বরুণদেবের হুমকিকে তুড়ি মেরে দুগ্গাদর্শন বাঙালির। উৎসবের আলোর ফোয়ারা যেন ধূমকেতুর মতো পুচ্ছ নাচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কলকাতার আনাচকানাচে। রাত যত বাড়ছে, মণ্ডপে মণ্ডপে কালো মাথার সারি ততই দীর্ঘ হচ্ছে। দামি সুগন্ধীর গন্ধকে কাবু করে শহরে ম-ম করছে পাটভাঙা নতুন পোশাকের মাদকীয় সুবাস। সারা বছর যে কাউন্টডাউনের প্রহর গোনে বাঙালি, শুক্রবার পঞ্চমীর সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সেই মহোৎসবের রকেটে উত্তর থেকে দক্ষিণে উড়ে বেড়াল শহর।
কলকাতা ঘিঞ্জি শহর, নোংরা শহর, রাজনীতির শহর। বছরভর যে তকমা গায়ে নিয়ে অফিস করেন কেরানিবাবুরা। এদিন দুপুরের পর থেকেই অধিকাংশ দফতর ফাঁকা করে তাঁরাই উঁকি দিলেন বাবুবাগান থেকে যোধপুর পার্ক কিংবা টালা প্রত্যয় থেকে সিমলা ব্যায়াম সমিতিতে। সাতসকালেই ভিআইপি রোডের একধারে দেখা গেল পার্কিং করা গাড়ির ভিড়। ২১১ রুটের বাসে চেপে আটঘরা থেকে আসছিলেন মিত্র পরিবার। ধোপদুরস্ত নতুন পোশাকে যেন সুখী পরিবারের পটচিত্র। বাবা, মা, ছেলে, ছেলের বউ। একগাল নিরীহ হাসি হেসে বললেন, বেলা বাড়লেই ভিড়। তাই সকাল সকাল চলে এলাম।
আরও পড়ুন: Weather Update: যষ্ঠীতে স্বস্তি, সপ্তমী-অষ্টমীতে কপালে ভাঁজ পড়তে পারে! কারণ জেনে নিন
এদিন সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বেজে ওঠে মাইক। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে সদ্য কলেজে পা রাখা তরুণ-তরুণীরা। যেন একঝাঁক রঙিন প্রজাপতি ঘুরে বেড়াচ্ছে মণ্ডপের ফুলে ফুলে। চালতাবাগানের কাছে আমহার্স্ট স্ট্রিটের মুখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল এরকমই একঝাঁক ছেলেমেয়ে। তাদেরই একজন বলল, রাতে সাউথে যাব। তাই সকালে নর্থটা ঘুরে নিচ্ছি। সবেমাত্র বেরিয়েছি। দুপুর পর্যন্ত ঘুরে এক বন্ধুর বাড়িতেই লাঞ্চ। তারপর সন্ধ্যা নাগাদ বেরিয়ে একেবারে রাতে ফিরব।
এদিন সন্ধের ঠিক আগেই মহানগরী জ্বলজ্বল করে উঠল চন্দননগর, মেদিনীপুরের কারিগরদের আলোর কারুকাজে। ফুটপাতের অস্থায়ী খাদ্য-পানীয়ের স্টলে তখনও চলছে শেষ মুহূর্তের সাজসজ্জা। সুরুচি সঙ্ঘের রাস্তার ধারে এক চাউমিন থেকে ফিশফ্রাই, মোমো থেকে বিরিয়ানি বিক্রেতা মনোহর বললেন, প্রতি বছরই দোকান দিই। তবে এবারে আগে আগেই খুলে ফেললাম। যা লোক আসতে শুরু করেছে। চিন্তা একটাই, খবরে বলছে বৃষ্টি হবে। তাহলে অনেক টাকা লস হয়ে যাবে।
ঘড়ির ডায়ালে তখন কাঁটা বলছে ৯টা বাজে। গড়িয়াহাট উড়ালপুল থেকে দেখা গেল, সার সার গাড়ির হেডলাইট ও ব্যাকলাইটের লাল চোখ। অন্যদিকে, শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়াররা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছেন। গোলবাড়ির সামনে তখনও কষা মাংসের দিকে তাকিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন। তার মধ্যেই চোখে পড়ল এক যুবকের কোলে সদ্য পৃথিবীর আলো দেখা এক শিশু মা দুগ্গা ঘুমে এলিয়ে পড়েছে।