চন্দ্রযান–২ সফল হয়নি, কিন্তু যেখানে নামার কথা ছিল, সেই ক্র্যাশ স্পটের নাম দেওয়া হল তিরঙ্গা। আর চন্দ্রযান–৩ সফল, যেখানে তার সফট ল্যান্ডিং হল, তার নাম শিবশক্তি। প্রায়োরিটি ইজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। দেশ, তিরঙ্গা, সংবিধান, বিজ্ঞান কোনওটাই মোদি-শাহ, আরএসএস–বিজেপির প্রায়োরিটি নয়, প্রায়োরিটি লিস্টে এসব নেই। সেখানে তাঁদের হিন্দু ধর্ম, রাশি রাশি কুসংস্কার, ঘৃণা, মনু সংহিতা, গোলওয়ালকরের বাঞ্চ অফ থট আছে, এক মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা আছে, অনর্গল মিথ্যে আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেরকম এক দল, এক দর্শন আজ ভারতবর্ষের ক্ষমতায়, সমর্থনের সংখ্যায় এখনও গরিষ্ঠ নয়, এখনও বিজেপি মাত্র ৩৭.৩৬ শতাংশ। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নানান কোন্দল, নানান মতানৈক্যের ফলেই তারা ক্ষমতায়। যেখানে এই বিবদমান বিরোধী দলগুলোর খুব সামান্য অংশই বুঝতে পারছে যে কতবড় বিপদ নেমে আসতে চলেছে আমাদের দেশের ওপর। সে সেসব কথা আরেকদিন হবে, আজ কথা চন্দ্রযান, বিজ্ঞান আর কুসংস্কার নিয়ে। বিজ্ঞানের মজা হল অনন্তের খোঁজ, শেষ নেই। অন্যদিকে অহং ব্রহ্মাস্মি, ব্যস, শেষ কথা। আমিই ব্রহ্ম। মামেকম শরণম ব্রজ। আমাকেই চিন্তা করিও, ব্যস, শেষ কথা। বিজ্ঞানে এমন কিছুই নেই। ভাবুন না, থমাস আলভা এডিসন বাল্ব আবিষ্কার করেছিলেন, শূন্য থেকে? না, তাঁর আগে বেশ কিছু বাল্ব আবিষ্কার হয়েছে, কিন্তু সেগুলো কোনওটা মিনিটখানেক, কোনওটা বড়জোর আধ ঘণ্টা, তিনি দীর্ঘস্থায়ী বাল্ব আবিষ্কার করলেন, কতটা দীর্ঘস্থায়ী? তিন থেকে চার মাস। আর আজ সেই বাল্ব, ইনক্যানডিসেন্ট বাল্ব থেকে ফ্লুরোসেন্ট হয়ে হ্যালোজেন হয়ে এলইডি বাল্ব। ওয়ারেন্টিই দিচ্ছে দু’ বছর, মানে খারাপ হলে ফেরত।
এটাই বিজ্ঞান। ক্রমশঃ উন্নত হয়। আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন নেই? আছে, তা নিয়ে চর্চা করার বহু বিষয় আছে, ব্যাখ্যা বিভিন্ন থাকলেও বিভিন্ন দর্শনের গভীরতা আছে। কিন্তু আর যাই হোক তা বিজ্ঞান নয়। মূলত একটা প্রধান কারণে, আধ্যাত্মিকতার জগতে সব কিছুই ডিফাইন্ড, সব জানা আছে। ধরুন কে পৃথিবী সৃষ্টি করিল? এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে একজন খ্রিস্টান বলবে গড, একজন মুসলমান বলবেন আল্লাহ, একজন হিন্দু বলবে ব্রহ্মা, ইশ্বর। একজন বিজ্ঞানী বলবেন, পুরোটা জানি না, তবে বিষয়টা সম্ভবত এইরকম, আমাদের গবেষণা বলছে এইরকম হতে পারে, আমরা মহাজগতের বিভিন্ন গবেষণা থেকে এইটুকু জেনেছি ইত্যাদি। মানে এতটুকু জানা গেছে, আরও জানার চেষ্টা চলছে। হ্যাঁ, এটাই তফাত। আর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম? সে তো আরও কঠিন, সে তো আরও রিজিড, আরও নিশ্চিত, সব কিছু নিয়েই নিশ্চিত। সেখানে প্রত্যেকটি গ্রহ ভগবান কেবল নয়, সেসব ভগবানের আবার রকমফেরও আছে, বৃহস্পতি জ্ঞান আর শনি তো আপনারা জানেনই, তাকালেই ভস্ম। সেখানে রাহু কেতুওও আছে। একটা সময় ছিল যখন বিজ্ঞান ছিল কিছু মানুষের বিষয়, কতিপয় শিক্ষিত মানুষের বিষয়, তখন এই ধর্ম, পুরোহিত ইত্যাদির এক গোল্ডেন পিরিয়ড। রাজার আড়ালে থেকে পুরোহিতরা দেশ চালাচ্ছে, তারা যা বলছে তাই ধর্ম, তাই সত্যি। তাঁরাই কখনও বলেছেন যজ্ঞে গোবৎস আহূতি দিতে হবে, কখনও গো সংরক্ষণের কথা বলেছেন। তাঁদের যখন যা মনে হয়েছে, যখন যা দরকার হয়েছে, তখন তাই বলেছেন বলেই আদতে একটাই পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে এতরকম ভিন্ন মতামত, ভিন্ন পথ, ভিন্ন রীতি নীতি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, অহিংসা, সংবিধানের কথা মোদি–শাহের মুখে বেমানান
