সেই কবে মাও সে তুং বলেছিলেন, কিছু মৃত্যু বালিহাঁসের পালকের চেয়েও হালকা, কিছু মৃত্যু পাহাড়ের চেয়েও ভারী। আর তেমন মৃত্যু যা নাকি পাহাড়ের থেকেও ভারী, তার মুখোমুখি হলেই অজস্র স্মৃতির আগল খুলে যায়। তারা অন্ধকার সিনেমা হলে প্রোজেক্টরের মুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসা ছবির মতো নেমে আসতে থাকে। সেই মানুষটার গল্প, সেই মানুষটার চেহারা, সেই মানুষটার ব্যবহার, সেই মানুষটার শিরদাঁড়ার গল্প মনে পড়ে। স্মৃতি বয়ে যায়, মানুষটা তো ততক্ষণে মিশে গেছে ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোমে। সাংবাদিক দেবাশিস ভট্টাচার্য মারা গেলেন, এখন সমস্যা হল বাংলা বাজারে দেবাশিস নাম বড্ড কমন, কেন? না রবি ঠাকুরের গল্প উপন্যাসের কোনও নায়ক, না মধ্য পঞ্চাশের কোনও সিনেমার নায়ক, কিন্তু গোটা ২০/২৫ নামের পরেই একজন দেবাশিস এসে হাজির হয়। তো এই বাজারে এমনকী সাংবাদিক মহলেও গোটা তিনেক দেবাশিস ভট্টাচার্য আছেন। কেউ মামা নামে পরিচিত, কেউ ছোট দেবাশিস। আমাদের দেবাশিসদা পরিচিত ছিলেন সিধু জ্যাঠা নামে। জুনিয়র বা সিনিয়র রাজনৈতিক খবরাখবর করেন এমন কোনও সাংবাদিক এই বাংলায় নেই যিনি লিখতে বসে দেবাশিসদাকে ফোন করেননি। এটা আমাদের কাছে একটা শর্টকাট পদ্ধতি ছিল। মনে পড়ছে না, গুগল করতে হবে, তাও পাওয়া যাবে কি না জানা নেই, দেবাশিসদাকে একটা ফোন করে নাও, ফোনে পেয়ে গেলে অমায়িক গলায় বলে দেবেন, ১৯৬৪তে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগের সময় কে কে কোন দিকে ছিলেন, কবে কে কী বলেছিলেন, কোন দিন কে কী বলেছিলেন বা প্রথম যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় কে কে ছিল, দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টে কারা কারা মন্ত্রী হলেন। অনায়াসে এবং নির্ভুল। কংগ্রেস থেকে অকালি দল, ডিএমকে থেকে প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টির এমপি এমএলএ, তাদের নাম ধাম সব এক লপতে বলে ফেলার ক্ষমতা তাঁর ছিল। কিন্তু সেই অর্থে তিনি ছিলেন জুনিয়র মোস্ট সিনিয়র সাংবাদিক, বুঝিয়ে বলি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: না, বিবিসিতে আয়কর অভিযান কলকাতা টিভির রেকর্ড ভাঙতে পারল না
লেখাপড়া শিখতে শিখতেই রাজনীতিতে নামেন, নকশালবাড়ির রাজনীতি, কিন্তু অজস্র প্রশ্ন নিয়ে, আর দশজনের মতো রোমান্টিক বিপ্লবীয়ানা নয়। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝেছিলেন, অনেক ভুল হয়ে যাচ্ছে, নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য এক অন্ধ কানাগলিতে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, এ কথা তিনি নিজেই বলতেন, কিন্তু বোমা পিস্তল নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এর মধ্যেই পুলিশের খাতায় নাম উঠেছে, পালিয়ে বেড়ানো শুরু এবং কিছুদিনের মধ্যেই ধরাও পড়ে গেলেন, এই গল্পের এই পর্যায়ে এসেই দেবাশিসদা বলতেন, আসলে গোপন সংগঠন মানেই ষড়যন্ত্র, আর ষড়যন্ত্র প্রথমে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, পরে