এভরিথিং ইজ কমোডিটি, এভরিথিং। সবকিছু পণ্য, সবকিছু। যা দেখছেন আপনার আশেপাশে, যা আপনি ব্যবহার করেন, যা আপনার কাজে লাগে তা তো পণ্য। সেগুলো বাদ দিলেও যা প্রচুর ছিল, অঢেল ছিল, নদী-পুকুরের জল, বইতে থাকা বাতাস, দিঘির পাড়ে গাছের ছায়া, গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপ, সূর্য ওঠা এক আকাশ, গোধূলির এক বিকেল আজ সে সবও পণ্য। মায়া, দয়া, ভালবাসা, প্রেম, সম্পর্ক আজ টাকায় ওজন করা যায় সহজেই। হিরো আলমের গান শুনে তার বান্ধবী বলে অপূর্ব, সেই অপূর্ব অনুভবের পেছনে টাকা ভেসে বেড়ায়। রাস্তার মোড়ে হোর্ডিং, জানলার পাশে এক দম্পতি, দূরে সূর্যাস্ত, মাত্র ৫৬ লক্ষ টাকা খরচ করলে আপনার ফ্ল্যাটের জানলা থেকে এমন সূর্যাস্ত দেখতে পাবেন। কেবল ফ্ল্যাট নয়, আপনাকে সূর্যাস্ত বেচে দিল ওরা, কিম্বা দিঘির জলের পাশে টিটো দা, দীপঙ্কর দে, মাথায় বেরে ক্যাপ, মাছ ধরছেন, কেবল আবাসন নয়, বেচনেওয়ালারা জীবন বেচে দিচ্ছে। এটাই পুঁজিবাদ, এটাই ধনতন্ত্র। মার্কস বলেছিলেন, সেখানে এভরিথিং ইজ কমোডিটি, সব কিছুই পণ্য। শান্তিনিকেতনের আবাসনে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ, রবিঠাকুরকে তো রয়্যালটি দিতে হয় না। এটাই ভোগবাদ, কনজিউমারিজম। আজ সেই ভোগবাদের দুটো নির্লজ্জ গল্প শোনাব আপনাদের। ছোটবেলায় গান শুনতাম, মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে। লতা মঙ্গেশকরের গলায় অ্যায় মেরে বতন কে লোগো, জরা আঁখ মে ভর লো পানি, যো শহীদ হুয়ে হ্যায় উনকি, জরা ইয়াদ করো কুরবানি। রামচন্দ্র নারায়ণজি আসল নাম ছিল, লোকে চিনত কবি প্রদীপ বলেই, তিনি লিখেছিলেন, সুর দিয়েছিলেন সি রামচন্দ্র। ঠিক ছিল লতা এবং আশা দুজনে মিলে গাইবেন, ২৬ জানুয়ারি ১৯৬৩ নিউ দিল্লি ন্যাশন্যাল স্টেডিয়ামে গাওয়া হবে, রিহার্সাল আর গানের যন্ত্রানুষঙ্গের দায়িত্বে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা, আশার টিকিট এসে গেছে, আশা ভোঁসলে বললেন আমি গাইব না। হেমন্তের অনুরোধও শুনলেন না, লতা একাই গেলেন, অনুষ্ঠানে উপস্থিত রাষ্ট্রপতি এস রাধাকৃষ্ণন, এবং জওহরলাল নেহরু। নেহরুকে সেই প্রথম প্রকাশ্যে কাঁদতে দেখা গেল, গান্ধীজি মারা যাওয়ার পরে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন, কিন্তু প্রকাশ্যে নয়, এই প্রথম। দেশ স্বাধীন, কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের অসংখ্য শহীদের স্মরণে কত গান, কত কবিতা। সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিরাট অধ্যায় এই বাংলা, বাংলার বিপ্লবীদের অনায়াস মৃত্যু বরণ, জেলযাত্রার সাক্ষী আলিপুর জেল। আলিপুর জেল বাইরে থেকে দেখেছি, সাংবাদিকতার কাজেই ভেতরেও গেছি, অরবিন্দের সেল, নেতাজিকে যেখানে রাখা হয়েছিল, সেই ফাঁসির মঞ্চ। মাঝে মধ্যেই মনে হত এই জায়গা কেন সবাই দেখতে পাবে না? ওই