বয়স ১৯-এর এদিক ওদিক। ঠিকানা– শম্ভু হালদার লেন, সালকিয়া, হাওড়া। নাম সুমিত সাউ। পড়াশুনো– দশম শ্রেণি। আপাতত দিন গুজরানের জন্য লরির খালাসির কাজ করে সে। রামনবমীর মিছিলের দিনে এক হাতে পাইপগান নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। ছবিও ওঠে। তারপর সে ফেরার হয়। চলে গিয়েছিল বিহারের মুঙ্গেরে, সেখানেই তাদের আদত ঘরবাড়ি। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। বেআইনি অস্ত্র রাখার অভিযোগ, দাঙ্গায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ, শান্তিশৃঙ্খলা ভাঙার অভিযোগ। এবং খুব স্বাভাবিক আরও কিছু অভিযোগ ঠুসে কেস পাকাপোক্ত করেই তাকে কাঠগড়ায় হাজির করা হবে। এ হচ্ছে সেই লক্ষ লক্ষ মোদি-শাহ-শুভেন্দু-দিলীপ-সুকান্ত বা আরএসএস–বিজেপির রিজার্ভ বাহিনীর একজন। তার পারিবারিক দারিদ্র তাকে স্পর্শ করে না, তাদের আপাতত আর্থিক অবস্থা তাকে বিচলিত করে না। তার না পড়তে পারা, স্কুলের গণ্ডিও না অতিক্রম করার কোনও গ্লানি নেই। তার ১৯ বছর বয়সে লরির মাল খালাসে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। সে জানে, তাকে পড়ানো হয়েছে, বচ্চা বচ্চা রাম কা, জনমভূমিকে কাম কা। তাকে শেখানো হয়েছে মুসলমানরা বাবরের সন্তান, তাকে শেখানো হয়েছে তার রামভক্তিকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হলে, রামের শৌর্য বীর্যের উত্তরাধিকারী হতে হলে হাতে পাইপগান নিয়ে জয় শ্রী রাম বলতে হবে। মোদিজির বিকাশ যাত্রার এক অদম্য সেনানী আজ পুলিশ হেফাজতে।
এই মুহূর্তে তৃণমূলের নেতারা তাকে বিজেপি নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে কিছু প্রমাণ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, এই সুমিত সাউ যে আসলে তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠ তা প্রমাণে নেমে পড়েছেন বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব। অর্থাৎ এই নয়া দস্যু বাল্মীকির দায় কেউই নেবে না। তার মা কাঁদবে, তার বাবা বা আত্মীয়রা জমিজিরেত বিক্রি করে উকিলবাবুদের ফিজ জোগাড় করবে। ইতিমধ্যে জেলেই কাটবে তার দিন। এবং এই সময়ে জেলের মধ্যেই যদি কোনও গ্যাংস্টার, কোনও ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের নজরে পড়ে যায়, তাহলে আমরা এক শার্প শুটারের জন্ম দেখব, আমরা আরেক জন কয়লা মাফিয়া, বালি মাফিয়া রাজুকে দেখব। এরাই আজকের রাজনীতির রিজার্ভ ফোর্স, সুমিত সাউ না হয়ে ভোম্বল দাস বা শেখ কাল্লু হতেই পারত, জায়গা বা ঘটনা আলাদা হতেই পারত কিন্তু আদত ছবি এক। সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারী, লকেট চট্টোপাধ্যায় গতকাল রাস্তায় নেমেছেন, প্রেসের কাছে বিবৃতি দিয়েছেন, ধরনায় বসেছেন, বাড়ি গিয়েছেন, খাওয়া দাওয়া করেছেন, ব্যক্তিগত পাহারাদার আছে, নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেছেন। ১৯ বছরের এই ছেলেটি নেতাদের আগুনঝরানো ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে পাইপগান নিয়ে নামার পরে আপাতত থানা হাজতে। আচ্ছা সেই কি কেবল? কেবল সুমিত সাউ? তাও তো নয়। গোটা দেশে শ’ খানেক জায়গা থেকে এই হিংসার খবর আসছে। মূলত বাংলা, বিহার, মহারাষ্ট্র থেকে দাঙ্গার খবর এসেছে। এটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো নয়। এখানে বিরোধী দলের অন্যতম সিপিএম, তাঁদের বক্তব্য তৃণমূল–বিজেপি মিলে দাঙ্গা লাগানোর চক্রান্ত করেছে, মেরুকরণের