নিজেদের মধ্যেই, কাজেই সংগঠনের মধ্যেই একে অন্যের শত্রু হয়ে উঠছিলাম। ওই সময়েই ১৯৭২-এ গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি তৈরি হয়, দেবাশিস ভট্টাচার্যর তখনকার ছদ্মনাম শিবাজি ভট্টাচার্য। তো যাই হোক ধরা পড়ার পর জেল হল, দক্ষিণের কুখ্যাত কুড্ডালোর জেল, গরমে মারা পড়ার জোগাড়, তারপর ইন্দিরা গান্ধীর হেরে যাওয়া, জেল থেকে ছাড়া পাওয়া, ঠিক এই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মানুষ ঘরে ফেরে, উনি গেলেন দেশপ্রিয় পার্কে নির্বাচনী জনসভায়, প্রার্থী অশোক মিত্রের সমর্থনে, ওনার পাশে দাঁড়াতে। এরপরে রাজ্যে বামফ্রন্ট কিন্তু বামপন্থী দেবাশিস গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির হাল ধরলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা আসছেন কলকাতায়, অত্যাচারিত মানুষের প্রতিনিধিকে সন্মান জানাতে বিরাট অনুষ্ঠান করছে রাজ্য সরকার, সেদিন গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি রাজ্যে পুলিশ প্রশাসনের হাতে গণতন্ত্র খোয়ানো অত্যাচারিত মানুষদের নিয়ে রাস্তায়, সামনে দেবাশিস ভট্টাচার্য। বাম সরকার ক্ষমতায় আসার আগে বলেছিল যে আমলা পুলিশ প্রশাসন মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে, তার প্রত্যেকটা ঘটনার বিচার হবে। একটা ক্ষেত্রেও হয়নি। কুখ্যাত পুলিশ অফিসার রুণু গুহনিয়োগী প্রোমোশন পেয়েছিলেন। দেবাশিসদা তখন এপিডিআর সম্পাদক, তিনি অর্চনা গুহনিয়োগী মামলায় রুণুর বিরুদ্ধে অর্চনাদিকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করিয়ে বয়ান দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সে মামলা দীর্ঘদিন চলেছিল, তার খরচ খরচাও জোগাড় করেছিল এপিডিআর।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: আড়ালে আবডালে নয়, প্রকাশ্যেই হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি
ওনারই আমলে সারা দেশ থেকে সিভিল লিবার্টিজ মুভমেন্টের নেতারা কলকাতায় আসেন, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে বিরাট সভা হয়। এবং এই সব করার মাঝেই দেবাশিসদা দর্পণ-এ লিখছেন, পরিবর্তনে লিখছেন, এবার সরাসরি সাংবাদিকতার জগতে। তিনি আজকালে ১৯৮৬-র শেষের দিকে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দিলেন, তখন তাঁর বয়স ৪০ পার করে গেছে। তাই তিনিই হলেন এই বাংলায় সবচেয়ে জুনিয়র কিন্তু সিনিয়র সাংবাদিক। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেখানেও তুলকালাম, জ্যোতি বসুর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, কিন্তু প্রশ্ন রেখে ঢেকে নয়, সপাট সরাসরি প্রশ্ন। বাংলার মানুষ বসে থাকত নির্বাচনের ফলাফলের আগে দেবাশিসদার লেখার জন্য, আসন ধরে ধরে বিশ্লেষণ, এবং আগাম বলে দেওয়া কারা জিতছে। সেবার তৃণমূলের বিরাট সম্ভাবনার কথা সব্বাই বলে যাচ্ছেন, ২০০৬। দেবাশিসদা বলেছিলেন, এবারেও বামফ্রন্ট। অনায়াসে এসেছিল বামেরা, তৈরি হয়েছিল সপ্তম বাম সরকার। এল ২০১১, আমাদের এই কলকাতা টিভিতে বসেই নির্বাচনী অনুষ্ঠানে আসন ধরে ধরে দেবাশিসদা এবং আমাদের টিম জানিয়েছিল, তৃণমূল বিরাট গরিষ্ঠতা নিয়ে আসছে, দেবশিসদা জোর দিয়ে বলেছিলেন, যাদবপুরে সিপিএম হারছে, মানে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর আসন হারাচ্ছেন। সিপিএম-এর এক যুব নেতা মন্তব্য করেছিলেন, মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার। পরের দিন গণনার ফল সব্বাই জানেন।
