আগে হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি ওঠেনি? উঠেছে, বিভিন্ন সন্ন্যাসী আখড়া থেকে, তথাকথিত ধর্ম সংসদ থেকে হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি উঠেছে। এখন সেই দাবি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক মহল থেকেও উঠে আসছে, পুরস্কার-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সেলিব্রিটিরাও সেই দাবি তুলছেন। আমরা সব্বাই জানতাম হাততালি না শুরু হলে অনুপ জলোটা স্বর ছাড়তেন না, মোহে লাগিইইইই চলতো ততক্ষণ যতক্ষণ না দর্শকরা হাততালি দেবেন। এই গানের সার্কাস দেখে আপাতত মানুষ ক্লান্ত, দমবাজ অনুপ জলোটা গানের জলসা থেকে রাজনীতির জটলাতে অনায়াসে ঢুকে পড়েছেন, তিনি দাবি করলেন, দেশভাগের সময় মুসলমানরা পাকিস্তানে গেছেন, ইসলামিক রাষ্ট্র হয়েছে, হিন্দুরা এদেশে গরিষ্ঠাংশ, হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া উচিত ছিল। তখন হয়নি, এখন করা হোক, পৃথিবীতে তো হিন্দুদের কোনও দেশ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। উনি কেন বললেন?
উনি এতদিন মানে ওই দমদার সার্কাসে যতদিন হাততালি পড়ছিল, যতদিন বাজার রম রম করে চলছিল, তখন তো বলেননি। এখন বলছেন কারণ উনি একটা কথা ভালো করেই জানেন যে এসব কথা বললে দেশের শাসকরা খুশি হবেন, খুশি হলে উনি পুরস্কার পেতে পারেন, এমপি, এমএলএ-র টিকিট পেতে পারেন, নিদেনপক্ষে একটা শাঁসালো কমিটির মাথায় বসার ছাড়পত্র। তাঁকে দেখে আরও দশজন সেলিব্রিটি উৎসাহ পাবেন, তাঁরাও মাঠে নামবে রাজ অনুগ্রহ পেতে। ক্রমশ সমাজের এক বিরাট অংশ বলতে শুরু করবে, সমস্যাটা কোথায়? হোক না হিন্দু রাষ্ট্র। অন্যধার থেকে প্রধানমন্ত্রী বা ওই ধরনের উচ্চপদে বসে থাকা লোকজন চোখ কান বুজে থাকবেন। কিন্তু স্বাধ্বী ঋতাম্ভরা, বিভিন্ন রাজ্যের এমপি, এমএলএ-দের এক অংশ, যারা কট্টর হিন্দুত্ববাদী বলে চিহ্নিত, তারাও এখন প্রকাশ্যেই হিন্দুরাষ্ট্রের কথা বলছেন, দাবি তুলছেন। সেই তালিকার পুরনো পাপী যোগী আদিত্যনাথ, প্রকাশ্যেই উগ্র হিন্দুত্বের কথা বলেই, তীব্র মুসলমান বিরোধী জিগির তুলেই তিনি জনপ্রিয়, উনি আবার বললেন হিন্দুরাষ্ট্র চাই। সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এনাদের নাপসন্দ। তো আসুন এই হিন্দু আর হিন্দুরাষ্ট্র নিয়ে খানিক আলোচনা করা যাক।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: মেরেছ কলসির কানা, তাই এবার আয়কর হানা
চলতি কথাগুলো একবার আউড়ে নেওয়া যাক, হিন্দু হল সনাতন ধর্ম, হিন্দু এক জীবনশৈলী, হিন্দু এক সংস্কৃতি, হিন্দু ধর্ম হল উদার, হিন্দুরাষ্ট্রের আকার বা তার রাষ্ট্রীয় অবয়ব রামরাজ্যের কল্পনায় তৈরি। এদিকে সবাই আমরা জানি যে আমাদের প্রাচীনতম পুঁথি হল বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত। মজার কথা হল এই সমস্ত পুঁথি ও পুরাণের কোথাও, হ্যাঁ জোর দিয়ে বলছি কোথাও হিন্দু কথাটা