লড়াই এর পীঠস্থান এই আলিপুর জেল, সবার দেখা উচিত। তো কিছুদিন আগে আলিপুর জেলের এই সব জায়গাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে, মিউজিয়াম করা হয়েছে, মানুষ গিয়ে দেখে আসতে পারেন সেই সব জায়গাগুলো, স্মৃতিতে ঝালিয়ে নিতে পারেন সেই সব বলিদান আর আত্মত্যাগের কথা। প্রত্যেক মানুষের যাওয়া উচিত, সেই ইতিহাসকে জানা আজ আরও বেশি জরুরি, কারা লড়েছিল, কারা বিশ্বাসঘাতক সেটা তো জানা উচিত। কোভিডের মাস দুয়েকের লকডাউনে নিজের ঘরেই থেকে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম আমরা, আর আট বাই দশেরর সেলে বছরের পর বছর, মাসের পর মাস কাটিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা, সে ইতিহাস জানা তো উচিত। কাজেই আলিপুর জেলের এক অংশ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া এক বড় কাজ। মানুষ যাচ্ছেন, অতএব সেখানে চা, জলখাবার, দুপুরের খাবারের জন্য ক্যান্টিনও খোলা হল। বিক্রিবাট্টা চালু, ওমনি টুক করে পণ্য হয়ে গেলেন শহীদেরা, পণ্য হল আজাদ হিন্দ ফৌজ, বিনয় বাদল দীনেশ, সিপাহি বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ। ক্যান্টিনে থালির নাম হল আজাদ হিন্দ থালি, বিবিডি নিরামিষ থালি, তিনজন যুবক হাতে ১০/১২ রাউন্ড কার্তুজ, ঢুকে পড়লেন সিংহের ডেরায়, জানেন মৃত্যু নিশ্চিত, তাদের নামে নিরামিষ থালি, মাটন থালির নাম সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুরগি পাবেন আজাদ হিন্দ-এ। মানুষ কিনেছেন, খেয়েছেন। এভরিথিং ইজ কমোডিটি, এভরিথিং। বিনয় বাদল দীনেশ জানতেন, কল্পনাতেও এনেছিলেন, স্বাধীন ভারতবর্ষে তাঁদের নামে নিরামিষ থালি বিক্রি হবে? এ লজ্জা রাখব কোথায়? শেষ খবর আপাতত থালির নাম দেওয়া মেনুকার্ড সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বেশ, এবারে এই সরেস পরিকল্পনার পেছনের মাথাটার নামধাম জানান রাজ্য সরকার, এই অসুস্থ মানুষটিকে চিহ্নিত করা হোক। পরের গল্পে আসি, তার আগে বেশ ক’দিন ধরে খবরের কাগজ আর সংবাদ মাধ্যমের কয়েকটা খবরের দিকে নজর ফেরানো যাক। মাত্র কদিন আগে বলেছিলাম, আবার বলছি, মনে করিয়ে দিচ্ছি। খবরে জানা গেল যে দুই কিশোর খুন হয়েছে তাদের একজনের বাইকের নেশা ছিল। সে বাইক চালাত, বাইকের ব্যাপারের নানান খবর রাখত। সে একটা দামি বাইক কেনার চেষ্টা করছিল, সেটা কেনার জন্য ৫০ হাজার টাকা অ্যাডভান্সও দিয়েছিল। কোথা থেকে সে এই টাকা পেল? তথ্য বলছে সে নাকি অনলাইন গেমের এক উইজার্ড ছিল, নেটে গেম খেলেই সে জমিয়ে ফেলেছিল ৫০ হাজার টাকা। তার বয়স? ১৫/১৬। এবং তার বাবা মা, বাড়ির বড়রা কেউ এই খবর রাখতেন না, খবর ছিল না তাদের কাছে যে তাঁদের আত্মজ অনলাইন গেম উইজার্ড, সে হাত ঘোরালেই টাকা আসে। তার বাবাকে দেখে মাকে দেখে, বাড়ির লোকজন কে দেখে মোটেই বড়লোক মনে