রাজনীতি চলছে। তাহলে বিহারে কী চলছে? সেখানে মহাগঠবন্ধনের সরকার, আপাতত নীতীশ কুমারও সেই জোটেই আছেন, সেখানেও কি মহাগঠবন্ধন আর বিজেপির বোঝাপড়া? মহারাষ্ট্রে? সেখানে মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ির সঙ্গে বিজেপির বোঝাপড়া? বিরোধিতা করতে হবে বলেই যা খুশি? কুছ ভি? এবং এই অবান্তর বিরোধিতা কাকে অক্সিজেন যোগাচ্ছে? তৃণমূল আঙুল দেখাচ্ছে বিজেপির দিকে, বিজেপি তৃণমূলের দিকে, বাম কং-এর আঙুল তৃণমূল আর বিজেপির দিকে। আর বিশুদ্ধ বুদ্ধিজীবীরা যাঁদের অনেকেই গ্রহরত্নের বিজ্ঞাপনের মুখ তাঁরা নীতি নৈতিকতা নিয়ে এক বিবৃতি জারি করে নিশ্চিন্তে ঘরের পথে। মিডিয়া সারাদিন উত্তেজনা বেচে টিআরপি বাড়িয়ে নিয়েছে। জনতা জনার্দন রামের এই আগ্রাসী ভূমিকা দেখে ঘেঁটে ঘ। আর সুমিত সাউরা উলুখাগড়া হয়ে হাজতে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | দক্ষিণ দুয়োরে কড়ানাড়া এবং মোদিজির ভবিষ্যৎ
এটা কি কেবল রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তীতে? না তাও নয়। আসলে আঙুলটা সামনের দিকে করলে বাকি চারটে আঙুল নিজের দিকেই থাকে, একবার নিজে চেষ্টা করে দেখুন। কাজেই প্রশ্নটা এসে কিন্তু নিজের কাছেই দাঁড়াবে। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করুন তো, আপনার জীবনে সমস্যাটা কী? কোথায়? আপনার ভাই, ছেলেমেয়ের চাকরি নেই, তারা বেকার। একগুচ্ছ টাকা খরচ করে পড়াশুনো করার পরেও তাদের চাকরি জোটে না। এটা সমস্যা না মুসলমানদের জনসংখ্যা বাড়ছে, বা যদি সত্যিই বেড়ে থাকে, সেটা সমস্যা? প্রতিদিন বাজারে গিয়ে জিনিসপত্রের রকেট ঊর্ধ্বগতি দেখে আপনি বেসামাল, আপনি আপনার নাগালের মধ্যে চান সেসব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, নাকি আপনার চাহিদা বিশ্বের সবথেকে বড় মন্দির? কোনটা চাই? আপনি চাইছেন একটা সাধারণভাবে উন্নত জীবনযাত্রা? নাকি আপনার সমস্যা মুসলমানদের তালাক প্রথা নিয়ে? আপনি চাইছেন একটা সুষ্ঠু স্বাস্থ্যব্যবস্থা নাকি কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার বিলোপই আপনার বেশি দরকার? আপনার ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা না হিজাব নিয়ে বিতর্ক, কোনটা আপনার কাছে জরুরি? আজ সেটাই তো আমাদের সামনে প্রশ্ন। কোথাও আমাদের বেঁচে থাকার যাবতীয় জরুরি উপাদানের বদলে কিছু অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়েই কি আমরা বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ছি না? একটা দেশ চলছে, একটা সরকার আছে, প্রতিদিন পেট্রল, গ্যাস থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মধ্যবিত্ত মানুষের নাগালের বাইরে, খুব পরিষ্কার যে সাধারণ মানুষের ঘাম রক্তের পয়সায় থাবা বসাচ্ছে কর্পোরেট শিল্পপতিরা। কৃষকদের আয় তিনগুণ, দ্বিগুণ হওয়া তো বাদই দিলাম, আয় কমে গেছে, অসংখ্য বেকার ছেলেমেয়ের সামনে ঘোলাটে ভবিষ্যৎ। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী এক সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে বিরাট জনপ্রিয়। দেশের শাসকদল একের পর এক রাজ্যে সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাচ্ছে। মানে ওই গুজরাতে কি মানুষ মূল্যবৃদ্ধি টের পাচ্ছে না? ওখানে বেকারত্ব নেই? ওখানে ওষুধের দাম বাড়েনি? নাকি ওখানকার মানুষের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল এই রামনবমী, রাম মন্দির, হিন্দুত্ব?
