যে কোনও মোচ্ছবের, আনন্দ অনুষ্ঠানের চলতে থাকার একটা সোজা ব্যাকরণ আছে। কীর্তন চলছে চলছে, যদিও কথাকারের চোখে জল, রাধার কী হল পরাণে ব্যথা ইত্যাদি, তবুও শ্রোতাদের কারও কারও চোখে ঘুম। হঠাৎ খমচক খমচক করে খঞ্জনি বেজে উঠবে, হঠাৎ খোল করতালের সঙ্গে এক কোরাস, লোকজন হাত তুলে এক পাক নেচেও নেবেন, বল্লো হরি হরিবোল বলার পরেই আবার কথকের কথা শুরু হবে। কালীপুজোর দিনে বাজি এসেছে, ছাদে বাজি ফাটানো হচ্ছে, দুটো তারাবাজি, একটা দড়িবাজি, একটা সাপবাজি, আবার তারাবাজি ইত্যাদির মধ্যেই একটা মস্ত হাউই উড়ে যাবে, আকাশে রঙিন আলোর ফুলকি, বাচ্চারা উউউ করে উঠবে, রাঙাকাকা ছবি তুলবে, বড়দা হাউইয়ে আগুন দিয়েছিল, তার মুখে আনন্দ। তারপর আবার তারাবাজি, আবার সাপবাজি আবার দড়িবাজি এবং আধ ঘণ্টা পরে আবার একটা ৮০ ফুট ঝরনা ছড়ানো তুবড়ি ফাটানো হবে তবেই তো আনন্দের গতিধারা বজায় থাকবে। সব হাউই, সব তুবড়ি, সব মারকাটারি বাজি কি একসঙ্গে পোড়ানো হয়? তাকিয়ে দেখুন সিবিআই বা ইডি বা ইনকাম ট্যাক্স রেডগুলোর দিকে। এনারা ওই মোচ্চব চালানোর মতোই দিন ১৫-২০ পর পর হঠাৎ হই হই করে নামছেন বাজারে, চোখে চোখ রাখনেওলারা টিভি স্ক্রিনে তাদের উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছে, সে উত্তেজনা আগুনের শিখা আপনার কপাল স্পর্শ করছে। এটাই খেলা। আজ সেই খেলাই চলল সারাটা দিন, ১৩টা পুরসভা আর পুর নগরোন্নয়ন দফতরে সারাদিন সিবিআই হানা। আজ সেটাই বিষয় আজকে, পুরসভায় সিবিআই। পেলটা কী?
এসব নৌটঙ্কি কিছুদিন ঢিমে তালে চলবে, পুজো, আইপিএল ফাইনাল কিংবা পাঠান রিলিজের দিনে বন্ধ থাকবে, তারপর হারে রে রে রে, ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে। আজ তো নয়, খেয়াল করুন, সেই কবে মদন গেল জেলে, সে যাত্রাপালায় কত রস, কত গান, কত কথা, কত গল্প। আজ সে মদনের চোখে কাতিয়ের সানগ্লাস, ধিনা ধিন ধা, ও মদন দা, নাচুন না। এখন মদনের বদলে পার্থ, কেষ্ট, মানিক, কুন্তল। সিবিআই আসে সিবিআই যায়, এক ছবি তৈরি হয়। রাজ্য জোড়া দুর্নীতির ছবি, কিন্তু শেষমেশ সব পাখি ঘরে ফেরে, সব পার্থ কেষ্ট মানিকেরাও ঘরে ফিরবে। তখন আবার নতুন পালা, পাত্র আর স্থান বদলে যাবে এই মাত্র। উদ্দেশ্য কিন্তু এক, রাজ্যজুড়ে চলছে দুর্নীতি, এই অপটিকসকে সযত্নে গড়ে তোলা হবে। সেই কবে নারদার ছবি দেখেছিলাম, সেই কবে দেখেছিলাম চিট ফান্ডের গ্রেফতারি, দু’ পিস কাঁঠালি কলা ছাড়া প্রত্যেকে জেলের বাইরে, সম্পাদক সাংবাদিক তো আপাতত জেলফেরত সাভারকরের ভূমিকায় নেমে পড়েছেন। মানুষও ভুলে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: Aajke | মমতা আবার কটকে, রাজনীতি না মমতা?
এখন নায়ক অন্য কেউ, এসবও ভুলে যাবে, তখন নায়ক আবারও পালটে যাবে, বাট দ্য শো মাস্ট গো অন। আজ তো খেলায় নতুন মজা, একঘর মজা। পুরসভার নিয়োগ দুর্নীতি খুঁজতে সিবিআই অফিসারেরা চলে গেল ভ্যালুয়েশন বোর্ডে। সেখান থেকে তাঁদের নিশ্চয়ই জানানো হল, মেরে অঙ্গনে মে তুমহারা কেয়া কাম হ্যায়? তাঁরা বেরিয়ে চলে গেলেন ডিরেক্টরেট অফ লোকাল বডিজ-এর দফতরে, সেখানে কৃত্তিবাসী আলোচনার পরে অন্য কোথাও অন্য কোনওখানে। কপালকুণ্ডলা থাকলে নিশ্চয়ই বলতেন, পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ? ২১টা টিম এর ৮০-৯০ জন মানুষ রাজ্যের পুরসভায় ছড়িয়ে গেলেন মুহূর্তের মধ্যে, তাঁরা নাকি দুর্নীতি খুঁজে বার করবেন। অভিযোগ আজ থেকে মাসছয়েক আগে। তদন্ত সিবিআই-এর হাতে তাও মাস চারেক আগে তো বটেই, তারপর থেকে এতদিন দুর্নীতির প্রত্যেকটা কাগজ যত্ন করে ফাইলে রেখে দুর্নীতিবাজেরা ডাকছে আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়, এসে ফাইল থেকে দুর্নীতির যাবতীয় কাগজ বের করে নিয়ে যা। আপনারা কেউ একথা বিশ্বাস করেন? পুরসভার দুর্নীতি পুরসভার ফাইলেই রাখা থাকবে, সেই ফাইল রাখা থাকবে আলমারিতে, যে আলমারি আজ গিয়ে সিবিআই অফিসারেরা ভাঙলেন, সেখানে আছে দুর্নীতির কাগজ? তৃণমূলও জানে নেই, সিবিআইও জানে নেই, পাবলিকও জানে নেই। তাহলে খামোখা কেন আলমারি ভাঙা হল? কারণ টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে কিছু বাজি তো আকাশে পাঠাতে হবে, রঙিন করে তুলতে হবে আকাশ, ভিস্যুয়াল চাই। কেবল সিবিআই গেলে হবে? এখান থেকে কোটি কোটি উদ্ধারের গল্পও তো নেই। চোখে চোখ রাখনেওয়ালারা রেল কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত গাফিলতির আর লাশ দেখাবে কতক্ষণ? তাই রেল দুর্ঘটনার পাল্টা ভিস্যুয়াল, সিবিআই হানা। চিপকে থাকা লাশ আর মানুষের মৃত্যুর উল্টোদিকে গাড়ি থেকে নামছে সিবিআই, আলমারি ভাঙছে সিবিআই। আমরা মানুষের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, এই যে বার বার সিবিআই হানা এবং কার্যক্ষেত্রে শূন্য হাতে তাদের ফিরে যাওয়া, দুর্নীতির গল্প গল্পই থেকে যাওয়া, এতে কি সিবিআই-এরই বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে না? শুনুন মানুষ কী বলছে।
কিছু দুর্নীতি, কিছুটা গল্প আর বেশ কিছুটা প্রচার দিয়ে এক অপটিক্স তৈরি হচ্ছে, এক ছবি তৈরি হচ্ছে, এক ধারণা তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, রাজ্যের সর্বত্র দুর্নীতি, সরকারের প্রত্যেকে চোর। এবং মানুষ দেখছে ক্রমাগত এই প্রচারই কেবল চলছে, বাস্তবে একজনও শাস্তি পাচ্ছে না, পাবেও না, কিছুদিন পরে সব্বাই বেল পাবে, এটাও মানুষ বুঝতে পারছে। এর ফলে দুটো জিনিস হচ্ছে, মানুষের পুলিশ সিবিআই ইত্যাদির ওপরে যে ন্যূনতম ভরসা ছিল সেটাও চলে যাচ্ছে, দুই আসল দুর্নীতিবাজেরা জানেন এসব খেলা চলছে, যাত্রাপালা চলছে, চলবে, অতএব তাঁরা মনোযোগ দিয়ে নতুন দুর্নীতির খেলায় নেমে পড়ছেন।