হয় নি, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার, কিন্তু তাদের সন্তান একটা দু’ লাখি কি তিন লাখি বাইকে চড়ে হুউউউশ করে উড়ে যেতে চায়, সেই গতির জন্য তার মেধা সে কাজে লাগিয়েছে, একটার পর একটা কঠিন লেভেল পার করেছে, পয়েন্ট জমা হয়েছে তার মোবাইল অ্যাপে, তারপর সে সেটাকে এনক্যাশও করেছে। এও একদিনে হয়নি, কিন্তু তার অভিভাবকেরা কিছুই জানেন না, আর কী কী জানতেন না? আরও কত গোপন ক্ষত ছিল, কত বীভৎস ক্ষয়রোগ বাসা বেঁধেছিল জানা গেল না, জানার আগে সে খুন হয়েছে। ইলামবাজারে যে খুন হল, তার বন্ধুর অনেক টাকা চাই, তারাও কিশোর, একজন পলিটেকনিক পড়ুয়া, একজনের বাবার অনেক টাকা আছে, অতএব তাকে তার বন্ধু নিয়ে বের হল। তারা মদ আর বিরিয়ানি খেল, মদ শেষ, আবার আনা হল, তারপর তাকে খুন করল তার বন্ধু, ফোনে জানাল ৩০ লক্ষ টাকা চাই। ৩০ লক্ষ টাকার জন্য তার ছোটবেলাকার বন্ধুকে খুন করল, অসুখটা কোথায়? এটা কি বিচ্ছিন্ন কোনও ব্যাপার? এই খুনিকে গ্রেপ্তার করে সাজা দিলেই থেমে যাবে এই অপরাধ, কিংবা ধরুন মাত্র ১৩ বছরের কিশোর, বেঙ্গালুরুতে থাকে। আগস্ট মাসের ঘটনা, দেশ যখন আজাদি কা অমৃত উৎসবে মেতে আছে, সেই ১৫ আগস্টে সে গলায় দড়ি দিয়েছে, মা ডাক্তার, বাবা আইটি প্রফেশনাল টের পাননি ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছিল তাদের একমাত্র সন্তানের মাথায়। সে নাকি বন্ধুদের কাছ থেকে ৩০০০ টাকা ধার করেছিল, বন্ধুরা ফেরত চাওয়ায় কিছুদিন স্কুল যাচ্ছিল না, তারপর সে ১৫ তারিখ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে। কেন টাকা ধার নিয়েছিল? সে অনলাইন গেম খেলছিল, হারছিল, কিন্তু জিতবে বলেই আবার খেলছিল, ধার করেই খেলছিল। তার ডাক্তার মা জানে না, তার আইটি প্রফেশনাল বাবাও টের পায়নি। ১৮ বছরের কন্যা, নাম ধরুন বিনীতা, মহারাষ্ট্রের শোলাপুরের বাসিন্দা, বাবা নেই, মা কাজ করেন স্থানীয় পুরসভায়, তার মৃতদেহ আর সুইসাইড নোট পাওয়া গেল রেল লাইনের ধারে। সে তার মায়ের গয়না বিক্রি করে অন লাইন গেম খেলেছে, হেরেছে, শেষ পর্যন্ত নিজেকে শেষ করেছে। আর চিঠিতে বেরিয়ে এসেছে এই অনলাইন গেমের অন্য চেহারা। সে ডিটেল পাওয়া গেল বিনীতার চিঠিতে। সে গেম খেলে হাজার পাঁচেক টাকা জিতেছিল, তারপর সে তার মায়ের গয়না বন্ধক রেখে ৭০ হাজার টাকা নিয়ে গেম খেলতে নামে, সে এক লক্ষ ৩০ হাজার টাকা মতো জিতেছিল। সেই সময় তার অ্যাপ বন্ধ হয়ে যায়, বিনীতা অ্যাপ অথরিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে, তারা জানায় সার্ভার ডাউন, মেরামতির কাজ চলছে। কিছুদিন পরে বিনীতা দেখে ওই অ্যাপ আর কাজই করছে না, যোগাযোগ করলে আর উত্তর আসছে না। এদিকে যে দোকানে সোনার গয়না বন্ধক রেখেছিল, তারা চাপ দিতে থাকে। বিনীতা রেললাইনে মাথা দেয়, আত্মহত্যা করে। বিনীতার স্কুল, কলেজের শিক্ষিকারা জানিয়েছেন বিনীতা অত্যন্ত মেধাবী