দেবাশিসদা বিভিন্ন সময়ে সরকারে থাকা মন্ত্রীসান্ত্রীদের অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়েছেন, কেউ শ্রদ্ধা করতেন, কেউ কাজে লাগাতে চাইতেন, কেউ সমীহ করতেন। কিন্তু এই বাজারে যখন সাংবাদিকদের শিরদাঁড়া লোটে মাছের থেকেও কম দামে বিকিয়ে যায়, সেই বাজারে ব্যক্তিগত সততায় আঁচ লাগতে দেননি দেবাশিস ভট্টাচার্য। সেই সব ধান্দাবাজ সাংবাদিকদের সামনে ঝলঝলে প্যান্ট আর অবিন্যস্ত জামা গায়ে দেবাশিসদা বসতেন যখন, দেখেছি বার বার তিনিই মধ্যমণি, তিনিই বলছেন অন্যরা শুনছে। এরই মধ্যে কোন সবজিওলার ছেলেটার স্কুলের ফিজ দরকার, কোন কাজের মাসির মেয়ের বিয়ে, সাতসকালে তার খোঁজ নিয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা করার দায়ও তাঁর ছিল। একটা স্বপ্ন ছিল দেবাশিসদার, প্রায়ই বলতেন, আমাদের টর্চ দেখাতে হবে, সরকারকে, প্রশাসনকে, ক্ষমতাশীন দলকে, বিরোধী দলকেও। কেবল সমালোচনা, কেবল ভুল ধরিয়ে দেওয়া নয়, দেখাতে হবে দিশা, বলতে হবে এটা হল রাস্তা। এই মানুষদের পাশে থাকতে হবে সরকারকে, হাতে একটা টর্চ, সামনের অন্ধকারকে চিরে রাস্তা দেখাতে হবে। একটা সময়ে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলেছেন শুধু নয়, উলটো করে দড়িতে ঝুলিয়ে পায়ের চেটোতে লাঠির ঘা মারলে কেমন লাগে তাও বুঝেছেন। তারপর সে রাস্তাকে শুধরে আবার মানুষের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছেন, তৈরি করেছিলেন প্রোগ্রেসিভ পিপলস ফোরাম, নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। শেষমেশ ইচ্ছে ছিল টর্চ দেখানোর। সে ইচ্ছে পূরণ হল কি না জানা নেই কিন্তু এক আস্ত শিরদাঁড়া সমেত সাংবাদিক চলে গেলেন।
এই ক’দিন আগে বিবিসি দফতরে সিবিআই-এর হানা, কপি লিখতে বসেই মনে হল, এই বিবিসিই তো মাঝরাতে দেশের লোককে জানিয়েছিল, ইন্দিরা গান্ধী রায়বেরিলি থেকে হেরে গেছে। ১৯৭৭ মনে আছে, মার্চ মাস মনে আছে, তারিখ ২০ না ২১? এ তথ্য গুগল থেকে বার করা অসম্ভব, অতএব আমাদের মুশকিল-আসান সিধু জ্যাঠা দেবাশিসদা, তার আগের দিনই হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। শুনেই বললেন, ওটা ২০ মার্চ রাত ২টোয়, ২১ মার্চ তো সব কাগজের হেডলাইন। সেদিন বলেছিলেন, ক’দিন যাক, এখন ইনফেকশনের ভয় আছে, তারপর একদিন এসো। সময় দিলেন না, চলে গেলেন, এদিকে ওনাকে নিয়ে লিখতে বসে কিছুতেই মনে পড়ছে না, দেবাশিস ভট্টাচার্য গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির সম্পাদক কবে হয়েছিলেন। ১৯৮০? ১৯৭৯? নাকি ১৯৭৮? সমস্যা হল প্রশ্নটা করব কাকে? আমাদের সিধু জ্যাঠা তো চলেই গেলেন।