউন। গতবার থালা, দিয়া ইত্যাদি অনুষঙ্গ করার সময় ছিল, এবার চারিদিকে মৃত্যু ওসব ঠগবাজির সময় দেয়নি। এই লকডাউনে অর্থনীতি এক প্রবল সমস্যার মুখে। মোদীজিকে এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে, না হলে এই কোর ভোটারেরা ছিটকে যাবে, নিশ্চিত। আর অর্থনীতিবিদরা পরিস্কার বুঝতে পারছেন, মন্দা আসছে, তাকে সামলানোর মত ক্ষমতা এই মুহূর্তে এই সরকারের নেই। ধরুন হিটলারের জার্মানি, তা হিটলারও এই ভাবেই মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত জার্মানদের সমর্থন পেয়েছিলেন, সে সমর্থন বরকরার ছিল, কারণ দেখুন, সাধারণ জার্মানদের সপ্তাহের আয় ১৯৩৩ থেকে ৩৯ এর মধ্যে বেড়েছিল ১৯%, জিডিপি, যা ১৯৩২ এ ছিল শূন্য, তা ১৯৩৯ এ প্রায় ১২, বেকারত্ব কমেছিল দারুণভাবে। হিটলারের সমর্থন বাড়ছিল। তিনি তখন ভগবান, তাঁর নির্দেশে ওই জার্মানরাই খুঁজে দিচ্ছে ইহুদিদের, যাদের কনসেনট্রেসন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হবে। হিটলারের ব্র্যান্ড ভ্যালু কমছে না, কারণ তিনি তাঁর কোর ভোটারদের, সমর্থকদের কাজ দিচ্ছেন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করছেন, শিশুদের মায়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা হচ্ছে।
এই মুহূর্তে আমাদের কী অবস্থা? ঠিক উলটো। মানুষ মরছে, স্রেফ অক্সিজেন, ওষুধের অভাবে, ভ্যাক্সিনেশন কবে হবে তা জানা নেই, কিন্তু জানা আছে যে প্রধানমন্ত্রী, বিদেশে ভ্যাক্সিন দান করেছেন, দেশের অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হয়েছে, তা আরও বাজে চেহারা নেবে। বেকারত্ব বাড়ছে নজিরবিহীন ভাবে। প্রধানমন্ত্রীর ব্র্যান্ড ভ্যালু কমছে, কোর ভোটার সরে যাচ্ছে। মেঘের আড়ালে বসে থাকা সেই কর্তারা, লগ্নি পুঁজির মালিকেরা দেখছেন এই প্রডাক্টের ব্র্যান্ড ভ্যালু কমছে, কতটা কমে গেলে সুতোটা কেটে দয়া হবে, সেটাই দেখার। তবে এটা পরিস্কার যে পতন শুরু হয়েছে, এ পতন থেকে ঘুরে দাঁড়ানো নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদীর নেই। বিসর্জনের বাজনা বাজছে, ক্রমশ সে ঢাকের বোল জোরালো হচ্ছে, কেবল জলে ফেলে দেওয়ার অপেক্ষা।