নেই। মানে রাম যে হিন্দু, সেকথা কিন্তু রামায়ণে নেই। যে পুঁথি ও পুরাণ আমাদের ধর্মের, হিন্দু ধর্মের ভিত্তি, তার নামই নেই কোনওখানে। কেউ একজন গবেষণা করে বলার চেষ্টা করেছিলেন হিন্দু শব্দ বিষ্ণুপুরাণে পাওয়া গেছে, তো দেখা গেল সেটিও প্রক্ষিপ্ত, মানে বহু পরে তা যোগ করা হয়েছে। এমনটা কেন হল? বাইবেল, জেন্দ আবেস্তা, ত্রিপিটক, গুরু গ্রন্থসাহিব বা কোরানে তো এমন হয়নি। সেখানে তো ধর্মের নাম এসেছে, তাহলে হিন্দু ধর্মে বা সনাতন ধর্মের রিলিজিয়াস স্ক্রিপচার, ধর্মীয় পুস্তকে কেন তা আসেনি? তার কারণ হল হিন্দু আদতে কোনও ধর্মই নয়, তাহলে কি সংস্কৃতি? বা জীবনশৈলী, যেমনটা যোগী আদিত্যনাথ বা গোলওয়ালকর বলার চেষ্টা করেন, মোহন ভাগবত বলে থাকেন? তাও নয়, যদি তাই হত তাহলেও বেদ পুরাণে এই সংস্কৃতি বা এই জীবনশৈলীর কথা থাকত, তা তো নেই। আর প্রচলিত অর্থে হিন্দু বলতে তো কোনও একটা ধর্ম বা একটা সংস্কৃতি বা একটা জীবনশৈলীও হওয়া সম্ভব নয় কারণ এর বৈচিত্র।
কোনটা হিন্দু জীবনশৈলী? নিরামিষ খাওয়া না মাছ খাওয়া, না বলির মাংস খাওয়া? পুজোর মন্ত্র না থাকা কেবল নামগান করতে থাকা চৈতন্যের সংস্কৃতি না তান্ত্রিক অঘোরীবাবাদের শশ্মানে মৃতদেহ পুজো, ওঁ হ্রিং ক্রিং ফট-এর সংস্কৃতি? হিন্দু কি একটা ধর্ম? তাহলে একই ধর্মে আস্তিক আর নাস্তিকরা একইভাবে থাকে কী করে? একই ভাবে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণবরা থাকে কী করে? এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে জিভের মধ্যে, আমাদের স্বরযন্ত্রের মধ্যে। সুদূর ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া থেকে যে মানুষজন আমাদের ভূখণ্ডে আসতেন, তাঁদের স্বরযন্ত্রে দন্ত্য স উচ্চারণে বেশ জড়তা ছিল, তাঁরা দন্ত্য স-কে হ উচ্চারণ করতেন, কাজেই সিন্ধু পারের বাসিন্দাদের তারা হিন্দি, বা হিন্দু বলা শুরু করলেন। ওদিকে ইউরোপ বা সেই অর্থে পশ্চিম থেকে আসা মানুষ জনের সমস্যা হ নিয়ে, তারা হি কে ই আর দ কে ড উচ্চারণ করেন, যার ফলে সিন্ধু বা সিন্ধ হল ইন্ডু বা ইন্ডি। পশ্চিমারা বহু পরে এসেছেন, তার আগেই মধ্য এশিয়া থেকে আসা শক, হুন, তাতার, ইরাক বা ইরান থেকে আসা ব্যবসায়ীরা সিন্ধু উপত্যকার প্রত্যেককেই হিন্দু বা হিন্দি বলতে থাকেন। এ ভূখণ্ডের মানুষ, সে তাঁরা যাই হোক না কেন পরিচিত হতে থাকেন হিন্দি বা হিন্দু থেকে। ইকবালের কবিতাটা মনে করুন, হিন্দি হ্যায় হম, হিন্দি হ্যায় হম, বতন হ্যায় হিন্দোস্থান হমারা হমারা, সারে জঁহা সে আচ্ছা। ইকবাল তো এক আধুনিক কবি, তার বহু বহু আগে এই ভূখণ্ড থেকে যাঁরা হজ করতে যেতেন, সেই মুসলমানদের সৌদি মানুষজন হিন্দি বলতেন, মানে হিন্দুস্থানের বাসিন্দা। যে হিন্দুস্থান মোটামুটি অসম থেকে লাহোর করাচি, বালুচিস্তান হয়ে কারাকোরামের পথ ধরে আফগানিস্তান ছুঁয়েছে, এধারে কাশ্মীরের দক্ষিণভাগ থেকে দাক্ষিণাত্যের সীমারেখা পর্যন্ত। না, তার তলায় যায়নি, আর সেই কারণেই দ্রাবিড় অঞ্চলে তথাকথিত হিন্দু অবস্থান নেই, ছিলও না।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: গো হাগ ডে, নির্দেশ এবং নির্দেশ ফেরত