মেয়ে, বিনয়ী, ভদ্র। কেউ জানেনি কখন অজান্তে সে টাকা রোজগারের জন্য এই শর্টকাট পথ বেছে নিয়েছিল, তার মা তো কিছুই জানতেন না, তিনি জানতেন না যে তাঁর সন্তানের কাছে স্মার্ট ফোনও আছে। সারা দেশ থেকে এই খবর যখন আসছে তখন জানা গেল আমাদের কলকাতায় নাকি এমন একজন আছে, যিনি এই ব্যবসা চালান। তাঁর খাটের তলা থেকে পাওয়া গেল ১৭ কোটি টাকা। মাত্র ১৭ কোটি তো সারা দেশের ব্যবসা হতে পারে না, এর সঙ্গে আরও বড় মাথারা আছে, অনেকে আছে, একটা অ্যাপ নয় অসংখ্য আছে, এবং তারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে, তাদের ধরাও যাবে না, ছোঁয়াও যাবে না। আমাদের সন্তান সন্ততিরা এই বিশ্বজোড়া ফাঁদের সামনে অসহায়, সত্যিই অসহায়। কোনটা খেলা, কোনটা ফাঁদ বোঝার আগেই জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, এই পণ্যবাদের জালে আটকে পড়া কৈশোর, যৌবন। তার চোখের সামনে হুউউশ করে ছুটে চলা ২/৩/৪ লাখি মোটরগাড়ি, বার্বি ডলের মতো সুন্দরী বা ম্যাচো যুবক, মোবাইলের ক্রমশ বাড়তে থাকা ফিচার্স, পাটায়ার রাত, লাস ভেগাসের ক্যাসিনো, নাইট ক্লাবে ডিস্কোথেকের মুভিং লাইটস, সাটারডে নাইট ফিভার তাদের আচ্ছন্ন করছে, মাকড়সার জালের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াচ্ছে। তারপর অচানক সেই কিশোর হয়ে উঠছে খুনি, কিশোরী গলায় দড়ি দিচ্ছে। আমরা শেষ মৃত্যুটা দেখছি, তার আগে ঘটে যাওয়া এক দীর্ঘ ঘটনাবলি আমাদের জানাই নেই। জানাই নেই ব্যারাকপুরের ওই ছেলেটি অনলাইন খেলে কীভাবে টাকা জমিয়েছিল, তার কেনই বা দরকার ছিল একটা দামি বাইক, হাজার ৫০-এ তো বাইক পাওয়াই যেত। না এসব তথ্য মুছে গেছে তার হত্যার সঙ্গে সঙ্গেই। অন্যধারে যে খুন করল, এক পেশাদার খুনির অত খুনের পরিকল্পনা করল, সে এই সাহস পেল কোথা থেকে? কোন বিপন্নতা তাকে দু’ দুটো প্রাণ কেড়ে নিতে উসকে দিল? জানা নেই। যেমন জানা নেই কৈশোরের বন্ধুকে অনায়াসে কেমন করে খুন করল এক কিশোর? যার সঙ্গে মিনিট খানেক আগে সে বসে বিরিয়ানি খেয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর হাওয়ায় ভাসছে, ইথার তরঙ্গে দুলছে, যার উত্তর জানা নেই। বলেছিলাম জানা নেই, আজ বুঝলাম আছে, আমরা দায়ী, আমাদের উদগ্র বাসনা, কামিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে দায়ী। নাহলে এই বাংলার সবথেকে জনপ্রিয় কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন থাকে? পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে এসো জুয়া খেলো, বদলে ৩০/৪০/৫০ লক্ষ টাকা, মৃত্যুর সওদা, সেই বিজ্ঞাপনদাতা পয়সা দিয়েছে, এই খবরের কাগজের মালিক পয়সা পেয়েছেন, ফুরিয়ে গেল। ক’জন কিশোর এই ফাঁদে পড়ে মারা গেল, তা নিয়ে খবর হলে আবার টিআরপি বাড়বে, ক্ষতি কী? এভরিথিং ইজ কমোডিটি, এভরিথিং, কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন।