প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর ধুমধাম করে পালিত হয় বিজয় দিবস (Vijay Diwas)। ১৩ দিনের যুদ্ধ শেষে ওইদিন বিকেলে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল আমির আবদুল্লা খান নিয়াজি ৯৩ হাজার সেনাসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এস অরোরা ও বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর কাছে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেন (India-Pakistan War 1971)। ৫২ বছর আগের ওই ঘটনা শুধু ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও বিরাট প্রভাব ফেলেছিল।
ঠান্ডাযুদ্ধের ওই পর্বে একদিকে আমেরিকা ও অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের কমিউনিস্ট শাসকদল আড়াআড়ি দুভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। একদিকে আমেরিকার চর সংস্থা সিআইএ, উল্টোদিকে সোভিয়েতের চর সংস্থা কেজিবির স্নায়ুর লড়াই বিশ্বকে যেন বারুদের স্তূপের উপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। অন্যান্য দেশও এই দুই শক্তিগোষ্ঠীর পোঁ ধরেছিল। তার মধ্যে এশীয় অঞ্চলে ‘সমাজতন্ত্রী’ ভারত সোভিয়েতপন্থী বলে আমেরিকা অর্থসাহায্য দিয়ে এবং ভারতকে চাপে রাখতে পাকিস্তানকে তাঁবে নিয়েছিল। তাই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আন্তর্জাতিক শক্তি ভারসাম্যেও প্রভাব ফেলে।
আরও পড়ুন: করোনার নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান, একইদিনে দেশে মৃত্যু ৫ জনের
সেই যুদ্ধের বহুকাল পরে আমেরিকায় ফাঁস হওয়া একটি তথ্যে জানা যায় বেশ কিছু চমকপ্রদ গোপন কথা। একাত্তরের যুদ্ধ বলে বিখ্যাত সেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত কেন সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল? আর কেনই বা মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে বিপর্যস্ত পাকিস্তান আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে ভারতের কাছে হাত তুলে দিয়েছিল? ভারতই বা কেন তার ‘অসম্পূর্ণ গোপন এজেন্ডা’কে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল?
মার্কিন তথ্য বলছে, ভারতের এই গোপন এজেন্ডা থেকে আচমকা সরে আসার অন্যতম কারণ ছিলেন তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিসভার এক সদস্যের বিশ্বাসঘাতকতা, ভাষান্তরে রাষ্ট্রদোহিতা। আমেরিকার চর সংস্থা সিআইএ-র কাছে তিনিই নাকি ইন্দিরার অভিপ্রায় ফাঁস করে দিয়েছিলেন। যদিও এ পর্যন্ত সেই গোপন নায়কটির নাম-পরিচয় প্রকাশ হয়নি।
যাঁর পরিচয় একমাত্র ভারত সরকারই জানতে পারে। তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই আমেরিকা জানতে পারে, ভারত কীসের স্বার্থে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘অপারেশন ত্রিশূল’ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ভারতের তিন বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) একযোগে নেমে পড়ে ইসলামাবাদের যুদ্ধ প্ররোচনার জবাব দিতে। সিআইএ-র কাছে সেই খবর পৌঁছতেই তারা ভারতের বিরুদ্ধে আঙুল তোলে এবং তৎপরতা শুরু হয় যুদ্ধ বন্ধ করার। এই বিশ্বাসঘাতক সিআইএ-র কানে আসল খবর না তুলে দিলে হয়তো ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হতো না। হয়তো আমরা ১৯৪৭ সালে হারানো পাক অধিকৃত কাশ্মীরও ফেরত পেতাম।
নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রথম একটি খবরে আভাস দিয়ে জানায় যে, ভারত সরকারের ভিতর সিআইএ এজেন্ট রয়েছে। একাত্তরের ডিসেম্বরেই ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের দক্ষিণ এশীয় নীতি পরিচালিত হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধীর এক ঘনিষ্ঠের পাঠানো খবরের ভিত্তিতে। ৬ ডিসেম্বর নাটকীয়ভাবে মোড় ঘুরে যায় এই কাহিনির। ওই এজেন্ট ভারতের অভিসন্ধির কথা মার্কিন চর সংস্থার কাছে ফাঁস করে দেন।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শীর্ষ মন্ত্রীদের কাছে বলেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন করাই কেবলমাত্র ভারতের উদ্দেশ্য নয়। পাক অধিকৃত কাশ্মীর ফের ছিনিয়ে আনাও তাঁর লক্ষ্য। পাকিস্তানকে তিনি এমন শিক্ষা দিতে চান, যাতে আর কোনওদিন তারা ভারতের বিরুদ্ধে মাথা না তুলতে পারে। এই কথা নিক্সনের কানে যেতেই তিনি ফুসে ওঠেন। বলেন, এই মহিলা আমাদের সকলকে ধোঁকা দিয়েছেন। কারণ ওয়াশিংটনে ইন্দিরা-নিক্সন বৈঠকে তিনি পাকিস্তান কিংবা পাক অধিকৃত কাশ্মীরে আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
এরপরেই নিক্সন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ না থামলে সোভিয়েত রাশিয়াকে ঘোরতর পরিণতির হুমকি দেন। মার্কিন বিদেশ সচিব রাষ্ট্রসঙ্ঘে নিযুক্ত চীনের স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে গোপনে দেখা করে পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন এবং পদক্ষেপের আর্জি জানান। কিসিঞ্জার ভারতে এসে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও দেখা করেন। এর ফলে সোভিয়েতের মধ্যস্থতায় একটা রফা হয়। ইন্দিরা পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ভারত আক্রমণ করবে না বলে কথা দেন। এনিয়ে নিক্সন বলে বেড়াতে থাকেন যে, তাঁর উদ্যোগেই রাশিয়া কাজ করেছে।
এরও বেশ কয়েক বছর বাদে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই এবং দুই উপ প্রধানমন্ত্রী জগজীবন রাম ও ওয়াই বি চ্যবনকে তৎকালের সিআইএ এজেন্ট বলে অভিযোগ উঠলেও তার কোনও প্রমাণ মেলেনি। এর পিছনে কার হাতযশ ছিল, তার তথ্য না মিললেও একটা বিষয় আজ স্পষ্ট যে, সিআইএ বিশ্বাসযোগ্য সূত্রেই খবর পেয়েছিল বলে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যেই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। তা না হলে, আজ হয়তো ইতিহাস এবং ভূগোলের মানচিত্রটাই অন্যরকম হতো।
অন্য খবর দেখুন