জওহরলাল নেহরু লিখছেন, ‘আমাদের প্রাচীন ধর্মীয় সাহিত্যে তো ‘হিন্দু’ শব্দটি পাওয়া যায় না। আমাকে বলা হয়েছে যে, এই শব্দটি খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের হিন্দুস্তানি এক তান্ত্রিক গ্রন্থে পাওয়া যায়। সেখানে হিন্দু দ্বারা নির্দিষ্ট কোনও ধর্ম নয় বরং নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে বোঝানো হয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট যে এই শব্দটি অনেক পুরনো এবং এটি আবেস্তা (জরথ্রুস্ট বা পারসিকদের ধর্মীয় গ্রন্থ) ও প্রাচীন ফার্সিতেও পাওয়া যায়। মানে হল এক ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে মানুষদের হিন্দু বা হিন্দি বলা হত। তাহলে হিন্দুরাষ্ট্র ব্যাপারটা কী? আজ আমাদের দেশের সীমা কমবেশি নির্দিষ্ট, দেশের সংবিধান আছে, সংবিধানে দেশের নাম ভারতবর্ষ না ইন্ডিয়া, এক সাংবিধানিক গণতন্ত্র লাগু আছে। এরমধ্যে এই হিন্দুরাষ্ট্র বস্তুটির অবস্থান কোথায়? তার দরকারটাই বা কী? তা হলেই বা নতুন কী হবে? এই আমোদগেঁড়ে সেলিব্রিটি, কঙ্গনা রানাওয়ত বা অনুপ জলোটাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, বেশ তো কাল থেকে আমাদের দেশ হিন্দুরাষ্ট্র না হয় হল, তো তার জন্য কী কী করতে হবে? কোথায় কী বদলাতে হবে? আর এটা হলে সাধারণ মানুষের কোন লাভ হবে? ১০০ শতাংশ শিওর যে এর একটারও জবাব ওনাদের কাছে নেই।
এদের বাদ দিন, আদিত্যনাথ যোগী বা হিমন্ত বিশ্বশর্মা বা স্বাধ্বী ঋতাম্ভরারা কেন বলছেন? আদত সমস্যাটা এখানেই, তাঁরাও জানেন, হিন্দুরাষ্ট্র ইত্যাদি এক আদ্যন্ত মিথ্যে কিন্তু তাঁরা এটা বলতে থাকেন দেশের সংখ্যালঘুদের উত্যক্ত করার জন্য, ভয় দেখানোর জন্য। এক রাষ্ট্রের চিন্তা তাঁদের মাথায় আছে যেখানে সংখ্যালঘুরা হবেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, যেখানে তাঁদের মৌলিক অধিকারও কেড়ে নেওয়া হবে। আর আপাতত এই জিগিরের ফলে হিন্দু মুসলমানে এক তীব্র মেরুকরণ হবে আর সেই মেরুকরণের রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে আরএসএস-বিজেপি মসনদে থেকেই যাবে চিরটাকাল। যদি এই হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনা আজকের আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সরকারই হয়, তাহলে আলাদা করে হিন্দুরাষ্ট্রের তো কোনও দরকার পড়ত না। আসলে আরএসএস-এর দলিলে তাদের সরসংঘচালকরা খুব পরিষ্কার বলে গেছেন, এই দেশের নাগরিক তাঁরাই যাদের পিতৃভূমি, কর্মভূমি কেবল নয়, পূণ্যভূমিও হতে হবে এই দেশ। কাজেই মক্কা যাবে হজ করতে, জেরুজালেম বা ভ্যাটিকানে আস্থা থাকবে যাদের তাঁরা দেশের নাগরিক নয়, এটাই হিন্দুরাষ্ট্রের চেহারা। হিন্দুধর্মের নির্দিষ্ট কোন ধর্মগ্রন্থ নেই, একজন নির্দিষ্ট ধর্মগুরু নেই, আর নেই কোন বুনিয়াদি বিশ্বাস। এ ধর্মের ধর্মীয় নিয়ম-কানুনে অসংখ্য মতানৈক্য ও পরস্পর বিরোধিতা ছিল, আছে। এক ঈশ্বরের পূজারীও হিন্দু, আবার ৩৩ কোটি দেব-দেবীর পূজারীও হিন্দু। যে মূর্তিপূজা করে সেও হিন্দু, আবার সনাতনী ও আর্যসমাজ যারা তার বিরোধিতা করে সেও হিন্দু।