আসলে কোথাও আমাদের মাথার মধ্যে থাকা কিছু ধারণাকে উসকে দিয়ে এক নতুন ন্যারেটিভ তৈরি করেছে আরএসএস–বিজেপি। এক বেকার ছেলের সামনে এক কল্পনার হিন্দুরাষ্ট্রের গল্প, তার অশিক্ষার সুযোগে তাকে বোঝানো যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমাদের দেশে কিচ্ছু হয়নি, কাজেই একটা বিরাট রামমন্দির তৈরি হচ্ছে, এটা বিরাট ব্যাপার। তার বোধবুদ্ধির ওপরে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজনকে বিশ্ব রাজনীতিতে মোদিজির নেতৃত্ব হিসেবে তুলে ধরা। সে ছবিতে কেবল দেখছে মোদিজি মধ্যিখানে, চারপাশে সাদা চামড়ার সাহেবরা। তার প্রশ্ন, এর আগে এমনটা কি হয়েছে? নাই বা হল আমার চাকরি, জিনিসের দাম কোন আমলেই বা কমেছে, কিন্তু সারা বিশ্বের মানুষ কি আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তাদের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে? তাকে কোন উত্তর দেবেন? কীভাবে বোঝাবেন? এক বয়স্ক মানুষ বলছেন, রামনবমীতে আমরা অস্ত্র হাতে কেন মিছিল করতে পারব না? কেন মুসলমানরা মহরমের মিছিলে অস্ত্র নিয়ে যায়? পারলে চৈতন্যের জন্মদিনেও এরা কামান নিয়ে রাস্তায় বের হবে, এমনই মনে হয়, এবং এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি। যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে ধর্ম যেমন আলো জ্বেলেছে, তেমনই এনেছে অন্ধকার। ধর্ম আর শিক্ষা একসঙ্গে এক নতুন পথ দেখিয়েছে, আর শিক্ষা বিযুক্ত ধর্ম মানুষকে অন্ধকারেই রেখে দিয়েছে। সেই এক সর্বব্যাপী অশিক্ষাকে হাতিয়ার করেই আরএসএস–বিজেপি এই সময়ে মানুষের কাছে এক নতুন ন্যারেটিভ এনে হাজির করেছে। যেখানে মানুষ চাকরি, মাথার ওপরে ছাদ, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের চেয়েও মন্দির, ধর্মকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ঠিক সেই কারণেই এই আরএসএস–বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইটাও খুব সহজ নয়। যুগ যুগ ধরে জমিয়ে রাখা অন্ধকারকে ভেদ করে আলো পৌঁছে দেওয়া খুব কঠিন কাজ। সে কাজ আরও কঠিন হয়ে যায় যখন দেখি একই অশিক্ষা বিরোধীদেরও গ্রাস করেছে, করছে।
আবার ফিরি সুমিত সাউয়ের কথায়। এক ১৯ বছরের ছেলে রাস্তায় মিছিলে চিৎকার করে তার চাকরির দাবি করছে না। তার দাবিতে নেই শিক্ষার কথা, সে জানাচ্ছে না ক্ষোভের সঙ্গে, কেন তাকে পড়াশুনো ছেড়ে দিতে হয়েছে। সে বলছে না তার কম দামে ওষুধ চাই। তার হাতে পাইপগান, সে চিৎকার করছে জয় শ্রীরাম, এরাই আরএসএস–বিজেপির রিজার্ভ বাহিনী। কিন্তু প্রশ্ন হল দেশ তো মোদিজির নেতৃত্বে বিকাশের পথে এগিয়ে চলেছে, তবুও রাস্তায় কেন এই কিশোর যুবকেরা? কীসের দাবিতে?