আর বিজ্ঞানে, এ প্লাস বি হোল স্কোয়্যারে মোদিজির একস্ট্রা টুএবি কোথা থেকে এল বা তা যে আদৌ এক্সট্রা নয় তা গঙ্গারামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই যেভাবে ব্যাখ্যা করবেন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তার থেকে আলাদা কিছু বলবেন না, কামচাটকা বা নিকারাগুয়ার ছাত্ররাও ওই একই কথা বলবে। আর ধরুন তা পরিবর্তন হল, অন্য কোনও আবিষ্কার এসে ওই এক্সট্রা টুএবি-র নতুন কোনও ব্যাখ্যা দিল, তাহলে তা স্বীকৃতি পাওয়ার পরে সর্বত্র সেটাই বলা হবে, আগের ভুলটা স্বীকার করা হবে। কিন্তু বিজ্ঞান যত সর্বজনীন হয়েছে, যত সাধারণের কাছে নেমে এসেছে, তত ধর্ম, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকেও নিজের অবস্থান বদলাতে হয়েছে, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করেছেন, যা আদতে বিজ্ঞানের নামেই আরেক ধরনের মিথ্যাচার। এ হল বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা। কীভাবে? আমার ঠাকুরদা, তাঁর ঠাকুরদা শুনে এসেছিলেন, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ আসলে রাহু আর কেতু নামে দুই রাক্ষসের খেলা, ওই সময়ে খেতে নেই। কেন খেতে নেই? না আজ থেকে ১০০ বছর আগে তার কোনও ব্যাখ্যা ছিল না। কিন্তু ওই যে বিজ্ঞান ক্রমশ ছড়াচ্ছে, ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ানো হচ্ছে চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণের বিজ্ঞান, বোঝানো হচ্ছে এসব হল ছায়াবাজি, এক সরলরেখায় সূর্য পৃথিবী আর চাঁদ থাকলে পৃথিবীর ছায়া পড়বে চাঁদে, চাঁদ যেহেতু সূর্যের আলোয় আলোকিত, তাই অন্ধকার হলে চাঁদকে দেখা যাবে না। সেরকমই পৃথিবী, চাঁদ আর সূর্য এক সরলরেখায় গিয়ে পৌঁছলে সূর্যে পড়বে ছায়া, সূর্যগ্রহণ হবে ইত্যাদি। এবার এই বিজ্ঞান ছড়িয়ে যাওয়ার পরে নতুন ব্যাখ্যা এল, ছায়ায় জন্ম নেয় লক্ষ কোটি ব্যাক্টিরিয়া, সেগুলো খাবারের দিকেই হামলা চালায়, অতএব ব্যাক্টিরিয়ার হাত থেকে বাঁচতে সূর্যগ্রহণের সময় নো মিল, বুঝেছ বাবা, সায়েন্সেও প্রমাণিত। না, এরকম কোনও প্রমাণ নেই যে ছায়াতেই ব্যাক্টিরিয়া বেড়ে উঠবে, তাও আবার কেবলমাত্র সূর্যের উপর ছায়া, বা চাঁদের উপর ছায়াতে পৃথিবীর ব্যাক্টিরিয়া কেন বাড়বে? কীভাবে বাড়বে? তার কোনও ব্যাখ্যাও নেই, প্রমাণও নেই। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে ধর্মের এই কুসংস্কারগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এখন বিজ্ঞানের সাহায্য নিচ্ছে, তাকে নিতে হচ্ছে। যেখানে যে দেশে, যে সমাজে বিজ্ঞান যত ছড়াচ্ছে, যত গভীরে যাচ্ছে, সেখানে এসব ভুলভাল কথাবার্তা ততটাই হাস্যকর হয়ে উঠছে। মানুষ বিশ্বাস করছে না, যেখানে অশিক্ষা বেশি, সেখানে তা জন্ম নিচ্ছে, বাড়ছে।
এবারে আবার চন্দ্রযান প্রসঙ্গে আসি, সফল অভিযানের পরেই ভাইরাল হয়েছে ইসরো প্রধান এস সোমনাথের সস্ত্রীক তিরুপতিতে পুজো দেওয়ার ছবি। দেকেচ? হুঁ হুঁ বাওয়া, অমন যে অমন ইসরোর চেয়ারম্যান যিনি নিজে একজন স্পেস সায়েন্টিস্ট, তিনি ভগবানে বিশ্বাস করেন। তো? তাতে কী এসে যায়? একজন সাধারণ মানুষের ইশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসে কীই বা আসে যায়? কিন্তু তিনি তো সাধারণ নন, তিনি একজন স্পেস সায়েন্টিস্ট। তো সেই এস সোমনাথকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি নিয়ে। তিনি খুব পরিষ্কার বলেছেন, আমি এক্সপ্লোরার, আমি চাঁদ নিয়েও যেমন অনুসন্ধান করি, তেমনই ইনার স্পেস নিয়েও অনুসন্ধান করি। এই মহাবিশ্বে আমাদের অস্তিত্ব ও সফরের অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। খেয়াল করে দেখুন উনি কিন্তু পরিষ্কার বলছেন অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। অর্থাৎ অর্থ তাঁর জানা নেই, তিনি খোঁজার চেষ্টা করছেন, এটাই তো বিজ্ঞান। বিক্রম সারাভাই তো জৈন ছিলেন, যে ধর্ম ইশ্বরের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না। হোমি জাহাঙ্গির ভাবা, ইশ্বর নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না, এই পার্সি বৈজ্ঞানিক ধর্ম নিয়ে প্রায় কিছুই বলে যাননি। সি ভি রমণ সংশয়বাদী ছিলেন, তিনি, গান্ধীজি এবং জার্মান জুওলজিস্ট গিলবার্ট রম কথা বলছিলেন, তখন গিলবার্টের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “If there is a God we must look for him in the Universe. If he is not there, he is not worth looking for.” যদি ভগবান থেকেই থাকেন, তাহলে আমাদের উচিত তাঁকে এই মহাবিশ্বে খোঁজা, আর উনি যদি সেখানে না থাকেন, তাহলে ওঁকে খোঁজার কোনও দরকারই নেই। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক মাত্রেই নাস্তিক নন, কিন্তু বেশিরভাগই অজ্ঞেয়বাদী, তাঁদের সংশয় আছে তাঁরা খুঁজে চলেছেন। এই শিক্ষাই আমার দেশের লক্ষ কোটি ছাত্রদের দেওয়া উচিত, প্রশ্ন করো, প্রশ্নের উত্তর পেলে আবার প্রশ্ন করো, এভাবেই সত্য বেরিয়ে আসে, কোনও সত্য বেরিয়ে এলেই তা চিরসত্য হয় না, সেই সত্যের পরেও অন্য সত্য আসতেই পারে। কাজেই একজন তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মাচরণে কী? তার থেকেও জরুরি প্রশ্ন সে প্রশ্ন করে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছে কি না। শেষমেশ আবার আসা যাক, মোদিজির এই নামকরণ নিয়ে, আমাদের বিজ্ঞানচর্চার তো কোনও অভাব ছিল না। আর্যভট্ট থেকে শুরু, চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের প্রাচীনকালেও বিরাট গবেষণা ছিল, চরক, সুশ্রুত ছিলেন, আমাদের ধাতু বিজ্ঞান গর্ব করে বলার মতো, জোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের বহু প্রাচীন গবেষণা আছে, আর্যভট্ট, গর্গ, লাটদেব, বরাহমিহির, চরক, সুশ্রুত, ব্রহ্মগুপ্ত, লীলাবতী, শ্রীধর, নাগার্জুন কতশত নাম আছে আমাদের প্রাচীন বিজ্ঞানের ইতিহাসে। তাঁদের একজনের নাম থাকলেও, এক শিশু, কিশোর, এক ছাত্র জানার চেষ্টা করলে জানতে পারত সেই গৌরবজনক ইতিহাসের কথা, তাঁদের নাম দেওয়াই যেত ওই অবতরণ ভূমির। কিন্তু মোদিজির তো সেসবের প্রতি এমনিতেই যথেষ্ট অনীহা, নিজেই কুসংস্কারের গোড়া, কাজেই তিনি চাইলেন জায়গাটার নাম হোক শিবশক্তি, অসাম্প্রদায়িক মানুষ বিরোধিতা করবেন, কাজেই আবার দেশের মানুষদের বিভাজিত করা যাবে, মেরুকরণ হলে ভোট বাড়বে, অতএব এক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের এক পূণ্যভূমির দখল থাক এক ধর্মের গোঁড়া মানুষজনেদের। অন্যদিকে যে জায়গায় পৌঁছতে পারল না চন্দ্রযান-২, সেখানকার নাম তিরঙ্গা। মোদিজির মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, এরপরেও দেশপ্রেমিক মানুষেরা, সংবিধানে বিশ্বাসী মানুষেরা, ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী মানুষেরা যদি এক স্বরে এই মোদি জমানার বিরোধিতা না করেন, তাহলে আগামী দিনগুলোতে বিরোধিতা করার অধিকারও হারাবেন, এ কথা বলাই বাহুল্য।