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: রাজ্যপাল নিয়োগ, বিতর্ক এবং মোদিজির ঘোলাটে অবস্থান
যারা আমিষ খায় তারাও হিন্দু, যারা নিরামিষ খায় তারাও হিন্দু। এক ঈশ্বরকে যারা মানে তারাও হিন্দু, আবার ২৪ অবতারকে পুজো যারা করে তারাও হিন্দু। পুরাণ, মহাভারত, গীতা ও রামায়ণকে মানলেও হিন্দু, আবার এগুলোতে বিশ্বাস না রাখলেও হিন্দু।
আস্তিক তথা স্রষ্টায় বিশ্বাস করলেও হিন্দু, আবার নাস্তিক তথা স্রষ্টায় বিশ্বাস না করলেও হিন্দু। এভাবেই আস্তিক গ্রন্থ বেদ, উপনিষদ ইত্যাদিতে বিশ্বাসীও হিন্দু আবার নাস্তিক গ্রন্থ ‘মীমাংসা’তে বিশ্বাসীও হিন্দু। মন্দিরে যে সটান, নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ে সেও হিন্দু, আবার মন্দির থেকে মেরে যে শূদ্র, অচ্ছুৎদের মেরে বের করে দেয় তারাও হিন্দু। রাম ও সীতাকে যারা পুজো করে তারাও হিন্দু, আবার তামিলনাড়ু সহ দাক্ষিণাত্যে যারা রাবণের পুজো করে তারাও হিন্দু।
অহিংসাই পরম ধর্ম তথা দয়া-মায়াই পরম ধর্ম- এমন স্লোগান দিয়ে জীবজন্তু হত্যাকে ঘৃণাকারীও হিন্দু, আবার কালীমন্দির, যোগসমূহে, দুর্গাপুজো ইত্যাদিতে ছাগল, মোষ বলি যারা দেয় তারাও হিন্দু। পীতাম্বর অর্থাৎ হলুদ কাপড় পরা সাধুরাও হিন্দু আবার স্বভাবজাত উলঙ্গ থাকা নাগা সাধুরাও হিন্দু। অবতারবাদে ঘোর বিশ্বাসীরাও হিন্দু, আবার অবতারবাদকে নাকচকারীরাও হিন্দু। গরু, মাছ, নিমগাছ, বট, নানা ধরনের গাছ, সাপ ইঁদুর প্যাঁচা ইত্যাদির পূজারীও হিন্দু, আবার এগুলোকে হত্যাকারী-নষ্টকারীও হিন্দু। পিঁয়াজ, রসুন না খাওয়া লোকরাও হিন্দু আবার চূড়ান্ত ঘৃণিত সাপ, কুকুর, শূকর, বানর ইত্যাদি যারা ভক্ষণ করে তারাও হিন্দু।
সম্ভবত একারণেই পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু লিখেছেন, হিন্দুধর্ম একটি ধর্ম হিসাবে অত্যন্ত অস্পষ্ট। এর কোনও সুনির্দিষ্ট আকার-আকৃতি নেই। এর নানা দিক আছে এবং এটি এমন যে, যে যেভাবে চায় সেভাবেই বিশ্বাস করতে পারে। এর সংজ্ঞা দেওয়া বা এর সুনির্দিষ্ট কোনও রূপ উপস্থাপন করতে গেলে এতটুকুই বলা যাবে যে, সাধারণ বুদ্ধি অনুযায়ী এটি একটি ধর্ম। এর বর্তমান রূপে বরং এর প্রাচীন রূপেও নানা অভিনব বিশ্বাস ও রীতি-নীতি এসে মিলিত হয়েছে। উচ্চ থেকে উচ্চতর বা নিম্ন থেকে নিম্নতর এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ধর্মে স্ববিরোধিতা ও মতানৈক্য চোখে পড়ে। এই ধর্মের বিশেষ উদ্দেশ্য ও চিন্তাধারা হল নিজে ভালোভাবে বেঁচে থাকো এবং অন্যকেও বাঁচতে দাও। এই গেরুয়া গুন্ডাদের দলকে সেটা কে বোঝাবে?